১৫০০ থেকে ১৮০০ সাল পর্যন্ত সতিদাহ প্রথার কারণে প্রাণ দিয়েছেন হাজার হাজার নারী। ১৮২৯ সালের ৪ ডিসেম্বর তৎকালিন ব্রিটিশ সরকার আইন করে এই প্রথা বন্ধ করে দেয়। তারপরও ধর্মীয় প্রচারণার কারণে ১৯৮৭ সালের ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত চালু ছিল অমানবিক ও নিষ্ঠুর সতিদাহ প্রথা।
এই প্রথার সর্বশেষ শিকার ছিলেন রূপ কানওয়ার। ১৯৮৭ সালের ৪ সেপ্টেম্বরে রাজস্থানের সিকার জেলার দেওরালা গ্রামে স্বামীর চিতায় তাকে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। ওই সময় তার বয়স ছিল মাত্র ১৮ বছর। এই ঘটনায় সে সময়ে চরম বিস্ময় ও প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছিল। এরপর ওই গ্রামটিকে কুখ্যাত বলে আখ্যা দেয়া হয়।
১৯৬৯ খ্রীস্টাব্দে ভারতের রাজস্থানের সিকার জেলায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন রূপ কানওয়ার। ১৮ বছর বয়সে মাল সিং শেখাওয়াত নামের ২৪ বছর বয়সী একজন মানসিক রোগীর সাথে তার বিয়ে হয়। বিয়ের মাত্র আট মাসের মাথায় স্বামী মাল সিং শেখায়াত মারা যান। সতিদাহ প্রথার উন্মাদনায় তাকে স্বামীর চিতায় পুড়িয়ে মারা হয়।
রূপের এই নৃশংস সহমরণ অনুষ্ঠানে কয়েক হাজার মানুষ অংশ নিয়েছিল। মৃত্যুর পরে রূপ কনওয়ারকে সতী মাতা ও খাঁটি সতি মা হিসেবে প্রশংসিত করা হয়। এই ঘটনাটি জনসাধারণের মধ্যে চরম চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল।
সে সময় কোনো কোনো সংবাদপত্রের রিপোর্টে কানওয়ারের মৃত্যুকে স্বেচ্ছা সহমরণ বলে উপস্থাপন করা হয়। তবে কয়েকটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত রিপোর্টে লেখা হয়েছিল যে, উপস্থিত লোকেরা কানওয়ারকে সহমরণে যেতে বাধ্য করেছিল। তাকে বলা হয়েছিল যে, পরিবারের প্রতি সন্মান জানাতে এবং সতী মাথা হতে স্বামীর চিতায় উঠতে হবে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা সাক্ষ্য দেয় যে, রূপ কানোয়ার প্রাণ বাঁচাতে শস্যাগারে লুকিয়েছিল। তার শ্বশুরবাড়ির তলোয়ারধারী পুরুষ লোকজন তাকে জোর করে ধরে এনেছিলেন। তাকে মারধর করে মাদকাসক্ত করা হয়েছিল। এতে তিনি ভারী চোট পেয়েছিলেন। তার মুখ থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। তাকে তার স্বামীর মৃতদেহের উপরে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। সে যাতে নড়াচড়া করতে না পারে সে জন্য ভারী কাঠের লগ চাপিয়ে রেখে চিতায় আগুন দিয়ে সহমরণ কার্যকর করা হয়।
এই ঘটনায় ৪৫ জনকে অভিযুক্ত করে মামলা করা হয়। দীর্ঘকাল মামলা চলার পর ২০০৪ সালের ৩১ জানুয়ারী জয়পুরের একটি বিশেষ আদালত এই মামলার সব আসামিকে খালাস দিয়েছিলো।
সতিদাহ প্রথা উচ্ছেদের উদ্যোক্তা ছিলেন রাজা রামমোহন রায়। তিনি ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং অন্যান্য জ্ঞানী ব্যক্তিদের নিয়ে জনমত গড়ে তোলেন। তাদের উদ্যোগ ও সম্মিলিত প্রচেষ্টার সাথে ভারতের তৎকালীন গভর্নর জেনারেল উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক একমত হন। এরপর ১৮২৯ সালের ৪ ডিসেম্বর বঙ্গীয় প্রাদেশিক সরকার কর্তৃক সতীদাহ প্রথা আইনীভাবে বিলুপ্ত করা হয়। আইন করে বন্ধ করার পরও চিতার সেই কালো অন্ধকার ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত কম বয়সী বিধবাদের পিছু ছাড়েনি।
রূপ কানওয়ার ধর্মের বলি হয়ে রূপকথার কাহিনীতে সতী মাতা হয়ে আছেন। প্রতি একাদশীতে গ্রামের মেয়েরা নিয়ম করে সতী স্থলে রাখা রূপের ছবিতে ধুপধুনো দিয়ে পূজা দেয়। যেই ঘর থেকে বেরিয়ে রূপ ‘সহমরণে’ যেতে বাধ্য হয়েছিলেন সেখানে এখনও নিত্য পুজো চলে। তবে আদালতের নিষেধাজ্ঞায় থাকায় সেখানে মন্দিরের কোন কাঠামো গড়ে ওঠেনি।
সতি মাতা রূপের বাড়ী জয়পুর থেকে দেড় ঘণ্টার পথ। বাবলা, আকন্দ আর শেয়ালকাঁটার ঝোপে ঘেরা তাদের দেওরালা গ্রাম। তার শ্বশুরমশাই সুমের সিংহ ছিলেন শিক্ষক। কানে কম শুনলেও সতি দর্শন করতে আসা লোকদের তিনি খুব গুরুত্ব দেন। কেউ এসেছে জানলে তিনি তাদের রূপের সেই ঘরে নিয়ে যান। যেই ঘর থেকে রূপকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সেই ঘরটি এখন সতীস্থল।
প্রশ্ন উঠে রূপ কি ‘সতী’ হয়ে এই অমরত্ব চেয়েছিলেন? কেউ বলেন হ্যাঁ, কেউ বলেন না। রূপের শ্বশুর সুমের সিংহের ঘর দেখানোর আগ্রহ বলে তিনি এখনো সতি মাতার রূপকল্পে বিশ্বাসী। তার গ্রামের লোকেরাও তার অনুসারী। কেবলমাত্র দেওরালা গ্রামই নয় সমস্ত রাজস্থান জুড়ে, বিশেষত রাজপুত সমাজে এই প্রথা এখনো মারাত্মক উন্মাদনার বিষয়। সতিদাহ প্রথা নেই তবে সতি সাধনার ব্রত হিন্দু সমাজে এখনো চির জাগরুক।
লেখকঃ প্রখ্যাত সাংবাদিক আলী আসগর স্বপন। লেখাটি সম্পাদনা করেছে দৈনিক দেশতথ্যের ঢাকা ডেস্ক।
এবি/৫ সেপ্টম্বর/২০২১
![প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন](http://dailydeshtottoh.com/wp-content/plugins/wp-print/images/printer_famfamfam.gif)
Discussion about this post