বাক প্রতিবন্ধি বাবা ও আমার অনুভূতি
আমি একজন বাক প্রতিবন্ধির সন্তান। এটা আমার অহংকার। আমার বাবা আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। বোবাকে নিয়ে আমার রয়েছে অনেক স্মৃতি। বাবা দিবসে এই আয়োজনে তুলে ধরছি কিছু স্মৃতিচারণমূলক কথা।
আমাদের জীবন বাস্তবতায় বাবারা সবসময় থাকেন একটু বহির্মুখী। মা যেমন একই সাথে হতে পারেন চাকরিজীবী তেমনি হতে পারেন গৃহিণীও। কিন্তু বাবাকে সব ক্ষেত্রেই পেশা আর জীবিকার কারণে বেশির ভাগ সময়ই বাইরে কাটাতে হয়। ফলে বাবার সঙ্গে আমাদের সময় কাটানোর সুযোগটা অনেক কমই হয়ে ওঠে। তার ওপর অনেক ক্ষেত্রে আমাদের শাসনের ভারটিও বাবার ওপরই বর্তায়। ফলে কারও কারও হয়তো বাবার প্রতি একটা চাপা অভিমান কাজ করে। কিন্তু এই একটি দিনে অন্তত সেই অভিমানগুলো ভুলে গিয়ে যেন আমরা বলতে পারি বাবা তোমায় অনেক ভালোবাসি। একসাথে থাকতে গিয়ে নিজের অজান্তে প্রায়ই আমরা বাবাকে হয়তো অনেক দুঃখ দিয়ে থাকি। আবার সে জন্য ক্ষমাও চাওয়া হয়ে ওঠে না অনেক সময়। তাই বাবার প্রতি ভালোবাসার অনুভূতিগুলো প্রকাশের জন্য এ দিনটিকে আমরা স্পেশালভাবে বেছে নিতে পারি।
বাবা মানে নির্ভরতার আকাশ, নিরাপত্তার চাদর। আদর-শাসন আর বিশ্বস্ততার প্রতীক হলো বাবা। যার কল্যাণে এই পৃথিবীর রূপ, রঙ ও আলোর দর্শন। সন্তানের নিত্য আবদার মেটানো এবং সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য নিজের বর্তমানকে প্রতিনিয়ত হাসিমুখে বিসর্জন দেওয়া এই বাবাদের আজ আলাদাভাবে স্মরণ করার দিন।
প্রতিবছর জুন মাসের তৃতীয় রবিবার বিশ্বজুড়ে বাবা দিবস উদযাপন করা হয়। সে হিসেবে আজ রবিবার (১৮ জুন) বিশ্ব বাবা দিবস। এ বাবা দিবস উদযাপনের পেছনে রয়েছে এক সুমহান ইতিহাস।
বাবাকে নিয়ে অনেকের মতো বাবা-ছেলের মধুর সম্পর্ক হয়তোবা আমার না থাকলেও কোন অংশেই কম ছিলো না আমার। অন্য সবার থেকে আমার বিষয়টি ছিলো আলাদা। কারণ, আমারর বাবা বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী। অন্য সবাইরা যখন বলে বাবা তুমি তাড়াতাড়ী বাসায় ফিরে এসো কিংবা আব্বা আমার জন্য মজা কিনে আনবে। এই ডাক কিংবা আবদার আমার ইশারায় করতে হয়েছে। তবুও আমার বাবার সাথে মধুর সম্পর্ক অটুট।
পরিবারের বড় সন্তান হিসেবে ছোট বেলা থেকেই আদর-ভালোবাসা পেয়েছি সবচেয়ে বেশি। এখনো স্পষ্ট মনে আছে—যখন ছোট ছিলাম। তখনকার বাবার সাথে অনেক স্মৃতি আজও হাতড়ে বেড়ায়। গ্রামের এই আমি যখন ছোটবেলায় প্রাইমারী স্কুলে পড়তাম। বাবা কাঠেরর মিস্ত্রি হিসেবে কাজ করতে যেতেন আশেপাশের গ্রামে।
সেসময় সাপ্তাহিক সোমবার ও শুক্রবার ছিলো মশানে হাটবার। তাই এই দুই দিন হাট করলে তিনদিন চলতো। বাবা কাজ শেষ করে আসতো। বিকেলে বাজারের ব্যাগ নিয়ে বাবার সাথে হাটে যেতাম। যদিওবা অনেকেই ছোট ছেলেরা বাবার হাত ধরে বাজারে যেতো বায়না ধরে।
কিন্তু মা আমাকে বাবার সাথে পাঠাতো, তরকারী কিংবা সবজী আনার জন্য দোকানীকে বোঝানোর জন্য। যদিও বা তখনও বাবাকে ইশারায় বলতাম এটা কিনতে হবে, ওটা কিনতে হবে, এভাবেই আমি বাবার সাথে বাজার করে ব্যাগ টেনে আনতাম। তবে বাজার করা শেষে বাবার বন্ধুরা (বোবা-কালা) সাবান কাল, সোনা কাল ও মান্নান কাল মিলে বাবারা ৪জন বোবা একত্রে বসে ইশারায় গল্প করতেন। এই দৃশ্য দেখতে কিছু মানুষ ভীড় করতো। মজা নিতো।
অবশ্য একটা সময় আমাকেরই বাজার করার দায়িত্ব নিয়ে হাটবাজার করতাম। যখন আমি বড় হলাম বুদ্ধিদীপ্ত হলাম তখন বাড়ীর কোন অনুষ্ঠানে বাবার বন্ধুদের আমন্ত্রণ জানাতাম। এছাড়াও অনুষ্ঠান বাদেও সেসব বন্ধুদের আসতে বলতাম, বাবার সাথে আড্ডা দেওয়ার জন্য। আবার আমিও তার পরিচিত বন্ধুদের ওখানে পাঠাতাম, কিংবা আমিও নিয়ে যেতাম। এক সময় ভেড়ামারা, রূপপুর, ঈশ্বরদী,আল্লারদর্গা ও কুষ্টিয়া থেকে বাবার বন্ধুরা বাড়ীতে আসতো। আমার খুব ভালো লাগতো। বেশ উপভোগ করতাম, তাদের এ সম্প্রীতির মেলবন্ধন দেখে।
যায় হোক আস্তে আস্তে বয়স বেড়েছে বাবার, ডিজিটাল যুগে মুঠোফোনে অনেক কিছু এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাবা এখন নিয়মিত ভিডিও কলে কথা বলে, ইশারায়। আবার অপেক্ষায় থাকে কখন, কোন বন্ধু ভিডিও কল করবে।
আমরা তো মুখের ভাষায় কত কথা বলি, বন্ধুত্ব সৃষ্টি করি। অথচ তাদের কেবলই বন্ধু হয় (বোবা-কালাদের) সাথেই। তবুও আমি তৃপ্ত। আমি গর্বিত, আমার বাবা শ্রেষ্ঠ বাবা।
বাবা অসুস্থ হলে হাসপাতালে ভর্তি করলে প্রতিদিনই সন্ধ্যায় বাবার বন্ধুরা সঙ্গ দিতে হাসপাতালে ছুটে আসতো। বাবাকে হাসপাতালে ভর্তির শুরু থেকে অপারেশনের পর যে কদিন হাসপাতালেল কেবিনে ছিলো সে ক’দিন তাদের এই আসা যাওয়াটা আমাকে ভীষণ আনন্দ দিতো। কারন বাবার সাথে তাদের এই সঙ্গটা অন্যরকম। তখন বাবা আরও নিজেকে বেশি সুস্থ্য মনে করতো।
পারিবারিক কাঠামোতে বেড়ে ওঠার সময় আমরা অনেকেই ভেবে নেই যে শুধু মা-বাবাই সন্তানের প্রতি দায়িত্ব পালন করবেন এবং সন্তানের ভালো-মন্দ দেখভাল করবেন। কিন্তু সন্তান যখন একটু বড় হয়ে পড়াশোনা বা কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে তখন বাবা-মাও প্রত্যাশা করেন যে সন্তানরাও একইভাবে তাদের খোঁজ-খবর নেবে।
পরিশেষে বলতে চাই, বাবাকে ঘিরে আমাদের প্রত্যেকের রয়েছে অনেক না বলা গল্প, না বলা স্মৃতি। এ দিন অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাবার স্মৃতিচারণ করে থাকে। অনেকে বাবার স্মৃতি স্মরণ করতে গিয়ে ছুটে যায় দুরন্ত শৈশব, কৈশোরে। প্রত্যেক সন্তানের কাছে বাবা অতুলনীয়, অসাধারণ। আমার চোখে আমার বাবা একজন মহামানব। পৃথিবীর সব সন্তানের কাছেই তাই। কারন, বাবা হচ্ছে বটবৃক্ষের মত। শুধু ছায়া দিয়ে নয় সন্তানকে আগলে রাখে সবকিছু দিয়ে। নিজে খুপড়ি ঘরে থাকলেও সন্তানকে ভালো ঘরে থাকার ব্যবস্থা নিশ্চিত করে। সকল বাবা মা চান আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে। পৃথিবীর সকল বাবার জন্য বাবা দিবসে অনেক শুভেচ্ছা। বাবা আমি তোমায় ভালোবাসি, অনেক বেশি ভালোবাসি।
এবি//দৈনিক দেশতথ্য//জুন ১৭,২০২৩//
প্রিন্ট করুন
Discussion about this post