কুষ্টিয়া থেকে এসএম জামাল:
আমি শ্রবণ ও বাকপ্রতিবন্ধী বাবার সন্তান। কথা বলতে বা শুনতে না পারার যে কি অব্যক্ত যন্ত্রণা তা আমার বাবাকে দেখে সেই ছোটবেলায়ই অনুভব করেছি।
এনিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। কারণ শ্রবণ ও বাকপ্রতিবন্ধী মানুষদের এ ভাষাকে স্বীকৃতি দিয়ে ৭ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে পালিত হয়ে আসছে ‘বাংলা ইশারা ভাষা দিবস’।
২০১২ সালের ২৬ জানুয়ারি আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় সর্বসম্মতিক্রমে ৭ ফেব্রুয়ারিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলা ইশারা ভাষা দিবস হিসেবে নির্ধারণ করা হয়।
আমি একজন সাংবাদিক। কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার মশান গ্রামে আমার নিবাস। আমি বাস করি বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী বাবার সঙ্গে। তাই তাদের যন্ত্রণা আমি হৃদয় দিয়ে অনুভব করেছি। আমি বাবার সঙ্গে ইশারাতেই কথা বলি।
মায়ের কাছে শুনেছি ছোটবেলায় আমি নাকি বাবার সঙ্গে ইশারায় কথা বলতে চাইতাম না। তাকে বাবা বলেও ডাকতাম না। তার খুব আফসোস হতো আমি তাকে বাবা বলে ডাকতাম না বলে। এজন্য তখন আমার চাচাদের কাছে অভিযোগ করত। অবশ্য সেসব অভিযোগ কিংবা অভিমান এখন আর নেই। মিলেমিশে ইশারা ইঙ্গিতেই তার সঙ্গে চলে আমার ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথোপকথন।
ছোটবেলায় যখন বাবার সাথে বাজারে যেতাম তখন বলতাম এদাখো, আলু কেনো, বেগুন কেনো, মরিচ কেনো। ইত্যাদি সব মিলিয়ে বলতে হতো। কিন্তু ছোট চাচা যখন আমাকে বলল যে তুই নাকি তোর বাবাকে ডাকিস না, এমন কথা শোনার পর আমি বাবাকে কখনো আব্বা আবার বাবা বলে সমস্বরে চিৎকার করে ডাকতেই তিনি ভীষণ খুশি হতেন। সেই খুশির পর থেকেই আমি এভাবেই হাসি খুশির সাথে ইশারা ভাষায় কথোপকথন করে আসছি।
নিজের ভাষায় কথা বলার জন্য কত যুদ্ধ, পরিশ্রম। অথচ অনেকই আছেন যাদের ভাগ্যে নিজের ভাষাটুকু উচ্চারণের সেই সুযোগটাই হয়নি আর হয়তো হবেও না। তারা তাদের মনের ভাষা ব্যক্ত করেন নিজের ইশারার মাধ্যমে।
মুখের বিকৃত ভঙ্গিমা, কাঁধের ওঠা-নামা কিংবা আঙুল তাক করাকে একধরনের মোটা দাগের ইশারা ভাষা হিসেবে গণ্য করা যায়। সভ্যতার বিকাশের আগে ইশারা ভাষাই প্রচলিত ছিল। তবে প্রকৃত ইশারা ভাষায় হাত ও আঙুল দিয়ে সৃষ্ট সুচিন্তিত ও সুক্ষ্ম দ্যোতনাবিশিষ্ট সংকেত সমষ্টি ব্যবহৃত হয়। এর সাথে সাধারণত মুখমণ্ডলের অভিব্যক্তিও যুক্ত করা হয়। মূক ও বধির লোকেরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের জন্য ইশারা ভাষা ব্যবহার করে থাকেন।
কুষ্টিয়া জেলা মুক ও বধির সংঘের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহমান সুমন বলেন, সরকার প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উন্নয়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। উন্নয়নের মূল স্রোতধারায় শ্রবণ-বাক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সম্পৃক্ত করতে না পারলে তাদের উন্নয়ন যেমন সম্ভব নয় তেমনি সম্ভব নয় দেশের সার্বিক টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা। এ লক্ষ্যে সরকার ইতিমধ্যে শ্রবণ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উন্নয়নে ও কল্যাণে বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ টেলিভিশনে সংবাদ হলে সংবাদ পাঠের পাশাপাশি ইশারা ভাষায় যে প্রচলন রয়েছে ঠিক তেমনি প্রতিটি জেলায় সরকারি বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠানে এমন দোভাষী হিসেবে ইশারা ভাষা ব্যবহারের ওপর জোর দেওয়া প্রয়োজন বলে আমি মনে করি।
কুষ্টিয়া জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালক আবদুল কাদের বলেন, এ জেলায় প্রতিবন্ধীর হার সবচেয়ে বেশি। ৬৬ হাজার প্রতিবন্ধীর মধ্যে বাক প্রতিবন্ধী ৩ হাজার ৩৬৮ এবং শ্রবণ প্রতিবন্ধী ৩ হাজার ২৩ জন। তিনি বলেন, সরকার প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উন্নয়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। উন্নয়নের মূল স্রোতধারায় শ্রবণ-বাক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সম্পৃক্ত করতেও কাজ করে যাচ্ছে।
তবে এ জেলায় বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের জন্য বিদ্যালয় চালু করলে তাদের অনেকটাই উপকারে আসবে।
এবি//দৈনিক দেশতথ্য//ফেব্রুয়ারী ০৭,২০২৪//
প্রিন্ট করুন
Discussion about this post