শেখ জাহাঙ্গীর আলম শাহীন, লালমনিরহাট:
অসাম্প্রদায়ক জেলা শহর লালমনিরহাট । এই শহরের পুরান বাজার দুর্গা মন্দির, কালীমন্দির ও কালীবাড়ি জামে মসজিদ একই চত্বরে। মসজিদের পাশেই একই চত্বরে দুইশত বছর ধরে চলছে ধুমধাম করে দুর্গাপুজা। পুজাঅর্চনায় এতোটুকু ছেদ পড়েনি আজানের ধ্বনি কিংবা শাঁক, সঙ্খ, ঢাক কাশির বাজনা।
লালমনিরহাট শহরের কালীবাড়িতে এই মসজিদ মন্দিরের অবস্থান। অবিভক্ত বাংলায় এই কালীবাড়ি শহর ছিল হিন্দু মারওয়ারী ব্যবস্থায়ীদের ব্যবসা কেন্দ্র। ভৌগলিক অবস্থানের দিক হতে লালমনিরহাট শহর ছিল দক্ষিণ এশিয়ার স্বর্ণদার বা প্রবেশদ্বার। তাই ইংরেজরা ১৮৮২ সালে ভারত বর্ষে লেলাইন স্থাপনের প্রথম দিকে লালমনিরহাটে রেললাইন স্থাপন করে। এমন কি এই শহরে ১৯৪৫ সালে ইংরেজরা ১৭৬০ একর জমিতে দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তর বিমান ঘাঁটি স্থাপন করে ছিল। বৃটিশ- ভারত যুগে এই লালমনিরহাট শহর ছিল সমৃদ্ধশালী ব্যবসাবাণিজ্য কেন্দ্র। এতোটা সমৃদ্ধ ছিল যে, এখানে অটো রাইচমিল, ভোজ্যতেল শোধনাগার, হাবিব ব্যাংকের শাখা ছিল। বৃটিশরা লালমনিরহাট কে রেলওয়ে বিভাগীয় শহর হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে ছিল। এখনো বৃটিশদের গড়া রেলওয়ের লাল ইমারত গুলি বৃটিশদের স্মৃতি চিহ্নি বহন করছে। সেই বৃটিশ ভারত গোড়াপত্তনের যুগ হতে কালীবাড়িতে ধর্মীয় সম্প্রতির দৃষ্টান্ত স্থাপন হয়। ব্যবসায়ী সম্প্রদায় ছিল সনাতন ধর্মাবলি কিন্তু এতোত অঞ্চলে অনেক ব্যবসায়ী ছিল মুসলিম। সনাতন ধর্মাম্বলীরা এখানে কালী মন্দির স্থাপন করে প্রত্যেহ পুজা অর্চনা শুরু করে। পুরোহিতদের বসবাসে তৈরি করা হয় গৃহ। কালী মন্দিরে কালের পরিক্রমায় এক সময় শুরু হয় দুর্গাপুজা। এই মন্দিরের পাশে মুসলিমরা বিশ্রামার ও ওয়াক্তি ইবাদত খানা নির্মাণ করে। কালের পরিক্রমায় সেই ইবাদতখানা এখন বিশাল মসজিদ। যাহা কালীবাড়ি জামে মসজিদ নামে পরিচিত। সেই কবে হতে এখানে একই চত্বরে দুর্গাপুজা ও মসজিদে নামাজ হচ্ছে কেউ সঠিক পরিসংখ্যান বা তথ্য দিতে পারেনি। তবে প্রায় দুই বছরের ঐতিহ্য এটা সেটা সুনিশ্চিত।
সারা দেশে বিভিন্ন সময় ধর্মীয় উম্মদনা হয় কিন্তু এখানে তার কোন ছোঁয়া কোনদিন লাগেনি। দুই ধর্মের মানুষের কোন খেদ নেই তাতে। এখানে অসম্প্রদায়িক চেতনা শতশত বছর ধরে লালন করে আসছে সাধারণ মানুষ। এই শহরে শত বছরের পুরোন একটি খৃষ্টান মিশনারীও রয়েছে। আছে রোমান ক্যাথলিক চার্চ (খৃষ্টানদের চার্চ)। এই চার্চ সাক্ষ্যবহন করে খৃষ্টান, হিন্দু ও মুসলিমদের সহাবস্থান এই শহরে অনেক পুরাতন। এবছর সাম্প্রদায়িক রং লাগিয়ে উগ্রমৌলবাদী অপপ্রচারে মাঠে নেমেছিল। মসজিদ চত্বরে পুজা কেন? প্রশ্ন তুলতে গোপন ষড়যন্ত্র করে ছিল। দুই সপ্তাহ আগে এই শহরের কাগজিটারি দুর্গামন্দিরে আযান দিয়ে নামাজ আদায়ের ঘটনাও ঘটে। পুলিশ জনতা সেই যুবককে অবশ্য আটক করেছে। এই ঘটনার পর হতে হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে কিছুটা আতস্ক বিরাজ করেছিল কালীবাড়ি দুর্গাপুজা নিয়ে কিন্তু সাধারণ মানুষ ও প্রশাসন সেই আতস্ককে নাখোশ করে দিয়েছে। এবারও দুইশত বছরের ঐহিত্যকে ধরে রেখে শান্তিপূর্ণ ভাবে দুর্গাপুজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সুধিজনরা বলছে মন্দিরটি দুই শত বছরের পুরোন। মসজিদ অনেক পরে হয়েছে। হিন্দু ধর্মাম্বলীদের উদারতায় মুসলিম অধ্যুষিত শহরে মন্দিরের পাশে মসজিদটি হয়। তখন হতে একই আঙিনায় মসজিদ – মন্দির। যাহা এখন ধর্মীয় অসম্প্রদায়িক সিম্বল।
এখানে মুসলিম সম্প্রদায়ের ইবাদত প্রত্যহ নামাজ পাঁচ ওযাক্ত অনুষ্ঠিত হ। আর মন্দিরে হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রত্যেহ উপাসনালয়ে পুজা – অর্চনা করে আসছে। কিন্তু দুই ধর্মের ধর্মপ্রাণ মানুষের মধ্যে বাধা হতে পারেনি। সমস্যা হয় মাগরিবের সময়। তখন প্রায় একই সময় মাগরিবের আযান হয় ও মন্দিরে সঙ্খ, শাঁক, ঢাক বাজিয়ে ধঁপকাঠি জ্বালিয়ে প্রত্যহ মন্ত্রপাঠে পুজা হয়। একই সময় পুজা ও ইবাদতে যেন কোন সমস্যা সৃষ্টি না হয় সে জন্য তারা বসে সমাধান করেছে। আজান হলে সাময়িক সময়ে পুজা অর্চনা স্থগিত রাখে। সেই সময় টুকুতে ঢোল, খোল, সঙ্খ, শাঁক, উলুধনি বন্ধ রাখা হয়। মসজিদে নামাজ নামাজে আসা মুসুল্লিদের জামাতের সাথে নামাজ পড়তে কোন ব্যঘাত সৃষ্টি না হয়। এভাবে দুই শত বছর ধরে চলে আসছে। মাগরিবের নামাজের জামাত শেষ হতেই শুরু হয়ে যায় মন্দিরে পুজা। কালীবাড়ি মসজিদে নামাজ আদায় করা জনৈক মুসল্লি জাকির মিয়া জানান, সন্ধ্যায় মন্দিরে ধূপকাঠি ও মসজিদে আগরবাতির সুঘ্রাণ মানুষকে মুগ্ধ করে। ধর্মীয় সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত এই শহরকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। বিশ^ দরবারে পরিচয় পেয়েছে ধর্মীয় সম্প্রীতির শহর হিসেবে। যুগ যুগ ধরে পৃথক দুটি ধর্মীয় উপাসনালয় নিয়ে কোন ধরণের অপ্রীতিকর পরিস্থিতি হয়নি। কোন কোন সময় দেশের নানা স্থানে হিন্দু – মুসলিমকে নিয়ে দাঙ্গা হাঙ্গামা সৃষ্টির পায়তারা হয়। তার আগুনের উত্তাপ এখানে স্পশ করতে পারেনি। এটাই এই শহরের বৈশিষ্ট। ধর্মীয় সম্প্রীতির এমন উজ্জ্বল নিদর্শন দেখতে জেলা শহরের কালীবাড়ী পুরান বাজার জামে মসজিদ ও কালীবাড়ী কেন্দ্রীয় মন্দিরে এসে ছিলেন মার্কিণ রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা ( ২০১৩ সালে এসেছিল)। ২০২২ সালে নেপালেরনেপালের ডিপুটি হাই কমিশনার শ্রী কুমার রাই দুর্গা পুজায় এখানে এসেছিলেন।
লালমনিরহাট শহর দক্ষিণ এশিয়ার প্রবেশদ্বার-
ঐতিহাসিকদের মতে ১৮৩৬ সালে কালী মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই সময় অবিভক্ত বাংলার (ভারত বর্ষের) বাণিজ্যিক প্রাণকেন্দ্র ছিল লালমনিরহাট শহরে কালীবাড়ী পুরান বাজার। এখানে হিন্দু মারওয়ারি ব্যবসায়ি গণের নিয়ন্ত্রণে ছিল ব্যবসা বাণিজ্য। ছিল হাবিব সুগন্ধি সাবান তৈরির কারখানা। ছিল অটো রাইচ মিল। ছিল সোযাবিন তেল পরিশোধনের কারখানা। ছিল হাবিব ব্যাংকের শাখা। লালমনিরহাট শহরের রেলওয়ে ষ্টেশনটি জংশন। এখানে ট্রেন যোগে নেপাল, কুচবিহার, দারজিলিং, করাচিসহ ভারত বর্ষের যেকোন জায়গায় যাওয়া যেত। ছিল নদী বন্দর মোগলহাট , নদী বন্দর তিস্তা । লালমনিরহাট শহরের ঐতিহ্য এতাটাই পুরোন যে, এখানে ৬৯’র হিজরীতে একটি মসজিদ নির্মাণ হয়ে ছিল। যাহা বাংলার মুসলিম ধর্মের প্রচার ও আর্বিভাবের ইতিহাস কে নতুন করে ভাবনায় ফেলেছে। মসজিদটির ধ্বংস্তপ এখনো অক্ষত রয়েছে। এই ধ্বংসস্তপের স্মৃতি চিহ্নি সংরক্ষণ করে সেখানে নতুন আধুনিক নির্মাণশৈলির মসজিদ নির্মাণ হয়েছে। বৃটিশ ভারতের সেই সময় দক্ষিণ এশিয়ার স্বর্ণদ্বার বলা হতো লালমনিরহাট শহর কে। হিন্দু মারওয়ারি গণ কালী প্রতীমার ভক্ত ছিলেন। বাঙ্গালি হিন্দুরা ছিল দূর্গা প্রতীমার ভক্ত। তারা এখানে কালিমন্দির স্থাপন করে প্রত্যহ পুজা অর্চনা করে আসছিল। পুরেহিত পরিবারের থাকা খাওয়ার সু ব্যবস্থা করে ছিল মন্দিরের পাশে। যাহা এখনো পুরোহিত পরিবার ব্যবহার করছে। সেই মারওয়ারি ব্যবসায়িদের সাথে পাইকারি পণ্য কিনতে দেশের দুরদুরান্ত হতে মুসলিম পাইকার আসতেন। তাদের মধ্যে অনেকে নামাজি ছিলেন। সেই নামাজিদের জন্য মন্দিরের পাশে হিন্দু ব্যবসায়িরা ওযাক্তি মসজিদ নির্মাণ করে দেয়। এটা ছিল তাদের উদারতার পরিচয়। সেই হতে শুরু। চলে আসছে মসজিদ – মন্দিরে উপাসনা। প্রতিবছর দূর্গাপুজার আগে মসজিদ কমিটি ও মন্দির কমিটি এবং পূজা উদযাপন কমিটি বৈঠক করে নেয়। সুষ্ঠু সন্দর ভাবে পুজা পরিচালনা করতে। দুই শত বছরে কোন দিন ধর্মীয় কোন বিষয় নিয়ে অপ্রীতিকর কোনো ঘটনা ঘটেনি। কেউ কখনো শুনেনি। পুুরান বাজার জামে মসজিদের ইমাম মোহাম্মদ আলাউদ্দিন জানান, ঐতিহ্যবাহী পুরান বাজার মসজিদ ও মন্দির এক সাথে। মসজিদের আগে মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ইসলাম ধর্মের কোথাও নেই মসজিদ মন্দির একসাথে করা যাবে না। ধর্ম যার যার তার তার। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেছেন। প্রত্যেক জাতির ধর্ম পালনে সহায়তা করতে মুসলিম কে অনুপ্রাণিত করেছেন। কারও ধর্মে বাধা দেয়া ইসলামে নিষিদ্ধ। ইসলাম ধর্ম কতটা উদার তার জ¦লন্ত দৃষ্টান্ত এই মসজিদ – মন্দির। এটা দুইটি ধর্মের মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধন কতটা অটুট তার অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। কেন্দ্রীয় কালীবাড়ী মন্দিরের সভাপতি ও প্রধান পুরোহিত শংকর চক্রবর্তী জানান, ১৮৩৬ সালে কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর এই এলাকার নামকরণ মানুষের মুখে মুখে পরিবর্তন হয়ে যায়। ব্যবসা – বাণিজ্যের প্রাণ কেন্দ্র হয়ে যায় কালীবাড়ী পুরান বাজার। বংশ পরমপরায় মন্দিরের খেদমত করে আসছি। কোনদিন সামান্য বিশৃঙ্খলাও হয়নি। কখনো নিজেকে সামান্য নিরাপত্তাহীন মনে হয়নি। এই শহর ধর্মীয় সম্প্রীতির শহর। জন্মের পর থেকে এভাবে চলতে দেখছি। ২০২২ সালের ১১ অক্টোবর সন্ধ্যায় ঢাকাস্থ নেপাল দূতাবাসের ডেপুটি চিফ অব মিশন (উপপ্রধান মিশন) মি. কুমার রাই ও রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি দেবদাস ভট্টাচার্য্য মসজিদ – মন্দিরটি পরিদর্শন করেছে।

Discussion about this post