মেহেরপুর প্রতিনিধি : ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে গার্ড অব অনারের ভাস্কর্য ভাঙা হয়েছে। শেখ হাসিনার সরকারের পতনের খবর ছড়িয়ে পড়লে শতাধিক দুর্বৃত্ত হানা দেয় মেহেরপুরের মুজিবনগর স্মৃতি কমপ্লেক্সে। তারা মহান মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্যগুলো ভেঙে ফেলে। ৫ আগস্ট বিকেল পাঁচটায় সেখানে একরকম তাণ্ডব পরিচালিত হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গত ৫ আগস্ট শনিবার বিকেল পাঁচটার দিকে শতাধিক যুবক রড, বাঁশ ও হাতুড়ি নিয়ে স্মৃতি কমপ্লেক্সে প্রবেশ করে। এবং তারা কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে মুজিবনগর কমপ্লেক্সে ভাঙ্গচুর তান্ডব চালায় । প্রথম তারা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যটির মাথা ভেঙে গুঁড়া করে ফেলে। একই সময়ে এলোপাতাড়িভাবে আঘাত করে ‘১৭ এপ্রিলের গার্ড অব অনার’ ভাস্কর্যটিতে। আরও একটি দল ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানের আত্মসমর্থনের ভাস্কর্যগুলোতে আঘাত করে। তবে সেখানে খুব বেশি ভাঙচুর করতে পারেনি তারা। পরে কমপ্লেক্সের মধ্যে দেশের মানচিত্রের আদলে তৈরি করা মুক্তিযুদ্ধের ১১টি সেক্টরে যুদ্ধের বর্ণনা সংবলিত ছোট ভাস্কর্যগুলো ভেঙে আশপাশে ছুড়ে ফেলে। আরও একটি দল শহীদ স্মৃতিসৌধের প্রধান ফটকটি ভেঙে নিয়ে যায়।
মুজিবনগর কমপ্লেক্সের দায়িত্বে থাকা আনসার সদস্য হুমায়ূন আহমেদ বলেন, ছোট—বড় ৬০০টি ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা হয়েছে। পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণ ছিল ভাস্কর্যগুলো। প্রতিদিন কয়েক হাজার দর্শনার্থী এখানে আসতেন। কমপ্লেক্সের সব ভাস্কর্য ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। কমপ্লেক্সজুড়ে চালিয়েছে লুটপাট।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে তর্জনী উঁচিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণের ভাস্কর্যটি ভাঙচুর করেছে দুর্বৃত্তরা।
মুজিবনগর কমপ্লেক্সের দায়িত্বরত টুরিস্ট পুলিশের সদস্য আবজাল শেখ বলেন, প্রথমে বিকেল পাঁচটার দিকে শতাধিক যুবক কমপ্লেক্সে শুধু বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙচুর করে চলে যায়। পরে রাতের দিকে তারা আবার আসে। কয়েক দফায় রাত ১২টা পর্যন্ত সেখানে তারা ভাঙচুর চালায়। সব শেষে আনসার ক্যাম্পে এসে আক্রমণ করে অফিস ভাঙচুর করে এবং কন্ট্রোল রুম থেকে সিসিটিভি ক্যামেরার হার্ডডিস্কটি খুলে নিয়ে যায়।
মুজিবনগর আম্রকাননের অস্থায়ী চায়ের দোকানি তামিম হোসেন বলেন, যখন দুর্বৃত্তরা কমপ্লেক্সে প্রবেশ করে, তখন আম্রকাননের নিচে থাকা চায়ের দোকানিরা পালিয়ে যান। পুলিশ ও আনসার সদস্যরা নিজেদের জীবন বাঁচাতে পালিয়ে যান। এই সুযোগে দুর্বৃত্তরা ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। শহীদ স্মৃতিসৌধের মূল গেটটি ছিল স্টিলের। সেটিও তারা খুলে নিয়ে যায়।
১৯৭১ সালে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বর গণহত্যার ভাস্কর্য ভাঙা হয়েছে।
মুজিবনগর স্মৃতি কমপ্লেক্সে স্থাপিত আনসার ক্যাম্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সুবেদার রবিউল ইসলাম বলেন, যখন দুর্বৃত্তরা এখানে হামলা শুরু করে, তখন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মুঠোফোনে নির্দেশনা চাওয়া হয়েছিল। তিনি কোনো নির্দেশনা দিতে পারেননি। এ কারণে আনসার সদস্যরা নিজেদের জীবন ও অস্ত্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যারাকে অবস্থান নেন।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, দেশের পরিস্থিতি অনুকুলে না থাকায় বেশ কয়েক দিন মুজিবনগর কমপ্লেক্সের মূল ফটকে কোনো নিরাপত্তাকর্মী ছিলনা। এখন স্বাভাবিক হওয়াই নিরাপত্তা আগের মতো মোতায়েন আছেন। দর্শনার্থীদের পরিচয় নিশ্চিত হয়েই সেখানে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে । মূল ফটক থেকে দুটি সড়ক গেছে। সোজা সড়কটি শহীদ স্মৃতিসৌধে গেছে। বাঁ দিকের সড়কটি গেছে স্মৃতি কমপ্লেক্সে। ওই সড়কে রয়েছে পর্যটন মোটেল, মসজিদ ও রাষ্ট্রীয় অতিথিদের বাংলো। সেগুলো পেরিয়ে স্মৃতি কমপ্লেক্স। কমপ্লেক্সের সামনে সারি সারি ভাস্কর্য, যেগুলো মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ ভাস্কর্য হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। সেখানে সব ভাস্কর্য কমবেশি ভাঙচুর করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যটির মাথা ভেঙে ফেলা হয়েছে। তাজউদ্দীন আহমদের ভাস্কর্যটিকে আঘাত করা হয়েছে। গার্ড অব অনারের ভাস্কর্যগুলোতে এলোপাতাড়ি আঘাত করা হয়েছে। ভাস্কর্যগুলো ভেঙে পড়ে আছে। চেনার উপায় নেই সেগুলো। বাংলাদেশের মানচিত্রের ওপরে নির্মিত মুক্তিযুদ্ধকালীন ১১টি সেক্টরের আদলে তৈরি ছোট ভাস্কর্যগুলো একেবারে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কমপ্লেক্সের পেছনে জয় বাংলা তোরণের ‘জয় বাংলা’ লেখাটি খুলে নিয়ে গেছে দুর্বৃত্তরা।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানের আত্মসমর্থনের ভাস্কর্যের বিভিন্ন জায়গায় আঘাত করা হয়েছে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বর গণহত্যা চালায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার গঠনের লক্ষ্যে ১৭ এপ্রিল আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতারা মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় সমবেত হন। বৈদ্যনাথতলা ছিল মূলত একটি আমবাগান। পরে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার গঠনের পর এটির নাম পরিবর্তন করে মুজিবনগর রাখা হয়। অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করার জন্য গঠিত সংগ্রাম কমিটি, প্রতিবেশী দেশ ভারতের নিরাপত্তা বাহিনীর সহযোগিতায় শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে দেশি—বিদেশি সাংবাদিকেরা উপস্থিত ছিলেন। সে কারণে বাঙালি জাতির জন্য মুজিবনগর আম্রকানন অতি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক স্থান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপরাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে মুজিবনগর সরকার গঠন করা হয়। এম এ জি ওসমানীকে সরকারের প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করা হয়। মুজিবনগরে তৎকালীন সাবডিভিশনাল পুলিশ কর্মকর্তা মাহবুব উদ্দিন আহমদ, বীর বিক্রমের নেতৃত্বে ১২ জন আনসার সদস্য বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে গার্ড অব অনার প্রদান করেন। এই অস্থায়ী সরকারের নেতৃত্বে ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জিত হয়।
দেশের মানচিত্রের আদলে তৈরি করা মুক্তিযুদ্ধের ১১টি সেক্টরে যুদ্ধের বর্ণনা সংবলিত ছোট ভাস্কর্যগুলো সব ভাঙা হয়েছে। ১৯৮৭ সালের ১৭ এপ্রিল উদ্বোধন করা হয় মুজিবনগর স্মৃতিসৌধের। ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এ স্থানকে আরও তাৎপর্যপূর্ণ করে তুলতে ১৯৯৬ সালে ওই স্থানে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি কমপ্লেক্স স্থাপন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। স্মৃতি কমপ্লেক্সে একটি মানচিত্রের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন সেক্টরকে দেখানো হয়েছিল। কমপ্লেক্সে মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলির স্মারক ম্যুরাল স্থাপন করা হয়েছিল। সার্বিকভাবে মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ, মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি কমপ্লেক্স, ঐতিহাসিক আম্রকানন, ঐতিহাসিক ছয় দফাকে রূপকের মাধ্যমে উপস্থাপনকারী ছয় ধাপের গোলাপ বাগান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন ছিল।
জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আহসান খান বলেন, ‘৫ আগস্ট পুলিশ সদস্যরা চরম নিরাপত্তাহীনতায় ছিলেন। এই সুযোগে দুর্বৃত্তরা ঐতিহাসিক মুজিবনগরে হামলা চালায়। তবে যারা এই ভাঙ্গচুরের সাথে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
খালিদ সাইফুল, দৈনিক দেশতথ্য, ১৫ আগষ্ট ২০২৪

Discussion about this post