সিলেট প্রতিনিধি :বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে যেসব মেগা প্রকল্পের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, তার একটি সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের উন্নয়নকাজ।
২০২০ সালে শুরু হওয়া প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২২ সালে। কিন্তু নকশায় ত্রুটি থাকার কারণে কয়েক দফায় নকশায় পরিবর্তন করতে হয়। এতে মূল বাজেটের চেয়ে খরচ বেড়ে গেছে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা। এতে ক্ষুব্ধ হয় বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। এ নিয়ে গঠিত হয় তদন্ত কমিটি। কমিটির প্রতিবেদনে উঠে এসেছে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হাবিবুর রহমানসহ কয়েকজনের গাফিলতির বিষয়টি। তবে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
২০১৮ সালের ৭ নভেম্বর ২ হাজার ১১৬ কোটি টাকায় প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়। প্রকল্পের আওতায় আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ফুয়েলিং সিস্টেম স্থাপন করার কথা রয়েছে। পাশাপাশি আছে পূর্ণাঙ্গ আন্তর্জাতিক মানের টার্মিনাল ভবন নির্মাণ, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য পৃথক সাব-স্টেশন স্থাপন, নিরাপত্তার জন্য ফায়ার ফাইটিং সিস্টেম, যাত্রীদের জন্য এস্কেলেটরসহ আরও কিছু উন্নয়নমূলক কাজ।
এই মেগা প্রকল্পটির কাজ শুরু হয় ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে। পরে সময় বাড়িয়ে কাজ শেষ করার কথা ছিল ২০২৩ সালের ২৭ মে। কিন্তু কাজ শুরু করতে গিয়ে ধরা পড়ে নকশার ত্রুটি।
ফলে নতুন করে গত বছর এই প্রকল্পের নকশা তৈরির জন্য সংশ্লিষ্ট পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে বলা হয়। এতে খরচ বেড়ে দাঁড়ায় ২ হাজার ৯১৬ কোটি টাকা। এখন পর্যন্ত কাজ শেষ হয়েছে মাত্র ২২ শতাংশ। আবারও সময় বাড়িয়ে ২০২৫ সালে নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু ওই সময়েও প্রকল্পের কাজ শেষ হবে কি না, তা নিয়ে দেখা দিয়েছে সংশয়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, তিন বছর ধরে খুঁড়িয়ে চলছে প্রকল্পের কাজ। ২২ শতাংশ কাজ শেষ না হতেই ব্যয় বেড়েছে ৪১ শতাংশ। নকশা ত্রুটির রহস্য উদ্ঘাটন করতে গত বছরের আগস্ট মাসে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির প্রধান করা হয় বেবিচক সদস্য (অর্থ) মো. আজিজ তাহের খানকে।
বেবিচক সদস্য (অর্থ) আজিজ তাহের খান বদলি হওয়ায় পর বর্তমান সদস্য (অর্থ) এসএম লাবলুর রহমান দায়িত্ব পান।
প্রতিবেদনে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (বহিঃবিমানবন্দর) তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর (প্ল্যানিং অ্যান্ড কিউএস) নামসহ অভিযুক্ত করে কমিটির প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়। প্রতিবেদনে কাদের দায়িত্ব অবহেলা, তাও উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনটি মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর কথা থাকলেও তা করা হয়নি।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, প্রকল্পের কাজ বিলম্ব করায় ঠিকাদারের কিছু বিল স্থগিত করা হয়েছে। তা ছাড়া ঠিকাদারের অন্যান্য কাজের সঙ্গে সমন্বয় করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ইউটিলিটি কমপ্লেক্সের জন্য নির্ধারিত জায়গাটি ইতিমধ্যে একটি বাহিনীর কাছ থেকে দখলমুক্ত করা হলেও, বর্তমানে তা স্থানীয় জনগণের দখলে রাখা হয়েছে। জায়গাটি উদ্ধার করতে সিএএবি ও মন্ত্রণালয় কাজ করবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়- মন্ত্রণালয় বলেছে, প্রকল্পের ব্যয় যাতে বৃদ্ধি না পায়, সেদিকে নজর দিতে হবে। যদিও অ্যাপ্রোন এরিয়ায় ব্যয় ট্যাক্সিওয়ের বৃদ্ধির কারণে ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা বাড়বে।
সিএএবির যেসব কর্মকর্তা ডিজাইন বুঝে নেওয়ার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেননি, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে মন্ত্রণালয়কে অবহিত করতে হবে। চুক্তির শর্তগুলো যথাযথভাবে পালন না করায় ঠিকাদারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
বেবিচক সূত্র জানায়, গত ১৫ বছর বেবিচকের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা প্রকৌশলী হাবিবুর রহমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) আছে নানা অভিযোগ। ইতিমধ্যে তার বিরুদ্ধে আসা কিছু অভিযোগ যাচাই করতে অনুসন্ধান চালাচ্ছে সংস্থাটি। ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নকশায় ত্রুটির সঙ্গে তিনি জড়িত থাকলেও নেওয়া হয়নি কোনো ব্যবস্থা। কিন্তু রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হয়ে গেলে তিনি হয়ে গেছেন আওয়ামী লীগের বিরোধী পক্ষের লোক। এখন তিনি হতে চাচ্ছেন বেবিচকের প্রধান প্রকৌশলী। আর এজন্য তিনি নানা মহলে তদবিরও চালাচ্ছেন।
অভিযোগ উঠেছে, দেশের বিভিন্ন বিমানবন্দরের উন্নয়নকাজে ঠিকাদারদের ফাইল আটকে রেখে প্রকৌশলী হাবিবুর রহমান হাতিয়ে নিতেন অর্থ। অনিয়মের কারণে একাধিকবার শাস্তিমূলক বদলিও হয়েছেন। দুর্নীতি ও অদক্ষতার কারণে তাকে ফ্লাইট সেফটিতে বদলি করা হলেও, তার প্রভাব কমেনি এখনো। তার নিয়ন্ত্রণে দেশের সব কটি বিমানবন্দরের উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ। কোনো কাজ হয়েছে দ্রুত সময়ে। আবার কোনো কাজ হয়নি কয়েক বছরেও। শাহজালাল বিমানবন্দরের টার্মিনালে বিনা টেন্ডারে ১৬ কোটি টাকার কাজ এবং উন্নয়ন-সংক্রান্ত মেগা প্রকল্পে ব্যাপক অনিয়মের সঙ্গে প্রকৌশলী হাবিবের সম্পৃক্ততা ছিল।
দাপ্তরিক তদন্তে এর প্রমাণও পেয়েছে বেবিচক। তারপরও তার বিরুদ্ধে নেওয়া হয়নি কোনো ব্যবস্থা। কক্সবাজার বিমানবন্দর উন্নয়নকাজের পিডি থাকাকালে তার বিরুদ্ধে দরপত্রে দুর্নীতির প্রমাণ পায় মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটি। পরে তাকে পিডি পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
সিভিল সার্কেল-১-এ থাকাকালে অযোগ্যতা, দুর্নীতি ও খামখেয়ালির অভিযোগ প্রমাণ হওয়ায় দুদক থেকে বেবিচকের কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিভাগে দায়িত্ব না দিতে বলা হয় হাবিবুর রহমানকে।
কিন্তু তারপরও নির্বাহী প্রকৌশলী থেকে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী পদে পদোন্নতি পাওয়া-ই শুধু নয়, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে হাজার কোটি টাকার বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্পের দায়িত্ব পান তিনি। সেগুলো হলো খানজাহান আলী বিমানবন্দর উন্নয়ন, সৈয়দপুর বিমানবন্দর উন্নয়ন, ওসমানী বিমানবন্দরের রানওয়ে ওভারলেকরণ ও নতুন টার্মিনাল ভবন নির্মাণ, চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দরের রানওয়ে ওভারলেকরণ এবং প্যারালাল টেক্সিওয়ে নির্মাণ, রানওয়ে সম্প্রসারণ ও বিদ্যমান টার্মিনালের সম্প্রসারণ নবরূপায়ণ এবং কক্সবাজার বিমানবন্দরের টার্মিনাল ভবন নির্মাণ ও রানওয়ে সম্প্রসারণ।
নাম প্রকাশ না করে বেবিচকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হাবিবুর রহমান খুব চালাক প্রকৃতির। গত সরকারের সময় তিনি সবচেয়ে লাভবান হওয়ার পরও বর্তমানে আওয়ামী লীগের বদনাম করে সংস্থাটির প্রধান প্রকৌশলী হতে চাচ্ছেন। তিনি বিভিন্ন মহলে নানাভাবে তদবির করছেন। তার গাফিলতির কারণে ওসমানী বিমানবন্দরে সরকারের ৮০০ কোটি টাকা ব্যয় বেড়েছে। এ ঘটনায় আরও কয়েকজন কর্মকর্তা জড়িত।
তিনি আরও বলেন, ওসমানী বিমানবন্দরের চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বেইজিং আরবান কনস্ট্রাকশন গ্রুপ (বিইউসিজি) কাজটি করছে। ইঞ্জিনিয়ারিং শাখার সিভিল ডিভিশন-৩-এর অধীনে কাজ সুপারভিশন করা হচ্ছে। এই ডিভিশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের গাফিলতিতেই প্রকল্পটি যথাসময়ে বাস্তবায়ন হওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কনস্ট্রাকশন গ্রুপের সঙ্গে আমরা কয়েক দফা বৈঠক করেছি। কিছুদিন আগে বেবিচক চেয়ারম্যানসহ অন্য কর্মকর্তারা সিলেট বিমানবন্দর পরিদর্শন করেছেন।’
অন্য এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তার কারণে ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নকশার ত্রুটি থাকলে উন্নয়নের কাজ স্থবির হয়ে পড়ে।
এহ/16/10/24/ দেশ তথ্য
![প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন](http://dailydeshtottoh.com/wp-content/plugins/wp-print/images/printer_famfamfam.gif)
Discussion about this post