শেখ দীন মাহমুদ,পাইকগাছা(খুলনা) সংবাদদাতা ॥ সতত, হে নদ তুমি পড় মোর মনে
সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে। মাইকেল মধুসূদন দত্ত’র বিখ্যাত তপোতাক্ষ নদ কবিতার পংক্তিমালা
কিংবা বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ’’এ-কূল ভাঙে ও-কূল গড়ে এই তো নদীর খেলা।
—– শেষে শ্মশান ঘাটে গিয়ে দেখে সবাই মাটির ঢেলা
এই তো বিধির খেলা রে ভাই ভব নদীর খেলা।
নদীর প্রতি অসীম ভালবাসা, নদীর প্রতি অজ¯্র আবেগের গুচ্ছমালায় কবি সাহিত্যিকরা অসংখ্য কবিতা,গান কিংবা সাহিত্য রচনা করে গেলেও সেই নদীর প্রতি ভাবাবেগে আজ যেন চিঁড় ধরেছে। নদী শাষন-শোষনে একে একে হারিয়ে যেতে বসেছে নদী মাতৃক বাংলাদেশের নদীমালা। যার ধারাবাহিকতায় বেশ আগেই যুক্ত হয়েছে ঐতিহ্যবাহী কপোতাক্ষ নদ।
প্রথমে আগ্রাসী কপোতাক্ষের ভাঙ্গন ও পরে নাব্যতা হ্রাসে নদী তীরে বসবাসকারী লাখ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকার উপর পড়ে বিরুপ প্রভাব। এরপর গণদাবির প্রেক্ষিতে সরকার ২৬২ কোটি টাকা ব্যায়ে কপোতাক্ষ খনন করে। নদ ফিরে পায় তার হারানো যৌবন। তবে ফের কপোতাক্ষের অব্যাহত ভাঙ্গনে নতুন করে উদ্বাস্তু হচ্ছে নদী তীরে বসবাসকারী বহু পরিবার। হুমকির মুখে পড়েছে সরকারের বহু উন্নয়ন প্রকল্প। চরম ঝুঁকিতে রয়েছে মুজিব শত বর্ষে গৃহহীন ও ভূমিহীন বহু পরিবারের পুণর্বাসনে গড়া আবাসন প্রকল্পসহ হাট-বাজার, ধর্মীয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। অথচ এদিকে নুন্যতম খেয়াল নেই সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কারো।
ইতোমধ্যে কপোতাক্ষের পাইকগাছার কপিলমুনি ইউনিয়নের কাশিমনগর হাট-বাজার, মসজিদ, দোকান-পাঠ ও ৩ কোটি ২৫ লক্ষ টাকা ব্যায়ে দেশব্যাপী গ্রামীণ বাজার অবকাঠামো উন্নয়ন (সি আর এম আই ডিপি) প্রকল্পের নির্মাণাধীন চার তলা ফাউন্ডেশন) কাশিমনগর হাট দুই তলা বিশিষ্ট গ্রামীণ মার্কেট বিল্ডিং, মুজিব শত বর্ষের ভূমিহীন ও গৃহহীনদের আবাসন প্রকল্প চরম ঝুঁকিতে রয়েছে। কপোতাক্ষ পাড়ের বনায়ন প্রকল্পের সিংহভাগ গাছ ইতোমধ্যে গিলে খেয়েছে আগ্রাসী কপোতাক্ষ। নতুন মাছ কাটা থেকে শুরু করে ঐতিহ্যবাহী কালীবাড়ী ঘাট, হাট-বাজার, গোলাবাটিসহ রাড়ুলী ইউনিয়নে কপোতাক্ষ নদের ভাঙ্গন ফের ব্যাপক আকার ধারণ করছে। ইতোমধ্যে সেখানকার জেলে পল্লীর অন্তত ৭০ টি পরিবার ভাঙ্গনের মুখে অন্যত্র চলে গেছে। নদীগর্ভে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে আরো ২০ টি পরিবারের বসত ভিটা। নদী গর্ভে বিলীণ হয়ে গেছে সেখানকার চলাচলের একমাত্র রাস্তার দুই তৃতীয়াংশ। জোয়ারের পানি ঠেকানোর জন্যও সেখানে নেই কোন বাঁধ। ফলে প্রতি অমাবশ্যা-পূর্নিমায় জোয়ারে পানি বাড়লে এলাকায় লবণ পানিতে প্লাবিত হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে গাছপালা, ফসলি জমি ও কাঁচা-পাকা ঘর-বাড়ি। এছাড়া ভয়াবহ ভাঙ্গন শুরু হয়েছে বোয়ালিয়া জেলে পাড়া, রামনাথপুরসহ কপোতাক্ষের বিভিন্ন এলাকা।
এব্যাপারে কথা হয় কপিলমুনির কাশিমনগর জেলে পল্লীর বাসিন্দা উত্তম বিশ্বাসের সাথে। তিনি জানান, এক শ’ বছরেরও বেশী সময় ধরে তারা সেখানে বসবাস করে আসছেন। তবে ইতোমধ্যে তাদেরসহ বহু পরিবারের মূল বসত-ভিটা গিলে খেয়েছে আগ্রাসী কপোতাক্ষ। অনেকেই পেশা বদলে অন্যত্র চলে গেছে। উদ্বাস্তু হয়েছে অনেক পরিবার। রাড়–লীর জেলে পল্লীর বাসিন্দা ভূধর বিশ্বাস তার সাথে যোগ করে বলেন, আমার বাবা ও দাদুরা প্রায় ১শ’ বছর ধরে এখানে বসবাস করে আসছেন। নদীর কুলে ১শ’ থেকে দেড়শ বিঘা জমি ছিলো। যেখানে দেড় শ’রও বেশি পরিবারের বসবাস ছিল। তবে অব্যাহত ভাঙ্গনের মুখে সেখানকার ৭০ টিরও বেশি পরিবারের ঘর কেড়ে নিয়েছে আগ্রাসী কপোতাক্ষ। যাদের অনেকেই অন্যত্র জমি কিনে পুণর্বাসিত হয়েছে, কারো বা আশ্রয় হয়েছে রাস্তার পাশে কেউবা উঠেছে আশ্রয়ন প্রকল্পে।
একই এলাকার লিপিকা বিশ্বাস জানান, রাতে জোয়ারের সময় ভয়ে বাচ্চাদের নিয়ে বসে থাকেন ভাটার অপেক্ষায়। এরপর ভাটা আসলে ঘুমাতে যান তারা।
রাড়ুলীর ৩ নং ওয়ার্ডের ফরিদা বেগম (৫৫) বলছিলেন তাদের এখনকার বাড়ি ছাড়া নদীর অবস্থান ছিল প্রায় আঁধা কিলোমিটার দুরে। জেলে পল্লীর পরে ছিলো তাদের বসবাস। তারা ছাড়াও প্রায় ৪০ টি পরিবাবারের বসবাস ছিল সেখানে। তবে কপোতাক্ষের ক্রমশ আগ্রাসন জেলে পল্লীর পর এখন তারেকেও নদীর কিনারায় নিয়ে ঠেকিয়েছে। যেকোন সময় তাদের ঘর টুকুও নিমজ্জিত হতে পারে ভাঙ্গনে।
একই এলাকার বারিক মোড়ল বলেন, ভাঙ্গনের মুখে তিনি অন্তত তিনবার ঘর পরিবর্তন করেছেন। তার পরেও রান্না ও কাঠের ঘর টুকুও নদীতে চলে গেছে। বাকি ঘরখানিও যেকোন সময় চলে যেতে পারে নদী গর্ভে। সঙ্গতি না থাকায় অন্যত্র জমি কিনে বসবাসেরও উপায় নেই অন্যদিকে সরকারও নদী ভাঙ্গন রোধে কার্যত কোন পদক্ষেপ নিচ্ছেননা। এমন পরিস্থিতিতে তাদের দাবি, নদীর অপর পাড়ে গড়ে ওঠা চরে বসতির সরকারি অনুমতি।
রাড়ুলীর ৩ নং ওয়ার্ড সদস্য মোঃ ইলিয়াস হোসেন বলেন, জোয়ারের পানি ঠেকাতে তারা নিজস্ব অর্থায়নে ২ লক্ষ টাকা ব্যায়ে বাঁধ নির্মাণ করে অন্তত মাঠের ধান গুলো বাঁচিয়েছেন। তবে অতিরিক্ত পানি বাড়লে ঘর-বাড়ি ও ফসলাদি বাঁচানো সম্ভব হবে না বলেও আশংকা তার।
রাড়ুলীর ইউপি চেয়ারম্যান সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আবুল কালাম আজাদ বলেন, গত প্রায় ৪০ বছর ধরে সেখানে কপোতাক্ষের ভাঙ্গন শুরু হলেও সরকার ভাঙ্গনরোধে তেমন কোন বরাদ্দ দেয়নি। তিনি উপজেলা আইন শৃঙ্খলা ও সমন্বয় সভায় একাধিকবার বিষয়টি উত্থাপন করলেও কোন কাজ হয়নি। বিষয়টি নিয়ে তিনি স্থানীয় সংসদ সদস্যর সাথে কথা বলবেন বলেও তিনি জানান।
কাশিমনগর বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় ইউপি সদস্য শেখ রবিউল ইসলাম বলেন, কপোতাক্ষের ভয়াবহ ভাঙ্গনে নিয়ন্ত্রণ বাঁধের বনাপ্রকল্প, হাট-বাজারের সিংহ ভাগ ইতোমধ্যে কপোতাক্ষে বিলীণ হয়েছে। নতুন করে ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে স্থানীয় আশ্রয়ন প্রকল্প, মসজিদ, শ্মশানঘাট, নির্মাণাধীন গ্রামীণ মার্কেটসহ নদী তীরের বহু বসতবাড়ি। এব্যাপারে তিনি জরুরী ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-সহকরী প্রকৌশলী রাজু আহম্মদ বলেন, তাদের উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যে ভাঙ্গন কবলিত রাড়–লী, বোয়ালিয়া, রামনাথপুরসহ বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করে জরিপকাজ সম্পন্ন করে সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। বরাদ্দ হলেই কার্যক্রম শুরু হবে।
কপোতাক্ষ অববাহিকার সাধারণ মানুষের দু:খ-দূর্দশা ও যাপিত জীবনের দু:খ গাথা নিয়ে বিভিন্ন সময় ভিন্ন ভিন্ন এনজিও’র ছায়াতলে নানামুখী আন্দোলন হয়েছে। নির্মিত হয়েছে স্বল্প দৈর্ঘ্য বাংলা চলচ্চিত্র কপোতাক্ষের কান্না। স্বাধিনতা পরবর্তী বার বার সরকারের পট পরিবর্তন হলেও কার্যত কপোতাক্ষ অববাহিকার মানুষ কিংবা কপোতাক্ষের ভাগ্যোন্নয়নে দৃশ্যত কাজ করেনি কেউ। এব্যাপারে কপোতাক্ষের ভাঙ্গনরোধে জনপদের সাধারণ মানুষ সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জরুরী হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

Discussion about this post