চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলা আয়তনে কম হলেও সেখানে দিন দিন পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মিল কারখানা ও বিভিন্ন ফ্যাক্টরী। ফলে নিয়মনীতি ভেঙে নগরায়নের ফলে কমছে কৃষিজমি। গড়ে উঠছে বহুতল ভবন। এসবই হচ্ছে প্রশাসনের চোখের সামনে। নেই তাঁদের নিয়মনীতি আর তদারকি। এতে দেশের আইন-আদালত ও পরিবেশ অধিদপ্তরকে উপেক্ষা করার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
কর্ণফুলীতে একের পর এক অপরিকল্পিতভাবে ফ্যাক্টরী, মিল-কারখানা, ইটভাটা ও বসতবাড়ি নির্মাণের কারণে গত দুই দশকে উপজেলায় বহুঅংশে কমেছে কৃষিজমি। এতে কংক্রিট কিংবা ইট পাথরের দালানে গ্রাস করছে উবর্র শক্তির ফসলি ধানি জমি এমনটাই জানালেন কৃষিতে পদক পাওয়া আলহাজ্ব মোহাম্মদ হারুন চৌধুরী (নেভী)।
স্থানীয়রা জানান, অপরিকল্পিত বাড়িঘর নির্মাণ, নগরায়ণ, শিল্পপ্রতিষ্ঠান, ইটভাটা ও নদীভাঙনের ফলে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ কৃষি জমি নিশ্চিহ্ন হচ্ছে। অথচ বাড়িঘর ও মিলকারখানার ভবন নির্মাণে নকশার অনুমোদন নিতে হয়। এসব কিছুর তোয়াক্কা না করে। বড় বড় কোম্পানীর কাছে নগদ টাকার লোভে জমি বিক্রি করে বাস্তুহারা হচ্ছেন প্রান্তিক কৃষকরা। প্রতিনিয়ত লোকালয়ে তৈরি হচ্ছে ভবন।
ফলে পরিকল্পনাহীন নগরায়ণের ছোবলে বৈচিত্র্য হারাচ্ছে কর্ণফুলী। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করে জানিয়েছেন, বছরে যে পরিমাণ কৃষি জমি কমছে, তার অর্ধেকই যাচ্ছে অনু-উৎপাদনশীল খাতে। অপরিকল্পিত ব্যবহারের ফলে জমির উবর্রতা শক্তিও হারিয়ে যাচ্ছে। অথচ মিল কারখানা তৈরীতে রয়েছে সরকারী নানা নির্দেশনা। যা কর্ণফুলীতে কেউ না মানার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
সব কিছু ডিঙিয়ে শহরের পার্শ্ববর্তী উপজেলা হওয়ায় কর্ণফুলীতে যত্রতত্র গড়ে উঠছে নানা প্রকল্পসহ শিল্পপ্রতিষ্ঠান। সরজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, জনবসতিপূর্ণ এলাকায় পরিবেশের ছাড়পত্র কিংবা সরকার বিধি নিষেধ মেনে এসব শিল্পকারখানা গড়ে ওঠেছে কিনা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
উপজেলায় গড়ে উঠা এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে এস আলম সিআর কয়েল লিঃ শিকলবাহা, এস আলম স্টীল লিঃ, এস আলম ভেজিটেবল লিঃ, এস আলম সিমেন্ট লিঃ, চেমন ইস্পাত লিঃ, ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড, এস আলম ঢেউটিন লিঃ, মর্ডান পলি ইন্ডাস্ট্রিজ, মমতা টেক্সটাইল, শিকলবাহা ৬০ মেগাওয়াট বিদ্যু কেন্দ্র, বার্জমাউন্ট বিদ্যুৎ কেন্দ্র, এহসান স্ট্রিল মিল, এহসান সি রিসোর্স লিঃ, কর্ণফুলী শিপ বিল্ডার্স, এস আলম সুগার রিফাইনারি, এস আলম পাওয়ার প্ল্যান্ট, ফোর এইচ বেলামি টেক্সটাইল, ব্যাঞ্চমার্ক এপারেল গার্মেন্টস, গোল্ডেন সন লিঃ, ইছানগর ড্রাই ডগ, ডিভাইন টেক্সটাইল লিঃ, ডায়মন্ড সিমেন্ট লিঃ, মাসুদ এগ্রো ফিড লিঃ, এস আলম ওয়েল রিফাইনারী, কর্ণফুলী শিপ ইয়ার্ড, মোস্তফা ব্রিকস মিলস, পেট্রো কেমিকেল লিঃ, আবু মেরিন শিপ বিল্ডার্স, এসএ গ্রুপের তেল শোধানাগার, স্টার ফার্নেস ওয়েল, এফএইচ তেল রিফাইনারী ইন্ডাস্ট্রিজ, সী রিসোর্স কোম্পানী লিঃ, প্রিমিয়াম সিমেন্ট লিঃ, হাবিন বিন এলপি গ্যাস প্ল্যান্ট, আবুল খায়ের ক্যারিয়ার শিপিং ওয়ার্কশপ, ইছানগর ব্রিকস, ইন্ডাস্ট্রিজ পার্ক তেল শোধনাগারসহ দেড় শতাধিক ছোটবড় শিল্প প্রতিষ্ঠান।
এক উপজেলার পাঁচ ইউনিয়নের গ্রামে গ্রামে কৃষিজমিতেই গড়ে উঠছে শিল্পকারখানা। এতে পরিবেশেও মারাত্মক বিপর্যয় সৃষ্টি হচ্ছে। অপরদিকে, এসব শিল্পকারখানায় সমাজের একটা শ্রেণি লাভবান হলেও শিল্পদূষণে জনস্বাস্থ্য ও আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে বিরাট নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে চরপাথরঘাটা-ইছানগরের মানুষ সুস্থ্য বায়ু ও পানির নাগাল পাচ্ছে না বলা যায়।
নোঙ্গর এর পরিবেশকর্মী সুমন শামস বলেন, ‘আমরা কৃষিজমিতে শিল্পপ্রতিষ্ঠান চাই না। এসব শিল্পদূষণে যেসব ক্ষতি হয়েছে এর নিরপেক্ষ তদন্ত করে এলাবাসীকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া উচিত। না হয় অপরিকল্পিত নগরায়নে তীব্র পানি সংকট ও সুস্থ্য বায়ু সংকটে পড়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাবে।’
কর্ণফুলী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ফারুক চৌধুরী বলেন, কর্ণফুলী উপজেলায় বসবাসযোগ্য করার জন্য মাষ্টার প্ল্যানে হাত দেবো, অপরিকল্পিতভাবে মিল ইন্ডাষ্ট্রি বা বাড়ীঘর করতে সরকারী ভাবে নিষেধ রয়েছে। উপজেলা থেকে অনুমতি ছাড়া কোন স্থাপনা করা যাবে না। যদিও বিষয়টি অনেকের জানা নেই। এতে সকলের সহযোগিতা দরকার।’
কর্ণফুলী উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) শাহিনা সুলতানা বলেন, সবকিছু পরিকল্পনা অনুযায়ি গড়ে তোলা হলে গ্রামীণ অবকাঠামোগত উন্নয়ন টেকসই হয়। স্থানীয় সংসদ সদস্য ও ভূমিমন্ত্রীর দিক-নির্দেশনায় কর্ণফুলী উপজেলাকে একটি মডেল উপজেলায় রুপান্তর করার চেষ্টা চলছে। যদিও এজন্য সকলের আন্তরিকতা দরকার।’
আর জে//দৈনিক দেশতথ্য//জুন ৬,২০২২
প্রিন্ট করুন
Discussion about this post