Print Date & Time : 10 May 2025 Saturday 11:10 am

কুষ্টিয়ায় অবৈধ ইট ভাটার দৌড়াত্মে নতজানু প্রশাসন

এনামুল হক : কুষ্টিয়ায় দীর্ঘদিন ধরে প্রশাসনের সাথে অবৈধ ইট ভাটা মালিকদের চোর পুলিশের খেলায় সীমাহীন দৌড়াত্মে চরম বেপরোয়া হয়ে উঠার অভিযোগ উঠেছে।

শেষ পর্যন্ত তারা স্বয়ং প্রশাসনের বিরুদ্ধেই এসব ভাটা মালিকদের ফুঁসে উঠার একাধিক ঘটনা ঘটে চলেছে।

গত ২ ডিসেম্বর কুষ্টিয়ার দৌলতপুর ও মিরপুর উপজেলা এবং ৪ ডিসেম্বর কুমারখালী উপজেলায় পরিবেশ অধিদপ্তর ও প্রশাসনের সমন্বিত উদ্যোগে অবৈধ ইট ভাটা উচ্ছেদে পরিচালিত ভ্রাম্যমান আদালত হামলার শিকার হয়েছে।
ঘটনার সত্য নিশ্চিত করে পরিবেশ অধিদপ্তর কুষ্টিয়ার প্রধান কেমিষ্ট ও সহকারী পরিচালক হাবিবুর রহমান বাশার জানান,‘রীতিমতো সরকারী কাজে বাধাদানই নয়; নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেটসহ শতাধিক আইন শৃংখলা বাহিনীকেও তারা চ্যালেঞ্জ করেছে। এঘটনায় ইতোমধ্যে জড়িতদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরসহ আইনগত ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়েছে।’

কুষ্টিয়ার মিরপুরে ৪টি অবৈধ ইট ভাটায় অভিযান চালিয়ে পৃথক ভাবে প্রতিটি ভাটায় দেড় লাখ টাকা করে মোট ৬ লাখ টাকা জরিমানা করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর। এসময় ১টি ইট ভাটা গুড়িয়েও দেয়া হয়েছে বলে অভিযান সূত্রে নিশ্চিত করেছেন।
সোমবার দুপুরে মিরপুর উপজেলার টিপিআর ব্রিকস, এম আর ব্রিকস, এবি ব্রিকস এবং একে বি ব্রিকস নামের ভাটাগুলিতে এই অভিযান পরিচালিত হয়।
এসময় এএস এম ব্রিকস নামের ১টি অবৈধ ইটভাটা গুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। খুলনা বিভাগীয় পরিবেশ অধিদপ্তরের নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট ও সিনিয়র সচিব মমতাজ বেগমের নেতৃত্বে পরিচালিত এই ভ্রাম্যমান আদালতে জেলার আইন শৃংখলা বাহিনী ফায়ার সার্ভিস এবং পরিবেশ অধিদপ্তর কুষ্টিয়ার প্রধান কেমিষ্ট হাবিবুর রহমান বাশারসহ অন্যান্য কর্মকর্তাগণ উপস্থিত ছিলেন। তবে এদিন অভিযান পরিচালনার সময় ইট ভাটা মালিক ও শ্রমিকদের তীব্র বাঁধার মুখে পড়তে হয় পরিবেশ অধিদপ্তরের ভ্রাম্যমান আদালতকে। এমনকি হামলার উপক্রম বুঝতে পেরে দ্রুত অভিযান শেষ করে স্থান ত্যাগ করেন ওই অভিযানিক দলটি।

উল্লেখ্য কুষ্টিয়া জেলার ৬টি উপজেলায় বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত ভাবে ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন আইন লঙ্ঘন করে যত্রতত্র প্রায় ২শতাধিক অবেধ ইটভাটা গড়ে উঠেছে। এতে একদিকে জেলার তিন ফসলি উর্বরা কৃষি জমি ধ্বংস হচেছ অন্যদিকে দেদারসে গাছ কেটে কাট পুড়িয়ে গোটা পরিবেশকে বসবাসের অযোগ্য করে তোলায় তার প্রতিকার চেয়ে দীর্ঘদিন ধরেই জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরে লিখিত আবেদন করে আসছেন।

বিষয়টি গুরুত্ব বিবেচনায় জেলার আইন শৃংখলা সভায় একাধিক বার আলোচিত হয়। তারই প্রেক্ষিতে অবৈধ ইটভাটা উচ্ছেদে এই অভিযান পরিচালিত হয় বলে পরিবেশ অধিদপ্তর কুষ্টিয়া কার্যালয় সূত্রে জানায়।

অবৈধ ভাটা বন্ধের দাবি করে উচ্চ আদালতে রীটকারী দৌলতপুর উপজেলার হাবলু মোল্লা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, ‘ ‘গত ২ডিসেম্বর পরিবেশ অধিদপ্তর ইটভাটায় অভিযানের নামে যেটা করেছে সেটা নিছক লোক দেখানো। ওইসব ভাটা মালিকদের সাথে চুক্তিমতে সবাই মিলে দেড় কোটি টাকা দেয়ার কথা পরিবেশ অধিদপ্তরের লোকদের। সেই টাকা আদায়ের জন্যই এই ৪টি ভাটায় লোক দেখানো অভিযান চালিয়ে অন্যদেরও সতর্ক দিলো। তারা জানান দিচ্ছে আগামী দুই একদিনের মধ্যে সবাই মিলে নির্ধারিত ওই টাকা পরিশোধ না করলে আবার অভিযান চালানো হবে। তাছাড়া যে বিধি ল্ঘংনের দায়ে ওই ৪টি ভাটাকে দেড় লাখ টাকা করে জরিমানা ধরেছে এটা তাদের জন্য কোন পানিসমেন্টই না’।

সোমবারের অভিযানে মিরপুর উপজেলার মশান এলাকায় জরিমানার শিকার ভাটা মালিক শাহিন আলী তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘দেখুন আমাদের মধ্যে শকুনের গোস্ত শকুন খাই। আমাদের মতোই কোন ভাটা মালিক ইনটেনশনালি পরিবেশ অধিদপ্তরকে লেলিয়ে দিয়ে বেছে বেছে এই ৪টি ভাটাই জরিমানা এবং একটি ভাটা ডেসট্রয় করে দিয়েছে। আইন সবার জন্যই সমান হলে কোন কথা ছিলো না। উনাদের স্বার্থহানি ঘটলেই এধরনের অভিযান চালিয়ে শিক্ষা দেয়ার কৌশল গ্রহন করেছেন। ভাটা তো প্রায় সবই অবৈধ। কারো ভাটার লাইসেন্স নেই, কারো পরিবেশ অধিদপ্তরের লাইসেন্স নেই। এভাবে খুঁজলে ঠক বাছতে গা উজার হয়ে যাবে’। জেলায় প্রায় ২শতাধিক ভাটার মধ্যে ১৬টি বৈধ লাইসেন্স ও পরিবেশ সুরক্ষা ছাড়পত্র থাকলেও বাকীদের কোন বৈধ কাগজপত্র নেই। এই সুযোগেই এসব অবৈধ ইট ভাটাগুলি যেনো ‘গরীবের বউ সকলের ভাবী’র মতো হয়ে গেছে। চান্স পেলেই যে কেউ হাতামেরে বসে’। এভাবে ভাটা মালিকরা জেলা ও উপজেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, প্রভাবশালী রাজনৈতিক মহল ও সাংবাদিকদের প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা দিয়ে এসব ভাটা চালাতে হয়’।

অভিযানের বিষয়ে নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট মমতাজ বেগম বলেন, ‘এই অভিযান পরিবেশ অধিদপ্তরের চলমান রুটিন ওয়ার্ক। ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন আইন এবং পরিবেশ সুরক্ষা আইন না মেনে ভাটা স্থাপন করলেই সেখানে এই অভিযান চলবে। এই অভিযানের মধ্যদিয়ে সবাই যেনো সচেতন হয়ে উঠতে পারে সেটা আমাদের কাম্য।

এদিকে একইভাবে গত ৪ ডিসেম্বর, কুষ্টিয়া কুমারখালী উপজেলার ১১নং চরসাদীপুর ইউনিয়নের ৩২টি অবৈধ ইটভাটা যার মধ্যে ১৯টিই হলো বিপদজনক ড্রাম চিমনির ভাটা। এসব ভাটা উচ্ছেদে পাবনা সদর, কুষ্টিয়া সদর ও কুমারখালী এই তিন উপজেলার সহাকরী কমিশনার (ভুমি) ও নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রে এবং আনসার, পুলিশ, র‌্যাব, ফায়ার সার্ভিস ও আর্মিসহ শতাধিক আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী নিয়ে অভিযানে গিয়ে চরম বাধার মুখে পড়ে এবং ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে বলে প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যে জানা যায়।
সেখানে চরসাদিপুর ইউনিয়নের ভোমরার মোড়ে এসব অবৈধ ইটভাটা মালিক ও শ্রমিকরা তাদের অবরুদ্ধ করে রাখেন। বাধ্য হয়ে তিন ঘণ্টার অবরুদ্ধ শেষে চরম নতজানু হয়ে রক্তপাতহীন নিরাপত্তার স্বার্থে অভিযানিক দল ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন বলে নিশ্চিত করেন পরিবেশ অধিদপ্তর কুষ্টিয়ার সহকারী পরিচালক হাবিবুল বাসার।
অবৈধ ইটভাটা উচ্ছেদ অভিযান থেকে ফিরে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও কুমারখালী সহকারী কমিশনার (ভূমি) আমিরুল আরাফাত বলেন, ‘যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন দুর্গম চরসাদিপুর এলাকায় ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন আইন লঙ্ঘন করে স্থাপিত ৩০টিরও বেশি অবৈধ ইটভাটা রয়েছে। এসব ভাটা মালিকদের একাধিক বার সতর্ককরার পরও তারা কোন ইতিবাচক সারা দেয়নি। সেকারনে প্রায় ১০০ জনের একটি দল সেখানে অভিযানে যায়। তবে ভাটামালিক ও শ্রমিকরা পথের মধ্যেই ‘নারায়ে তাকবির’ শ্লোগানসহ কয়েকশ বিক্ষুব্ধ মানুষ মিছিল নিয়ে এসে পথরোধ করে অভিযানিক টিমকে আটকে দেয়। প্রায় ৩ ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়েও তারা ভাটায় পৌঁছাতে পারেননি। সেখানে জানমালের নিরাপত্তার স্বার্থে আইন প্রয়োগ করা সম্ভব হয়নি। পরে বাধ্য হয়ে আগামী বছর আর অবৈধ ভাটা চালাবেন না, মর্মে ভাটা মালিকদের মুচলেকা নিয়ে সেখান থেকে ফিরে আসেন তারা।’
ওই দিন অভিযানে অংশ নেয়া কর্মকর্তাবৃন্দ হলেন – কুষ্টিয়া সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার ( ভূমি) রিফাতুল ইসলাম, কুমারখালী উপজেলা সহকারী কমিশনার ( ভূমি) মো. আমিরুল আরাফাত, পাবনা সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার ( ভূমি) মুরাদ হোসেন ও কুষ্টিয়া পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক ( ভারপ্রাপ্ত) হাবিবুল বাসার সহ আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তা ও সদস্যরা।

কুমারখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এসএম মিকাইল ইসলাম বলেন,‘পরবর্তী সময়ে আরও ব্যাপক প্রস্তুতিসহ গুছিয়ে সুসজ্জিতভাবে চরসাদিপুরে অভিযান চালানো হবে।’

কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসক মো: তৌফিকুর রহমান জানান, ‘পদ্মার চরে চরসাদিপুর ইউনিয়নটি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় এসব অবৈধ ভাটা মালিকরা নির্বিঘ্নে সেখানে ভাটা স্থাপন করেছে। এতোদিন সেখানে এসব অবৈধ ভাটা স্থাপনে বাধা দেয়া বা উচ্ছেদে কার্যকরী পদক্ষেপ না নেয়ায় এরা এমন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে, এমনকি সরকারী কাজেও বাধাদানের চেষ্টা চালিয়েছে। এঘটনায় মামলা দায়েরসহ আইনগত ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য সংশ্লিষ্ট পরিবেশ অধিদপ্তরকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে’।