শেখ জাহাঙ্গীর আলম শাহীন, লালমনিরহাট : লালমনিরহাটে কৃত্রিম সংকটে সকল প্রকার সারের দাম প্রতিবস্তায় ৪-৫ শত টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে।
সীমান্তের ওপারে সার পাচারের অভিযোগ উঠেছে। গ্রামে গ্রামে গোপন গোডাউনে সার মজুদ করছে অসাধু ব্যবসায়ী চক্র। মহা বিপাকে কৃষক।
জেলার হাটবাজারে কৃষকের কাছে ইউরিয়া, টিএসপি, এমওপি ও ডিএপি সহ সকল প্রকার সারের দাম প্রতিবস্তায় ৪ শত টাকা হতে ৫ শত টাকা চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে। জেলায় এ বছর ৮৫ হাজার ৬৫০ হেক্টর জমিতে আমন ধানের আবাদ হয়েছে। ধান কাটা মাড়াই শেষ কৃষক পুনরায় চাষাবাদের জন্য জমি তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছে। এ পর্যন্ত সাড়ে ৩ হাজার হেক্টর জমিতে শীতকালীন ফসল চাষ হয়েছে। লক্ষ্যমাত্র নিধারণ হয়েছে ৬ হাজার ৫ শত হেক্টর। উৎপাদন ধরা হয়েছে এক লাখ ২০ মেঃটন। কৃষক সার কিনতে গিয়ে বিপাকে পড়েছে। এতে করে শীতের সবজি চাষ ব্যহ্নত হচ্ছে। কৃষকরে অভিযোগ চাহিদা মত কৃষক সার পাচ্ছেনা। বলছে সার নেই। আবার বেশি দাম দিলে সার দিচ্ছে। চড়ামূল্যের সার বিক্রির করলেও কোন রশিদ বা চোতা দিচ্ছে না। রশিদ চাইলে সরকারি মূল্যের রশিদ দিচ্ছে। লালমনিরহাটে সব ধরনের সারের দাম বেশি হওয়ায় ফসল উৎপাদনে খরচ পড়ছে অনেক বেশি। উৎপাদন খরচ বেশি হলে কৃষক কে লাভ ধরে বেশি দামে বিক্রি করতে হবে। যার প্রভাব পড়বে সাধারণ ক্রেতার উপর। আবার এমন হয় কৃষক মূল্য নাপেয়ে র উৎপাদন খরচ তুলতে পারেনি। কৃষক পানির দামে ফসল বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। সেই ফসল গোডাউনে মজুদের পর চড়াদামে সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা বিক্রি করছে।
সারের দাম নিয়ে খরচরা বিক্রেতা ও ডিলার গণ একে অপরকে দায়ী করছে। তারা বলছে খুচরা বিক্রেতা দাম বাড়িয়ে বিক্রি করছে। খুচরা বিক্রেতার বলছে ডিলারদের কাছ হতে বেশী দামে কিনতে হচ্ছে। তাই দুই একটাকা বেশি খুচরায় বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। কৃষকের দাবি প্রতিটি ইউনিয়নে সরকারি ভাবে বিসিআইসি ও বিএসডিবি সার ডিলার রয়েছে কিন্তু ইউনিয়ন ভিক্তিক সার ডিলারদের বিক্রয় কেন্দ্র নেই। লোক দেখাতে খুচরা বিক্রেতার দোকানে সাইবোর্ড টানিয়ে রেখে দায় সেরেছে।
লালমনিরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা ড. মোহাম্মদ সাইখুল আরিফিন জানান, সার পর্যাপ্ত পরিমাণে মজুদ রয়েছে। সরকারি ভাবে প্রতিমাসে ডিলারদের চাহিদা মত সার সরবরাহ করা হয়েছে। সার সংকটের প্রশ্নই উঠেনা। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে। আগামীকাল ২৭ নভেম্বর লালমনিরহাট জেলা প্রশাসকের দপ্তরে সারমনিটরিং কমিটির মিটিং রয়েছে সেখানে উপস্থাপন করা হবে। রংপুর বিভাগের লালমনিরহাট অঞ্চলের মাঠে মাঠে আলু, ফুলকপি, বাঁধাকপি, মূলা, পালং শাকসহ হরেক রকম আগাম শীতকালীন সবজি চাষে ব্যস্ত কৃষকেরা। ভালো ফলন পেতে বাড়তি যত্ন নিচ্ছে। পাশাপাশি কৃষকেরা আবাদি জমিতে প্রয়োগ করছেন কীটনাশক ও নানা ধরনের সার। লালমনিরহাট জেলায় ইউরিয়া, টিএসপি, পটাশ, এওপি, ডিএপি, এমওপি সহ সব ধরনের সারের দাম বস্তাপ্রতি বেড়েছে ৪০০- ৫০০ টাকা পর্যন্ত।
কৃষকরা বলছেন, ডিলাররা গুদামে সার রেখে বলছেন সার নেই। কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে বেশি দামে সার বিক্রি করছেন তারা। লালমনিরহাট কৃষি সম্প্রসারণ দপ্তরের তথ্য মতে জেলায় ইউরিয়া সারের চাহিদা ৩ হাজার ২৪১ মেঃটন, ডিলারগণ উত্তোলন করেছে এক হাজার ৬৭৮ মেঃটন, মজুদ রয়েছে এক হাজার ৯৩৭ মেঃটন। টিএসপির চাহিদা ছিল এক হাজার ৯২৪ মেঃটন, উত্তোলন করেছে এক হাজার ১৮৭ মেঃটন, মজুদ রয়েছে ৭৪৫ মেঃটন। ডিএপি সারের চাহিদা ছিল ৩ হাজার ৪১২ মেঃটন, উত্তোলন হয়েছে এক হাজার ৮৫৮ মেঃটন, মজুদ রয়েছে এক হাজার ৪৭৯ মেঃটন। এমওপি সারের চাহিদা ছিল দুই হাজার ৭০ মেঃটন, উত্তোলন করেছে এক হাজার ২৫২ মেঃটন, মজুদ রয়েছে ৭৪৮ মেঃটন। এই মুহুর্তে জেলায় সারের কোন সংকট থাকার কথা নয়। ডিলার গণের কারসাজিতে সারের কৃত্রিম সংকট হতে পারে। জনৈক ডিলার বলেন, কিছু কিছু সারের সরবরাহ সংকট রয়েছে। সেটা কৃষি বিভাগও জানেন। এই সারের দাম বৃদ্ধির জন্য খুচরা ব্যবসায়ীরা দায়ী। তারা দাম বাড়িয়ে বিক্রি করছে। এ মৌসুমে জেলায় ৬ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে এক লাখ ২০ হাজার মেট্রিক টন সবজি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। ইতোমধ্যে সাড়ে ৩ হাজার হেক্টর জমিতে শীতের সবজি রোপন হয়েছে। বাকি জমিতে রোপনের কার্যক্রম করছে কৃষক। ৯১ সালের মত একটি সিন্ডিকেট সার ভারতে পাচার করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। প্রায় ৮১ টাকা কেজি প্রতি ভর্তুকি মূল্য দিয়ে ইউরিয়ার সার কিনে সরকার কমদামে সার কৃষকের কাছে বিক্রি করছে। ভারত সার নিজেরা উৎপাদন করে। আবার রাশিয়া হতে আমদানিও করে থাকে। ভারতে জলবিদ্যুত কেন্দ্র গুলির কয়েকটি বিপর্য ঘটেছিল বন্যায়। ফলে তারা বিদ্যুত সংকটের কারণে সার কারখানা গুলোর উৎপাদনে ফিরতে পারেনি। আবার সার উৎপাদনের প্রধান উপকরণ পানি। কয়েকটি জলবিদ্যুত কেন্দ্রের বাঁধ গুলো ভেঙ্গে যাওয়ায় পানি সরবরাহ করতে পারেনি। এছাড়াও তিস্তা, ধরলা ও সানিয়াজান নদীর বিস্তৃণ চর রয়েছে বাংলাদেশ ভারত পাশাপাশি ভূ খন্ডে। অসম ও মেঘালয় পড়েছে কুড়িগ্রাম সীমান্তে। ভৌগলিক কারণে এখানকার কৃষক গণ ভারতের ভূ খন্ড হতে সার পরিবহন করা খুবেই ব্যয় বহুল ও কষ্ট সাধ্য। ভারতের এসব অঞ্চলের কৃষি ও কৃষক লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রামের বাজার হতে সার সংগ্রহ করে কৃষি কাজ করছে। সীমান্তের ওপার হতে অবৈধ ভাবে আসা অবৈধপণ্য, মাদক ও গরুর বিনিময় মুদ্রা হিসেবে সার কে ব্যবহার করা হচ্ছে বলে মাফিয়া সিন্ডেকেট সূত্রে জানা গেছে। কুলাঘাট ইউনিয়নের কৃষক রহমত আলী জানান, প্রতিদিন বিকাল হলে কুলাঘাট সেতুর উপর দিয়ে তিন চাকার যানবাহনে লালমনিরহাটের সার কুড়িগ্রামে যায়। এটা সম্পূর্ণ অবৈধ। সরকারের নীতিমালায় এক জেলার বরাদ্দকৃত সার অন্য জেলায় যেতে পারবেনা।
কৃষি বিভাগ বলছে বিআরডিসির গোডাউন হতে কুড়িগ্রামেও বরাদ্দ দেয়া হয়। অভিযোগকারী কৃষক বলছে, সে বরাদ্দ তো প্রতিদিন দেয়া হয় না। মাসের নির্দিষ্ট দিনে দেয়া হয়। কিন্তু সার তো প্রতিদিন যায়। অথচ কুলাঘাটে বিজিবি ও পুলিশ চেকপোষ্ট দুই রয়েছে। কুলাঘাট রোডে কুড়িগ্রামে যাওয়া সারের গাড়ি বরাদ্দকৃত সার পরিবহনের সময় সার সরবরাহের স্লীপ থাকতে হবে। যাহা এই সার পরিবহনের গাড়িতে থাকেনা। এমন কি অবৈধ ভটভটি, নছিমন, করিমন গাড়িতে সার পরিবহন করা হচ্ছে। যার কোন কাগজপত্র নেই। নেই সরকারি রোডপারমিট। সার সংকটের বিষয়ে লালমনিরহাটের জেলা প্রশাসক এইচএম রকিব হায়দার জানান, বিষয়টি আমার জানা নেই। কৃষি কর্মকতাকে জানান। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।