শেখ জাহাঙ্গীর আলম শাহীন, লালমনিরহাট:
খরস্রোতা তিস্তা নদী এখন পানি শূন্য হয়ে পড়েছে। এতে করে তিস্তা পাড়ে বোরো ধান চাষের আওতা কমেছে। তারমধ্যে তাপদাহে কৃষি শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। কৃষি কাজে দিনমজুর শ্রমিকের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। গরমে এবার এমন সমস্যায় কৃষিতে নতুন সংকট হয়ে দেখা দিয়েছে।
তিস্তা নদী পানি শূন্য থাকলেও, কদিন পরে বষার্ মৌসুম। তখন উল্টোচিত্র বর্ষায় দেখা দিবে। সামান্য বৃষ্টিতে ও ভারতের উজানের ঢলে নদীর দু’পাড় উপচে সৃষ্টি হবে বন্যা। দেখা দেবে তীব্র নদী ভাঙ্গন। বর্ষা ও শুস্ক দুই মৌসুমে তিস্তা পাড়ের মানুষ পরে মহাবিপাকে। এখন তিস্তা পানি শূন্য হয়ে নদী বুকে জেঁগেছে বিশাল খাঁ খাঁ বালুচর। তিস্তার বালুর উত্তাপ ছড়িয়েছে পুরো উত্তরাঞ্চলে। তিস্তা নদী পাড়ের জনবসতির বায়ুতে এখন শুধু ধূলিকণা। শ্বাসকষ্ট সহ নানা রোগবালাই আশস্কাজনক হারে বেড়ে চলছে। তিস্তার চর গুলোতে তীব্র গরমে ফসলের মাঠ পরিচযার্র কাজ কৃষক ও কৃষি শ্রমিকরা বন্ধ রেখেছে। তাপদাহের কারণে গরমে অতিষ্ট হয়ে কেউ কৃষি শ্রমিকের কাজ করতে চায় না। এছাড়াও পানির অভাবে চরের ফসলের খেত পুড়ে যাচ্ছে। থমকে গেছে কৃষি ও কৃষিকাজ ।
জানা গেছে, তিস্তা নদী প্রায় ১৩৫ কিলোমিটার বাংলাদেশে প্রবাহিত হচ্ছে। নীফফামারী, লালমনিরহাট, রংপুর, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা জেলার বুকচিঁড়ে তিস্তা নদী প্রবাহিত হয়ে আসছে। তিস্তা নদীকে উত্তরাঞ্চলের ফুঁসফুস বলা হয়ে থাকে। তিস্তায় এবারে একেবারে পানি শূন্য। এই তিস্তা নদীতে ১৯৮৯ সালেও প্রতিমাসে গড়ে প্রায় আড়াই হাজার হতে ৫ হাজার কিউসেক পানি প্রবাহ থাকত। এখন যাহা শূন্যের কোটায়। তিস্তায় পানি না থাকায় মৎস্যজীবিরা পেশা পরিবর্তন করেছে। আবার উল্টোচিত্র বর্ষা প্রতিবছর বন্যা ও নদী ভাঙ্গনে গৃহহীন হাজার হাজার মানুষ পথে বসে যাচ্ছে। এভাবেই চলছে ২৮ বছর ধরে।
অতিতের কথা তিস্তা নদী ছিল প্রমথ। তিস্তা নদী উত্তরাঞ্চলের প্রান। এই নদীকে ঘিরে রংপুর, লালামনিরহাট, কুড়িগ্রাম ও নীলফামারী শহর গড়ে উঠেছে। উত্তরাঞ্চলের চাষাবাদ তিস্তা নদীর পানি কেন্দ্রীক। তিস্তা নদীতে পানি থাকলে তিস্তার শাখা নদী মানাষ, সতী, বুড়িতিস্তাসহ শাখা নদী গুলোতে সারা বছর পানি থাকে। এই পানি কৃষক সারা বছর সেচ কাজে ব্যবহার করে আসছে। কিন্তু কয়েক বছর ধরে চিত্রটি পাল্টে গেছে। তিস্তা নদীতেই পানি নেই। তাই শাখা নদী গুলো মরে গেছে। শাখা নদীর অস্তিত্ত বিপন্ন হয়ে গেছে। তিস্তা নদী পানি শূন্য হয়ে যাওয়ার পিছনে ভারতের এক তরফা পানি প্রত্যাহারকে পানি বিশেষজ্ঞগণ দায়ী করছে।
খরস্রোতা তিস্তা নদী উত্তরাঞ্চলের ও উত্তরাঞ্চলের মানুষের ফুঁসফুঁস। তিস্তা কে নিয়ে ছিল কত স্বপ্ন। তাই ১৯৮৯ সালে তিস্তা নদীতে জেলার হাতীবান্ধার দোয়ানিতে তিস্তা ব্যরেজ নির্মান করে। এই ব্যারেজটি ছিল মূলত দেশের বৃহত্তম পানি সেচ প্রকল্প। দেশের প্রথম কোন বৃহত্তর রাষ্ট্রীয় প্রকল্প ছিল এটি। রংপুর, নীলফামারী ও দিনাজপুর জেলার ১২টি উপজেলার ৯১ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দিতে সক্ষম এই প্রকল্পটি। কিন্তু শুরুতেই হোঁচট খায় প্রকল্পটি। ৭৯ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দিয়ে এই প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। এরপর ধারাবাহিক ভাবে প্রতিবছর সেচের আওতা তিস্তা ব্যারেজ সেচ প্রকল্প কমিয়ে নিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে। এই সেচ কার্যক্রম কমিয়ে নিয়ে আসার পিছনে একটাই কারণ তিস্তা নদীতে পানি প্রবাহ দিন দিন কমেছে। এ বছর মাত্র ১২ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেয়া গেছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের ডালিয়া ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, তিস্তা নদীর উজান হতে পানির প্রবাহ কম আসায়, সেচ যোগ্য জমির আওতা কমানো হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের ডালিয়া ডিভিশনের কৃষিসম্প্রসারণ কর্মকর্তার দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩ সালে ৭০ হাজার হেক্টর জমিতে তিস্তা সেচ প্রকল্প হতে সেচ দেওয়া হয়। পরের বছর সেচ দেয়া হয় ২৫ হাজার হেক্টরের কম জমিতে। ২০১৫ সালে মাত্র ৯ হাজার ৮৬০ হেক্টর জমিতে সেচ দেয়া হয়। ২০১৬ সালে মাত্র ১১ হাজার ৪৫০ হেক্টর জমিতে সেচ দেয়া হয়। ২০১৭ সালের ৩০ মার্চ পর্যন্ত ২০ হাজার ২২০ হেক্টর জমিতে সেচ দেয়া হয়েছে। এদিকে একটি সূত্রে দাবী করেছে গত কয়েক বছর ধরে নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা ও উন্নয়ন কাজ চলছে তিস্তা প্রকল্পে। প্রায় কয়েক হাজার কোটি টাকা খরচ করে ব্যারেজকে কার্যকর করার ব্যর্থচেষ্টা করা হচ্ছে। ব্যারেজ কার্যকরের নামে চলছে হরিলুটের খেলা। দুনীর্তি হয়েছে হাজার কোটি টাকা। এই সেচ প্রকল্পটি এখন দুনীর্তির বড় আখড়ায় পরিণত হয়েছে। সেচ প্রকল্প এলাকায় খাল, নালা সংস্কার করার কয়েক মাস যেতে না যেতে গত বষার্য় ভেঙ্গে গেছে। কৃষকের শতকোটি টাকার ফসল বষার্ মৌসুমে জলে ভেসে গেছে। কৃষক রমজান আলী (৫৫) জানান, তিস্তা ব্যারেজের খাল, নালা সংস্কারের কাজ অত্যন্ত নিম্মমানের হয়ে থাকে। দায়সারা গোছের কাজ। এভাবে প্রতিবছর হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়ে আসছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের সূত্রে জানা গেছে, তিস্তা সেচ প্রকল্প সচল রাখতে শুস্ক মৌসুমে ১০ হাজার কিউসেক পানি প্রবাহ প্রয়োজন। কিন্তু ১০ হাজার কেউসেক পানি উজান হতে পাওয়া যাচ্ছে না। শুস্ক মৌসুমে ৫০০ কিউসেক পানি প্রবাহ উজান হতে আসে না। তাদের দাবী ১০ হাজার কিউসেক পানি পেলে তিস্তা ব্যারেজ সেচ প্রকল্প তার লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারত। কয়েক বছর ধরে তিস্তা নদীতে শুস্ক মৌসুমের প্রথম তিন মাস পানি প্রবাহ ছিল সর্বনিম্ন ৯০০ কিউসেক হতে সর্বোচ্চ তিন হাজার কিউসেক পানি। গত দুই বছর ধরে ৫০০ কিউ সেক হতে সর্বনিম্ন এক হাজার একশত কিউসেক পানি প্রবাহ থাকে। ২০২৩ সালে এপ্রিল মাসের শুরুতে অস্বাভাবিক হারে পানি আসতে থাকে। ৪ এপ্রিল পর্যন্ত তাহা ৬০ হাজার কিউসেক পর্যন্ত অতিক্রম করে ছিল। চলতি বছর এখনো তিস্তা নদীতে কোন পানি প্রবাহ আসেনি। পশ্চিমবঙ্গে ও বাংলাদেশে খরা চলছে তাই এবছর মে মাসে তিস্তা নদীর উজানি ঢল আসেনি। বর্ষা মৌসুম এলে ভারতীয় ঢলে তিস্তা নদীতে পানি প্রবাহ কিছুটা বাড়তে পারে। তবে এবছর বষার্ পানি প্রবাহ বাড়লে তিস্তায় বিপর্যয় দেখা দিবে। গত বছর ভারতের বাঁধ ভেঙ্গে তিস্তায় ৩ হতে ৫ ফিট পর্যন্ত পলি জমেছে। তিস্তা তার নাব্যতা হারিয়ে ফেলেছে। শুস্ক মৌসুমে বর্ষার ব্যারেজের ৪৪টি গেট আটকিয়ে সেই পানি সেচ কাজে লাগানো হচ্ছে। ব্যারেজের ভাটিতে লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা ও রংপুর জেলার প্রায় ১২৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই নদীতে কোন পানি নেই। শুস্ক মৌসুমে পানি না থাকায় এই তিন জেলার নদী উপকূলে ইতোমধ্যে মরুপ্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। নদী পাড়ে হাজার হাজার একর জমিতে সেচ ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়েছে। নদী হতে সকল ধরনের মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এখন নদীতে শাল, বোয়াইল, শিশুব এর অস্থিস্ত বিপন্ন হয়ে গেছে। বর্ষা মৌসুমে তিস্তা পাড়ের মানুষের দূর্ভোগের সীমা থাকে না। তিস্তা নদীর পানি কোন নিয়ম মেনে আসে না। বৃষ্টি বাদল হলে উজান হতে পানির ঢল তিস্তা নদী দিয়ে চলে আসে। ফলে বর্ষা মৌসুমে প্রতি সপ্তাহে তিস্তা পাড়ে বন্যা লেগে থাকে। পানি বাড়লেই তিস্তা পাড়ের মানুষের সব কিছু ধুয়ে নিয়ে যায়। বর্ষা মৌসুমে পানি বাড়া কমার খেলার মধ্যে চরম বিপর্যয় হিসাবে দেখা দেয় তীব্র নদী ভাঙ্গন। মহিষখোচা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আলহাজ্ব মোছাদ্দেক হোসেন চৌধুরী জানান, বর্ষায় নদীতে থাকে অস্বাভাবিক পানি। শুস্ক মৌসুমে কোন পানি থাকেনা। যারফলে তিস্তা নদী তার নাব্যতা হারিয়ে ফেলেছে। বন্যা নদীভাঙ্গন বর্ষা মৌসুমে তিস্তা পাড়ের মানুষের নিত্যসঙ্গী। এদিকে লালমনিরহাট কৃষি বিভাগের উপ পরিচালক ডাঃ মোঃ সাইখুল আরিফিন জানান, তিস্তা নদী পাড়ের বা চরে পানি সমস্যা কিছুটা রয়েছে। তবে সার্বিক ভাবে জেলার কৃষি পরিস্থিতি ভালো। তাপদাহের কারণে ফসল পরিচচার্য় কিছুটা বিঘ্নিত হয়েছে। তাতে উৎপাদন সামান্য হ্রাস পেতে পারে।
দৈনিক দেশতথ্য//এইচ//