মোঃ লিটন হোসেন :বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গে সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর বসবাস। স্বাধীনতার ৫৩ বছর অতিক্রান্ত হলেও তারা তাদের মৌলিক অধিকার থেকে এখনও বঞ্চিত। নওগাঁ জেলার ধামইরহাট, পত্নীতলা, ও সাপাহার উপজেলায় ১৫০ টি সাঁওতাল পরিবারের সাক্ষাৎকার ও বাড়ি পরিদর্শনের মাধ্যমে যেসব তথ্য পেয়েছি তা লেখার চেষ্টা করছি। সাঁওতাল জনগোষ্ঠীদের অধিকাংশ পেশায় কৃষি দিনমজুর। তাদের নিজস্ব জমির পরিমাণ খুব নগন্য (বসতবাড়ি), মাঠে চাষযোগ্য জমি হাতেগোনা কয়েকটা পরিবারের আছে। পুরুষদের গড়ে মজুরি ৪০০ টাকা, নারীদের মজুরি গড়ে ৩০০ টাকা। বছরের অর্ধেক সময় তারা কৃষি কাজ করার সুযোগ পেয়ে থাকেন, অর্ধেক সময় বসে থাকতে হয়। সকালের নাস্তায় তারা অধিকাংশ চাল ভাজা, মুড়ি, ও লবণ চা খেয়ে থাকেন। দুপুরে ও রাতে ভাত এর সাথে বাড়ির আশেপাশের জঙ্গল থেকে সংগ্রহীত শাক, সবজি, ও আলু খেয়ে থাকেন। প্রাণিজ আমিষের কদাচিৎ ব্যবস্থা তাদের জন্য অনেকটা স্বপ্নের মতো। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এখন শিকারের মাধ্যমে আমিষের অভাব পূরণ করা সম্ভব হয় না। সজনা গাছের পাতা সবজি হিসেবে তাদের খুব পছন্দের একটা খাবার। চৈত্র, বৈশাখ, আশ্বিন, ও কার্তিক মাস তাদের জন্য দুর্বিষহ সময়। এই চার মাস কোন কাজ না থাকায় তাদের অনেককে অনাহারে দিন কাটাতে হয়। স্বাভাবিক এর চেয়ে কম দামে কৃষি শ্রম বিক্রয় করে কৃষকদের থেকে অগ্রিম টাকা নিয়ে এসে পরিবারের সদস্যদের খাবার ক্রয় করতে হয়। শিক্ষার অভাবে তারা কৃষি ছাড়া অন্য কাজের সুযোগ পান না। জন্মের পর থেকে সাঁওতালি ভাষায় কথা বলে অভ্যস্ত এই বিশাল জনগোষ্ঠী। তাদের ভাষার কোন বর্ণমালা নেই, এই কারণে শিক্ষা জীবনের প্রথম স্তরে বাংলা ভাষায় পড়াশোনা করা একটা বড় প্রতিবন্ধকতা। বর্তমানে শিক্ষার ব্যয় যেভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে তারা কিভাবে শিক্ষা অর্জনের সুযোগ পাবে এটা একটা বড় প্রশ্ন? যেখানে দিনে তিনবেলা পেটপুরে খাবারের ব্যবস্থা করতে হিমশিম খেতে হয় সেখানে শিক্ষা তাদের কাছে অনেকটা বিলাসিতার মতো।
বিদেশী খ্রিস্টান ধর্মযাজকদের সহায়তায় বিশুদ্ধ খাবার পানির ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিছু সংখ্যক পরিবারকে আধাপাকা টয়লেট এর সুযোগ দেওয়া হয়েছে। জীবন সংগ্রাম থেকে একটু স্বস্তি পেতে প্রণোদনা পাওয়ার আশায় তারা পূর্বপুরুষ এর সনাতন ধর্ম ত্যাগ করে খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছেন। বিদেশী ধর্মযাজকেরা যখন আমাদের দেশে অবস্থান করে তাদের দেখাশোনা করতেন তখন তারা কিছুটা প্রণোদনা পেতেন, এখন ধর্মযাজকের দায়িত্ব তাদের মধ্যে থেকে পালন করায় উল্টো তাদের চাঁদা দিয়ে মিশনগুলো চালাতে হয়।
বিদেশী খ্রিস্টানদের সহায়তায় ও তত্বাবধানে পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর সন্তানদের পড়াশোনার জন্য সুযোগ দেওয়ার চেষ্টা করা হয় কিন্তু অর্থের অভাবে এই সুযোগ গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। তাদের মধ্যে খুব কম সংখ্যক পরিবারের সন্তান কষ্ট করে পড়াশোনা করেছেন এবং কর্মসংস্থান এর সুযোগ হয়েছে।
সাঁওতাল জনগোষ্ঠীদের দরিদ্রতার প্রধান কারণ কাজের অভাব। তারা কৃষি শ্রমিক ছাড়া অন্য সেক্টরে কাজের সুযোগ থেকে বঞ্চিত শিক্ষার অভাবে। এই বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য যে কোন মূল্যে শিক্ষার ব্যবস্থা করতে না পারলে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন সম্ভব নয়। আশা করি নীতি নির্ধারকেরা সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন এবং তাদের ন্যূনতম মৌলিক অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকার সুযোগ সৃষ্টি করবেন।
লেখক পরিচিতি: শিক্ষার্থী অর্থনীতি বিভাগ
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর
Discussion about this post