নিজস্ব প্রতিবেদক: স্বাভাবিক নাব্যতায় বছরে দেশী প্রজাতির প্রায় ১শ মেঃ টন মাছ উৎপাদনের ক্ষেত্র কুষ্টিয়ার পদ্মার শাখ নদী গড়াই প্রকৃতির বিরুপ প্রভাবে শুকিয়ে এখন খালে রুপ নিয়েছে। জিকে সেচ পাম্প অচল হয়ে পড়ায় নদী তীরবর্তী কৃষি, জীব-বৈচিত্র্য হুমকিতে পড়েছে।
দেশী প্রজাতির মাছ উৎপাদন, জিকে পাম্পকে সচল, সুন্দরবনকে লবণাক্ততা মুক্তকরণ এবংপ্রাণি, গাছ-পালা রক্ষা, ভুগর্ভের পানির স্তর ধরে রাখতে গড়াই নদীতে সারা বছর নাব্যতা রাখতে সরকার ড্রেজিংসহ নানা মুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
জানা যায়, পদ্মার শাখা গড়াই নামে ৮৯ কিঃ মিঃ দৈর্ঘ্য ।এ ছাড়া দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১০টি জেলায় শুষ্ক মৌসুমে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য, কৃষি, মৎস্য, জলপথ রক্ষা এবং সর্বোপরি খুলনা বিভাগের উপকুলীয় লবণাক্ততার আগ্রাসন থেকে একমাত্র সংরক্ষিত বনাঞ্চল ও ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন’কে বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষার প্রধান মিঠা পানির উৎস হলো গড়াই নদীর পানি প্রবাহ। বিষয়টি সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বিবেচনায় গড়াই নদী পূনরুদ্ধার প্রকল্প হাতে নিয়েছে যা বর্তমানেও চলমান রয়েছে।
চলতি বছরে গড়াইয়ের নাব্যতা সচল রাখতে ২৬ কোটি টাকার প্রাক্কলন ব্যয়ে গড়াই পূণরুদ্ধার প্রকল্পের খনন কাজ চলমান। প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, ১৯৯৮ সালে প্রথম ধাপে গড়াই নদী পুনরুদ্ধার প্রকল্পে ক্যাপিটাল ড্রেজিং দিয়ে শুরু হয়েছিল ।
বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধায়নে নেদারল্যান্ডের একটি কোম্পানী কুষ্টিয়া সদর উপজেলার তালবাড়িয়াস্থ গড়াই নদীর উৎসস্থল থেকে কুমারখালী হয়ে খোকসা উপজেলার জানিপুর পর্যন্ত প্রায় ৩০কি:মি: নদী খনন করে একটা পাইলট প্রকল্প সম্পন্ন করে। এ প্রকল্প বাস্তবায়নের মধ্যদিয়ে সৃষ্ট পানি প্রবাহের নাব্যতাকে টেকসই করতে স্থায়ীভাবে মেইন্টেনেন্স প্রকল্প চালুর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগ। এর পরেই গড়াই নদীর সুফল পেতে শুরু করে এ এলাকা।
সরজমিনে গড়াই নদীর কমলাপুর, বারখাদা বাঁধ সংলগ্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, চিকন সরু গড়াই নদীতে স্বচ্ছ পানি প্রবাহমান । গড়াই নদীর মুল উৎস পদ্মাতেই তেমন পানি নেই। ফলে উজান থেকে নেমে আসা পানির লাইনে পলি-মাটি ভরাট হওয়ায় শুষ্ক মৌসুমে গড়াই শুকিয়ে পানি প্রবাহ স্বাভাবিকতা হারাচ্ছে। গড়াই শুকিয়ে যাওয়ায় কুষ্টিয়া এলাকায় পানির স্তর নেমে গেছে।
কুষ্টিয়া সরকারী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মাহাতাব উদ্দিন বলেন, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১০ জেলার জনগোষ্ঠীর কাঙ্খিত বিশুদ্ধ পানি প্রবাহ, কৃষি, মৎস্য, জীববৈচিত্র্য, পরিবেশ ও জলপথ রক্ষা এবং সর্বোপরি বঙ্গোপসাগর উপকুলীয় অঞ্চলের তীব্র লবণাক্ততার আগ্রাসন রুখতে গড়াই ব্যতিত কোন কিছুই আর ফলপ্রসু হচ্ছে না। গড়াই আংশিক শুকিয়ে যাওয়ায় এ অঞ্চল জুড়ে প্রতি বছরই শুষ্ক মৌসুমে ভু-গর্ভস্থ পানির স্তরে তীব্র সংকট দেখা দিচ্ছে।
গড়াই নদীর ওপর অবস্থিত সৈয়দ মাছ-উদ রুমী সেতু ও গড়াই ব্রিজের নিচে ড্রেজিং করার ফলে কিছুটা পানি প্রবাহ থাকলেও অধিকাংশ পিলার ধূধূ বালির ওপর রয়েছে। সাধারণ মানুষ এই গড়াই নদীর অনেক স্থান দিয়ে হেঁটে পার হচ্ছে।
কুষ্টিয়া পৌর কর্তৃপক্ষ বলছে, নদীগুলোর নাব্যতা না থাকার পাশাপাশি পানির স্তর বিগত বছরগুলোর তুলনায় ২৫ থেকে ৩০ ফিট নেমে যাওয়ায় হস্তচালিত নলকূপে পানি উঠছে না।
পানির স্তর এভাবে কমে যাওয়ার জন্য যত্রতত্র গভীর নলকূপ ব্যবহারকে দায়ী করছে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর। তারা বলছে, শুষ্ক মৌসুমে পানির স্তর নিচে নামার সঙ্গে সঙ্গে নদীর পানিও শুকিয়ে যায়। সেক্ষেত্রে যেসব নলকূপের লেয়ার কম দেওয়া, সেসব নলকূপে পানি না ওঠারই কথা। সেক্ষেত্রে নতুন নলকূপ স্থাপনের ক্ষেত্রে পরিকল্পনামাফিক আরো গভীরে লেয়ার দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
গড়াই নদীর উৎসমুখ সংলগ্ন সদর উপজেলার ১নং হরিপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এম মুশতাক হোসেন মাসুদ বলেন, গড়াই নদীকে স্থায়ী খননের মাধ্যমে এর পূর্বের পানি প্রবাহ নিয়ে আসলে শুধু কুষ্টিয়া না পুরো দক্ষিণাঞ্চলের ১০ জেলার মানুষ, কৃষি, সুন্দরবণ উপকৃত হবে।
পরিবেশ কর্মি গৌতম কুমার রায় বলেন, গড়াই নদী পুনরুদ্ধার প্রকল্প এলাকায় বসবাসরত নানা শ্রেণী-পেশার জনগোষ্ঠী দীর্ঘদিন ধরে নদী খননের উদ্যোগ পুর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হলে মুলত এ গড়াই নদী স্থায়ী ভাবে ফিরে পেতে পারে তার হারিয়ে যাওয়া প্রবহমান যৌবন।
কুষ্টিয়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সুফি মোঃ রফিকুজ্জামান জানান, গড়াই নদীকে কেন্দ্র করে কুষ্টিয়ার তিনটি উপজেলায় প্রায় ১ হাজার হেক্টর এর সেচের আওতাভুক্ত। যেহেতু কুষ্টিয়া এলাকাটি জিকে সেচ এলাকা। সে জন্য এখানকার কৃষকরা খালের পানির উপরই বেশি নির্ভর। তার পরেও একেবারে নদী তীরবর্তী এলাকার কৃষক ও কৃষি কাজে জড়িত বেশ কিছু মানুষ প্রতি বছর ১ হাজার হেক্টর জমিতে ধান, ভুট্রাসহ নানা রকম ডাল চাষ করে থাকে। গড়াই শুকিয়ে যাওয়ায় আবাসিক এলাকায় টিউবওয়েলে পানি উঠছেই না গত প্রায় দুই মাস ধরে। তাপমাত্রাও বৃদ্ধি পেয়েছে। কুষ্টিয়া এলাকায় আগে শুনেছি ৩০ থেকে ৩৫ এর উপরে তাপমাত্রা উঠেনি এ বছর ৪২ দশমিক ৫ ডিগ্রী তাপমাত্রা উঠেছে। এর কারণ হিসেবে তিনি জানান, গড়াই নদী শুকিয়ে যাওয়া। গড়াইতে যদি পর্যাপ্ত পানি থাকতো তা হলে তাপমাত্রা এত উঠতো না।
অপরদিকে গড়াইকে কেন্দ্র করে যে কৃষি কাজ চলতো তাও হুমকিতে পড়েছে। অনেকে পানির আশায় চাষ করেছিল পরে রোদে পুড়ে পানির অভাবে নষ্ট হয়ে যায় ফসল। তিনি গড়াই নদীকে সারা বছর পানি প্রবাহ ধরে রাখার পরামর্শ দিয়ে জানান, কৃষি, জীব-বৈচিত্র্য রক্ষা, সুন্দরবনকে রক্ষা, দেশী প্রজাতির মাছ উৎপাদনসহ বিবিধ সুফল পেতে হলে গড়াই নদীকে সারা বছরই পানি প্রবাহ স্বাভাবিক রাখা জরুরী।
তবে নদীতে জাল দিয়ে মাছ ধরা, বাঁধ দিয়ে মাছের পোনা উৎপাদন এ সব কিছুই তিনি জানেন না বলে জানান। যদি হয়ে থাকে তা হলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানান তিনি।
অপরদিকে হঠাৎ করে চলতি বছর গত ১৯ ফেব্রুয়ারি থেকে সর্বশেষ জিকে তিনটি পাম্প এক সাথে নষ্ট হওয়ায় বন্ধ হয়ে যায়। তাতে কুষ্টিয়া সদর ও মিরপুর এবং চুয়াডাঙ্গা সদর ও আলমডাঙ্গাসহ এ চার উপজেলার কৃষকেরা চরম দুর্ভোগে পড়েন।
সেচপ্রকল্পের একটি দায়িত্বশীল সুত্র জানায়,পাম্প চালুর জন্য সেচ প্রকল্পের ইনটেক চ্যানেলে কমপক্ষে ১৪ ফুট উচ্চতায় পানি থাকা প্রয়োজন। কিন্ত পদ্মা নদীর পানি কমে যাওয়ায় ইনটেক চ্যানেলে পানির স্তর এখন মাত্র ১১ফুট ফলে পাম্প চালু করা সম্ভব হচ্ছে না।
গড়াই নদীকে স্থায়ী খনন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সারা বছর স্বাভাবিক নাব্যতা ফিরিয়ে আনা এবং জিকে পাম্প তিনটিকেই সচল রাখা হলে কুষ্টিয়া এলাকায় কৃষি কাজে দুর্ভোগ কমবে। পানির স্তর ফিরে আসবে রক্ষা পাবে এ অঞ্চলের জীব ও বৈচিত্র্য লবণাক্ততামুক্ত হবে আমাদের সুন্দরবন।
খালিদ সাইফুল, দৈনিক দেশতথ্য,২৪ মে ২০২৪

Discussion about this post