আমিনুল হক দিলু,বিয়ানীবাজার: কুশিয়ারা নামে বহুল পরিচিত নদীটি সীমান্ত নদী হিসেবে পরিচিত। এটি বাংলাদেশ-ভারতের একটি আন্তঃসীমান্ত নদী।
এ নদীর গভীরতা, পানির প্রবাহ এবং প্রশস্থতা অতীতের তুলনায় তেমন পরিবর্তিত হয়নি। তবে নদীর ভাঙনপ্রবণতা আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই নদী দিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে পাথর-বালু পরিবহন করা হয়। এ নদীর ভাটি অঞ্চল জোয়ার-ভাটার প্রভাবে প্রভাবিত। নদীটি বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক তৃতীয় শ্রেণির নৌপথ হিসেবে স্বীকৃত। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক কুশিয়ারা নদীর প্রদত্ত পরিচিতি নম্বর উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নদী নং ১৭।
জাতীয় হাওর ও নদীরক্ষা কমিশনের তথ্যমতে, কুশিয়ারার দৈর্ঘ্য প্রায় ২৮৮ কিলোমিটার, প্রসস্থ গড়ে ২৬৮ মিটার, সর্পিল প্রকৃতির বন্যা প্রবণ এই নদীতে নৌ-রোড প্রযোজ্য নয়। কুশিয়ারার উৎপত্তিস্থল অমলসিদে তলদেশ প্রায় শুকিয়ে যাওয়ায় শুষ্ক মৌসুমে বরাকের প্রায় ৮৫ভাগ প্রবাহ এই নদী দিয়ে প্রবাহিত হয়।
জানা যায়, কুশিয়ারা নদীর সাথে সম্পৃক্ত বিয়ানীবাজার উপজেলার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বিভিন্ন খাল মরে গেছে। পৌরসভার বাবুর খাল, কাকুরা খাল, করতি খাল, বাঘবাড়ী খাল, গদার খাল, জমাদার খাল, করল নদী, ঝরাপাতা খাল, মাটিজুরা নদী, গুন্ডাখালী খাল, কাপাশ খাল, কুড়া খাল, ভেউলর খাল, গোবিন্দশ্রী খালের অস্থিত্ব বিপন্ন। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, ছোট সেচ খালগুলো ভরাট হয়ে অকার্যকর হয়ে পড়ে। কোথাও কোথাও এসব সেচ খাল দখল করে ঘরবাড়ি, রাস্থাঘাটও তৈরি হয়েছে। ফলে বন্যা পিছু ছাড়ছেনা এ জনপদের মানুষের।
বন্যা মৌসুমে কুশিয়ারার এমন হিংস্রতার পেছনে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) গাফিলতির অভিযোগও উঠছে। তবে পাউবো বলছে, কুশিয়ারার খনন প্রকল্প একনেকে অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। এমনকি কয়েকটি শাখা নদীর উৎসমুখ ভরাট হয়ে যাওয়ায় কুশিয়ারার পানি প্রবাহে বাঁধাগ্রস্থ হচ্ছে। যার কারণে কুশিয়ারা অতিরিক্ত পানির চাপে ফুলে উঠছে। এতে করে নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধ ভেঙে কোথাও আবার উপচে এসে তীরবর্তী বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত করছে। এর বাইরে মানবসৃষ্ট অনেক কারণও যোগ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, প্রতিবছর বানের সময় পার্বত্য নদীগুলো দিয়ে প্রচুর পরিমাণে বালু আসে। সেই বালুগুলো যুগের পর যুগ নদীর তলদেশে জমতে জমতে নদীর নাব্যতা হ্রাস পেয়েছে। শুধু নদী-হাওর নয়, অনেক এলাকায় খাল দখল ও ভরাট হয়ে যাচ্ছে। যার ফলে অতিবৃষ্টিতে চরম জলাবদ্ধতা দেখা দিচ্ছে। এছাড়াও পাহাড়-টিলা কাটা ও অবাধে বৃক্ষনিধনের ফলে ভূমিক্ষয় দেখা দিচ্ছে, যা নদী-হাওরসহ সব ধরনের জলাভূমির তলদেশ ভরাট করে বন্যা পরিস্থিতি দুর্বিষহ করে তুলছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, জকিগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, গোলাপগঞ্জসহ আরোও অন্তত: ১০-১২টি উপজেলার নদী ও ছড়ার পানি নামে কুশিয়ারায়। যার কারণে শেওলা পয়েন্টে প্রচন্ড চাপ থাকে এই নদীটিতে। বেশ কয়েকটি নদী ও ছড়ার পানি পরিবহন করে মেঘনার দিকে ছুটে চলে কুশিয়ারা। এর বাইরে সুরমার চাপ কমাতে কাজ করে বিয়ানীবাজারের লুলা নদী। কিন্তু এই নদী কুশিয়ারা থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এতে করে অতিরিক্ত চাপে কুশিয়ারা ফুলে উঠে বারবার তলিয়ে যাচ্ছে বিয়ানীবাজার তথা পূর্ব সিলেটের বেশ কয়েকটি উপজেলা।
গণমাধ্যমকর্মী রেজাউল হক জানান, যত্রতত্র চুইচ গেট নির্মাণ করে পানি প্রবাহে বিঘ্ন সৃষ্টি করা হচ্ছে। বিয়ানীবাজারের কুড়ারবাজার ইউনিয়নের করতি খালের মুখে অপরিকল্পিতভাবে চুইচ গেট নির্মাণ করা হয়েছে। ফলে খালের নাব্যতা হারিয়েছে। গত ১০ বছর ধরে চুইচ গেইটের ফাঁকফোকড় দিয়ে কিছু পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এতে এই এলাকায় কুশিয়ারার চাপ থেকেই যাচ্ছে।
বিয়ানীবাজার দূর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সাধারণ সম্পাদক হাসান শাহরিয়ার বলেন, নদী-খাল খনন মানেই দুর্নীতি। একটা প্রকল্পও আলোর মুখে দেখেনি। কয়েকবছর আগে লুলা নদী খনন হলেও অনিয়মের কারণে সুফল মিলছেনা।
এ প্রসঙ্গে সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ বলেছেন, বারবার বন্যার জন্য নদী ভরাট হয়ে যাওয়াই দায়ী নয়। জলবায়ুর পরিবর্তনের বড় একটি প্রভাব রয়েছে। যার কারণে খুব অল্প সময়েই তলিয়ে যায় এ জনপদের বিস্তৃর্ণ এলাকা। তিনি আরও বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভারতের চেরাপুঞ্জিতে মাত্র ৪-৫ দিনে ১৬০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এই বিশাল জলরাশি যদি একমাস জুড়ে সিলেটে আসতো তাহলে বন্যা মোকাবিলা করতে হতো না। মূলত উজানের অস্বাভাবিক ঢল ও বৃষ্টিপাত এই অঞ্চলকে ডুবিয়েছে।
খালিদ সাইফুল // দৈনিক দেশতথ্য // ৯ জুলাই ২০২৪