জলবায়ু সংকটকে জীবন-মরণ সমস্যা উল্লেখ করে সম্মুখসারির তরুণরা জলবায়ু অর্থায়নের বিষয়ে প্রতিশ্রতি অবিলম্বে বাস্তবায়নে উন্নত দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা এ বৈশি^ক সমস্যা সমাধানে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় তরুণদের নেতৃত্ব, কম কার্বন নিঃসরণ, নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে স্থানান্তর, প্রকৃতি ভিত্তিক সমাধান, ক্ষতিপূরণ প্রদান এবং স্থানীয় অভিযোজন তরান্বিত করতে মতামত ব্যক্ত করেছেন। বুধবার (১০ই মার্চ) বিকালে ‘ইয়ুথ, ক্লাইমেট অ্যাকশন অ্যান্ড দ্য কমনওয়েলথ : ফিল্ড এক্সপেরিয়েন্স অ্যান্ড সলিউশনস’ বিষয়ক এক অনলাইন সংলাপে বক্তারা এসব মন্তব্য করেন। কমনওয়েলথ দিবস উপলক্ষে ইয়ুথনেট ফর ক্লাইমেট জাস্টিস ঢাকাস্থ ব্রিটিশ হাইকমিশন এবং কমনওয়েলথ সচিবালয়ের সহযোগিতায় এই ওয়েবিনারের আয়োজন করে।
ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের বিশেষ দূত আবুল কালাম আজাদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক এমপি। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে যোগ দেন সিরাজগঞ্জ ১-এর সংসদ সদস্য ও ক্লাইমেট পার্লামেন্টের চেয়ারম্যান তানভীর শাকিল জয়, জলবায়ু বিজ্ঞানী অধ্যাপক সালিমুল হক এবং কপ-২৬’র এশিয়া–প্যাসিফিক ও দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক রাষ্ট্রদূত কেন ও’ফ্লাহার্টি। তরুণ জলবায়ু কর্মী সোহানুর রহমানের সঞ্চালনায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রায় দু’শ প্রতিনিধি সংলাপে যুক্ত হন।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক এমপি বলেছেন, আমাদের সমাজের পরিবেশগত চ্যালেঞ্জের কারণে তরুণরাই প্রথম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাংলাদেশের বদ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ বর্তমান প্রজন্মের পক্ষ থেকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সেরা উপহার। বদ্বীপ পরিকল্পনায় দীর্ঘমেয়াদে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ, বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব কাটিয়ে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, পানি ও খাদ্য নিরাপত্তার পাশাপাশি পরিবেশগত স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করবে। বদ্বীপ পরিকল্পনার ভিশন হলো সময়ের পরিবর্তনের সাথে মানানসই অভিযোজন, ব্যাপক এবং কার্যকর কৌশল গ্রহণের মাধ্যমে একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলা।
যুব-নেতৃত্বাধীন বিভিন্ন সংগঠনের কার্যক্রমসমূহের প্রশংসা করে মন্ত্রী আরও বলেন, “ইয়ুথনেট ফর ক্লাইমেট জাস্টিস, কোস্টাল ইয়ুথ অ্যাকশন হাব, প্রতীকি যুব সংসদ, ব্রিটিশ কাউন্সিলের অ্যাক্টিভ সিটিজেনস-এর মতো যুব-নেতৃত্বাধীন সংগঠন ও নেটওর্য়াকগুলো জলবায়ু সমস্যা মোকাবিলায় মাঠ পর্যায়ে কাজ করছে। জাতীয় সংসদে তরুণদের দাবিকে স্বীকৃাত দিয়ে গ্রহ জনিত জরুরী অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে।’’
সংসদ সদস্য তানভীর শাকিল জয় বলেন, “আমি মনে করি আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলা করতে সক্ষম হবো কারণ আমাদের চারপাশের তরুণেরা জলবায়ু সুবিচার আদায়ে অনেক শক্তিশালী অবস্থানে। তারা যেমনি উদ্বিগ্ন পাশামাশি সক্রিয়ও। জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলন কপ-২৬’এ আমি যেভাবে তরুণদের নেতৃত্ব দিতে দেখেছি তা আমাকে অনেক আশাবাদী করে তুলেছে। তারা যেহেতু সোচ্চার হয়ে বিশ^ নেতাদের জবাবদিহিতার মুখোমুখি করেছে তাতে আমরা জলবায়ু সংকট মোকাবেলা করতে সক্ষম হবোই। তাই তরুণদের নীতি পরিকল্পনা প্রণয়ন থেকে শুরু করে বাস্তবায়ন সকল পর্যায়ে তাদের নেতৃত্ব ও অংশীদারিত্ব বাড়াতে হবে।’
এ সংলাপের সভাপতি ক্লাইমেট ভালনারাবেল ফোরাসের বিশেষ দূত আবুল কালাম আজাদ বলেন, “তরুণরা যে সমাধানগুলো উল্লেখ করেছে যেমন যুবদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করা, কার্বন নিঃসরণ হ্রাস, নবায়নযোগ্য জ্বালানীতে স্থানান্তর, প্রকৃতি ভিত্তিক সমাধান, স্থানীয় নেতৃত্বের অভিযোজন ইত্যাদি খুব দ্রুত ক্রমানুসারে বাস্তবায়িত হতে হবে৷ তরুণদের কাছে অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আপনারা আওয়াজ তুলুন এবং আপনার বন্ধুদের জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে সচেতন করুন। যাতে একসাথে আমরা একটি টেকসই পৃথিবী গড়তে পারি।’
এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চল এবং দক্ষিণ এশিয়ার জন্য কপ-২৬ এর আঞ্চলিক ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত কেন ও’ফ্লাহার্টি বলেন, “গ্লাসগো জলবায়ু চুক্তি এমন একটি সুযোগ তৈরি করেছে যেখানে দেশগুলো জলবায়ু বিষয়ক সিদ্ধান্ত গ্রহণে তরুণদের সম্পৃক্ত করতে সম্মত হয়েছে৷ তরুণদের কন্ঠস্বর অনুসরণ করে কপে জাতীয় প্রতিনিধি দলেও তাদের যুক্ত করতে সকল দেশ একমত পোষণ করেছে। আমরা যুক্তরাজ্য সরকার তরুণদের সাথে কাজ করতে চাই এবং যারা সবচেয়ে বেশি বিপদাপন্ন এবং ক্ষতিগ্রস্ত তাদের কাছ থেকে শিখতে চাই”। যুব নেতৃত্ব সম্পর্কে রাষ্ট্রদূত কেন বলেন, “যুব নেতৃত্ব কপ-২৬’র কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল এবং এটি আসন্ন কপ-২৭ সম্মেলনেও আমাদের একটি অন্যতম স্তম্ভ হয়ে থাকবে।
জলবায়ু বিজ্ঞানী অধ্যাপক সালিমুল হক বলেন, “আমাদের কথার বাইরে গিয়ে কাজ করতে হবে। সংলাপ, শুধু কথা, কথা, আর কথা হতে পারে না। তাহলে হবে শুধু ব্লা, ব্লা আর ব্লা। আমাদের জরুরী উদ্যোগের প্রয়োজন এবং যুবদের সেই কাজটি পরিচালিত করতে হবে।”
লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড বিষয়ে তিনি বলেন, “কয়েকদিন আগে প্রকাশিত আইপিসিসি রিপোর্ট জলবায়ু জনিত ক্ষয় ক্ষতি যে হচ্ছে সেই বার্তাকে আরও জোরদার করেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের এই ক্ষয়-ক্ষতি ধনী দেশগুলো সহ বিশ্বের সর্বত্র ঘটছে। ক্ষতিগ্রস্থরা তাদের জীবিকা, ঘরবাড়ি ও ফসল হারাচ্ছে। এখন প্রশ্ন হল সেই ভুক্তভোগীদের ক্ষতিপূরণ দিয়ে কে সাহায্য করবে?
ইয়ুথ প্যানেলে বক্তব্য রাখেন ফিজিতে যুব-নেতৃত্বাধীন সংগঠন ‘প্যাসিফিক আইল্যান্ডস স্টুডেন্টস ফাইটিং ক্লাইমেট চেঞ্জ’-এর ক্যাম্পেইনার বিশাল প্রসাদ ও কমনওয়েলথ ইয়ুথ ক্লাইমেট নেটওয়ার্কের সমন্বয়কারী লেনেকা রোডেন। বাংলাদেশের দুই তরুণ সিলেটের হুমায়রা আহমেদ জেবা এবং সাতক্ষীরার শাহিন আলম আন্তর্জাতিক যুব বক্তাদের সাথে তাদের মাঠ পর্যায়ের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন।
কমনওয়েলথ ইয়ুথ ক্লাইমেট নেটওয়ার্কের সমন্বয়কারী লেনেকা রোডেন বলেন, আমরা সবচেয়ে বিপদাপন্ন ব্যক্তিদের সহনশীলতা তৈরিতে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে সহায়তার বিষয়ে অগ্রাধিকার দিয়ে তররুণদের এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের অধিকারকে সম্মান করি৷”
‘প্যাসিফিক আইল্যান্ডস স্টুডেন্টস ফাইটিং ক্লাইমেট চেঞ্জ’-এর বিশাল প্রসাদ, জলবায়ু সংকট থেকে উদ্ভূত বৈষম্য মোকাবিলার অন্যতম উপায় হিসেবে আন্তর্জাতিক বিচার আদালত থেকে পরামর্শমূলক মতামত চাওয়া তাদের প্রচারণার লক্ষ্য। তিনি বলেন, “সারা বিশ্বে তরুণরা জলবায়ু নেতৃত্ব, সংকল্প এবং দৃঢ়তা প্রদর্শনে দৃষ্টান্তমূলক ভাবে এগিয়ে এসেছে। “
ইয়ুথনেট ফর ক্লাইমেট জাস্টিসের জাতীয় সমন্বয়কারী শাকিলা ইসলাম তার স্বাগত বক্তব্যে বলেন, ‘জলবায়ুু ন্যায়বিচারের জন্য আমাদের লড়াইয়ে বিপদাপন্ন সম্প্রদায়েে কণ্ঠকে প্রসারিত এবং কেন্দ্রীভূত করতে হবে। বিশ্বের সর্বোচ্চ কার্বন নির্গমনকারী দেশগুলোকে অবশ্যই অভিযোজনের জন্য পর্যাপ্ত জলবায়ু নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ করে স্থানীয়ভাবে পরিচালিত অভিযোজন যা লিঙ্গ বৈষম্যকেও হ্রাস করে, একই সময়ে অবিলম্বে কার্বন নির্গমন হ্রাস করে।”
এবি//দৈনিক দেশতথ্য//১২ মার্চ, ২০২২//
প্রিন্ট করুন
Discussion about this post