চিকিৎসার আর্থিক অনুদানের টাকা পেতেও দিতে হয় আবেদন প্রতি ১০ হাজার টাকা
টাকা না দিলে কোন সরকারি নাগরিক সুবিধা বা সেবা মেলেনা কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়ে। আর টাকা না পেলে ফাইল আটকে রাখার অভিযোগ উঠেছে উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলীর বিরুদ্ধে।
অভিযোগ উঠেছে কুমারখালী উপজেলা সমাজসেবা আওতাভুক্ত নিবন্ধিত বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন, ক্লাব, লাইব্রেরির কমিটি অনুমোদন, নিবন্ধিত সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন, ক্লাব, লাইব্রেরিতে আসা অনুদানের চেক বিতরণে অর্থ আদায়, সমাজসেবা অধিদপ্তর কর্তৃক ঋণ বিতরণ অনিয়ম, দুরারোগ্য অসুস্থ রোগিদের আর্থিক সহায়তা কর্মসূচিতে অনিয়ম, বয়স্ক ও বিধবা ভাতা এবং প্রতিবন্ধী ভাতাসহ প্রতিবন্ধী পরিচয়পত্র প্রদানেও অর্থ নেওয়ার অভিযোগ সমাজসেবা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। আর এসব কর্মকাণ্ড চলে আসছে সমাজসেবা কর্মকর্তা মোহাম্মাদ আলী ২০১৮ সালে কুমারখালী সমাজসেবা কার্যালয়ে যোগদানের পর থেকেই। যোগদানের পরই এসব অনিয়মকে নিয়মে পরিনত করেছেন এই কর্মকর্তা।
একাধিক ভুক্তভোগী জানান, সমাজসেবা কর্মকর্তা মোহাম্মাদ আলী কুমারখালীতে যোগদানের পর থেকেই সমাজসেবা আওতাভুক্ত নিবন্ধিত বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন, ক্লাব, লাইব্রেরির কমিটি অনুমোদন করতে জোরপূর্বক টাকা নেন। টাকা না দিলে কমিটির অনুমোদন না দিয়ে ফাইল আটকে রাখেন। টাকা দিলেই তার পর তিনি ফাইলে স্বাক্ষর করেন।
এই টাকা নেওয়ারও আবার কয়েকটা ক্যাটাগরি নির্ধারণ করে রাখা হয়েছে অলিখিতভাবে, যারা নিবন্ধন করে সুধুমাত্র কমিটি অনুমোদন করেন তাদের কাছ থেকে নেওয়া হয় ১ হাজার ৫শ থেকে ২ হাজার টাকা, আবার যাদের নিবন্ধন আছে মাঝে মধ্যে সরকারি অনুদান পান তাদের কমিটি অনুমোদন করতে ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা লাগে।
যারা নিবন্ধন নিয়ে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করেন তাদের কমিটি অনুমোদনের খরচ কিছুটা বেশি নেওয়া হয়ে থাকে। তাদের কমিটি অনুমোদন করতে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয়ে থাকে। অডিট করতেও একই পদ্ধতিতে টাকা দিতে হয় তাকে। আর টাকা না দিতে চাইলে বা টাকার পরিমানে সন্তুষ্ট না হলে অডিট আপত্তি দিয়ে নিবন্ধন বাতিলেরও হুমকি দেওয়া হয়। পরে এক প্রকার বাধ্য হয়েই এসব সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন, ক্লাব, লাইব্রেরি সংশ্লিষ্টরা টাকা প্রদান করেন সমাজসেবা কর্মকর্তা মোহাম্মাদ আলীকে। আর এই টাকা মোহাম্মাদ আলী নিজে হাতেই নিয়ে থাকেন। আবার কারো কাছ থেকে উপহার সামগ্রীও নেন এই কর্মকর্তা। অভিযোগ রয়েছে সমাজসেবার অনুমোদিত একটি অবৈধ ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম পরিচালনাকারী সংস্থার কাছ থেকে জোরপূর্বক সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের প্রাপ্ত সরকারি চাকরি বিধির সুযোগ সুবিধা অনুযায়ী অফিস কক্ষে এসি লাগানোর নিয়ম না থাকলেও এই কর্মকর্তা অফিসের নিজের কক্ষে এসি লাগিয়েছেন। এই এসির অতিরিক্ত বিদ্যুৎ বিল সরকারকেই বহন করতে হচ্ছে। সুধু অফিসেই নয় মোহাম্মাদ আলী ওই ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম পরিচালনাকারী সংস্থাকে দিয়ে নিজের বাসার জন্যও এসি লাগিয়ে নিয়েছেন।
নিবন্ধিত সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন, ক্লাব, লাইব্রেরিতে সমাজসেবা অধিদপ্তর কর্তৃক আসা সরকারি অনুদানের চেক বিতরণেও অর্থ আদায় করেন এই কর্মকর্তা। অনুদান আসা টাকার ওপর ১০ শতাংশ হারে উৎকোচ আদায় করেন এই সমাজসেবা কর্মকর্তা। আবার সমাজসেবা অধিদপ্তর কর্তৃক পল্লী অঞ্চলে বসবাসরত দুঃস্থ, অসহায়, অবহেলিত, অনগ্রসর ও পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে পরিচালিত সুদমুক্ত ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের ঋণ বিতরণেও রয়েছে অনিয়ম। বিভিন্ন সময় সমাজসেবা কার্যালয়ে বিভিন্ন ধরনের ভাতা বা চিকিৎসার জন্য আবেদন করা ব্যক্তিদের এনআইডি কার্ড ও ছবি ব্যবহার করে তাদের না জানিয়ে ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছেন সমাজসেবা কর্মকর্তা মোহাম্মাদ আলী নিজেই। তাকে দেখে এই পদ্ধতিতে সুধমুক্ত ঋণ নিয়েছেন তার অফিসের একাধিক কর্মচারী।
এ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ এখানেই থেমে নেই দুরারোগ্য ক্যান্সার, কিডনী, লিভার সিরোসিস, স্ট্রোকে প্যারালাইজড, জন্মগত হৃদরোগ এবং থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত অসুস্থ রোগিদের আর্থিক সহায়তার কথা থাকলেও টাকার বিনিময়ে চিকিৎসকের নকল ব্যবস্থাপত্র, টেস্টের নকল রিপোর্ট দিয়ে সুস্থ ব্যক্তিদেরকে চিকিৎসার আর্থিক অনুদান পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। চিকিৎসার আর্থিক অনুদানের টাকা পেতে ওই কর্মকর্তাকে দিতে হয় আবেদন প্রতি ১০ হাজার টাকা আর সাথে বানিয়ে দিতে হয় নকল কাগজপত্র। তবে এই টাকাটা নেন অনুদানের চেক আসার পরে। আবার বয়স্ক ও বিধবা ভাতা এবং প্রতিবন্ধী ভাতাসহ প্রতিবন্ধীর পরিচয়পত্র প্রদানেও টাকা নিতে কোন ছাড় দেননা তবে এসব টাকা তিনি সরাসরি নিজে হাতে নেন না। এসব টাকা নেন তার এজেন্ট কুমারখালী উপজেলার কয়া ইউনিয়নের সাবেক ইউপি সদস্য পশু চিকিৎসক হাবিবের মাধ্যমে। হাবিব বিভিন্ন এলাকা থেকে বিধবা, বয়স্ক ও প্রতিবন্ধী খুঁজে বেড় করেন তার লোকদের মাধ্যমে। এর পর এদের মধ্যে যারা ৫ থেকে ৭ হাজার টাকা দিতে পারেন তাদেরকে বিধবা, বয়স্ক ও প্রতিবন্ধী ভাতাভোগী হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়। এর বিনিময়ে সমাজ সেবা কর্মকর্তা তার এজেন্ট হাবিবকে নিদৃষ্ট হারে কমিশন প্রদান করেন।
এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগের এখানেই শেষ নয় গত ইউপি নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকার সময় কয়া ইউনিয়নের এক চেয়ারম্যান প্রার্থী ও একজন ইউপি সদস্য প্রার্থীকে জিতিয়ে দেওয়ার কথা বলে তাদের কাছে ৫ লক্ষ টাকা দাবী করেন। পরে তাদের কাছ থেকে ৪ লক্ষ টাকা নিজে হাতে তার নিজ কার্যালয়ে বসে নেন সমাজসেবা কর্মকর্তা মোহাম্মাদ আলী। খামে করে ১ হাজার টাকার দুই বান্ডিলে ২ লক্ষ ও ৫শ টাকার ৪ বান্ডিলে ২ লক্ষ টাকাসহ মোট ৪ লক্ষ টাকা নেন ওই কর্মকর্তা। আর এই টাকা অফিসে গিয়ে অফিস চলাকালীন সময়ে দিয়ে আসেন ওই দুই প্রার্থীর প্রতিনিধি। টাকা নেওয়ার পর ওই দুই প্রার্থীর পক্ষে কাজও করেন।
এবি//দৈনিক দেশতথ্য//আগস্ট ২২,২০২২//