এনামুল হক কুষ্টিয়া:
বৈশ্বিক উষ্ণায়নে উর্দ্ধগামী তীব্র তাপদাহ মোকাবিলায় কার্যকরী কোন উদ্যোগ না থাকায় প্রতি বছরই শুষ্ক মৌসুমে বাড়তি মাত্রায় জীবন দুর্বিসহ হয়ে উঠছে ৩ জেলার জনজীবন, কৃষি ও জীববৈচিত্র।
একদিকে গত ৬বছর ধরে দেশের বৃহ সেচ সেচপ্রকল্প গঙ্গাকপোতাক্ষ বা জিকে’র সেচসরবরাহের পাম্প হাউজ অকেজো থাকায় অস্তিত্বহীন ভু-উপরিস্থ জলাধার, এতে গৃহস্থালি ও পানীয় জলস্তরের উপর ভর করে কৃষিসহ সকল চাহিদা পূরনের মাত্রাতিরিক্ত চাপ পড়ায় চরম বিপন্নের মুখে দেশের উদ্ধৃত্ত খাদ্য উৎপাদনের ৩ জেলা কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুরের জীববৈচিত্র ও কৃষি।
তিন জেলার কৃষি বিভাগের পরিসংখ্যান মতে, ‘এখানে প্রায় ২লাখ ৩২ হাজার হেক্টর সেচযোগ্য অতি উর্বর তিন ফসলী জমিতে সেচ সরবরাহে চালু রয়েছে গভীর নলকুপ- ৫৮৩টি, এলএলপি- ৩২৭টি এবং অগভীর নলকুপের সংখ্যা- ১ লক্ষ ১৩হাজার ৯শ ৫১টি। এই পরিসংখ্যানের ভয়াবহ চিত্রই বলে দেয় যে সরাসরি গৃহস্থালি ও জীববৈচিত্র রক্ষায় ভুগর্ভস্থ পানির যোগানস্তরের উপর কৃষি কাজের সেচ সরবরাহে ব্যবহৃত প্রায় সোয়া লাখ অগভীর নলকুপে পানির যোগান দিতে অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে ভু-গর্ভস্থ পানিস্তর। প্রতিনিয়ত পানীয় জলের নির্ধারিত মজুতকে ক্ষয়ে দেয়ার মাত্রা উর্দ্ধগামী করে তুলেছে।
এমন পরিস্থিতির ভয়বহ চিত্র তুলে ধরে সংকট নিরসরনর দাবি ভুক্তভোগী জনগোষ্ঠী ও কৃষকের। জরুরী ভিত্তিতে প্রাধিকার বিবেচনায় নিয়ে পরিস্থিতি উত্তোরনে পরিকল্পিত পানি ব্যবস্থাপনা গ্রহনের পরামর্শ সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞের। তবে তাৎক্ষনিক ভাবে বিকল্প উপায়ে বৃহৎ ক্ষেত্রে নিরাপদ সেচ ব্যবস্থাপনা সম্প্রসারণে ইতিবাচক সম্ভাবনার চিত্র তুলে ধরে পরিস্থিতি মোকাবিলায় আগাম প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা কথার জানালেন সংশ্লিষ্ট বিএডিসি’র প্রকল্প কর্মকর্তা।
কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার কবরবাড়িয়া গ্রামের রাবিয়া খাতুন বলেন,‘পানির সমেস্যা কি একটু আইট্টু হয়চে নাকি ? পানির অভাবে সেচ দিতি না পাইরি ধানের মাঠ ফাইটি ছেড়াবেড়া হয়ে গেচে। একন আমরা ছাওয়াল পাল লিয়ে কি খাবো সেই চিন্তাই করতিচি, বাড়িত টিউকলের পানিও ওটতেচে না; গরু বাচুর, ছাগল বকরি, হাঁস মুরগী লিয়ে একন কোন যাই কি করি, কোন দিশা হচ্চেনা’। কবে ইর সুমাধান হবি আর কবেই বাঁচতি পারবো, সেই বেবেস্তা সরকার কইরি দিক’।
মেহেরপুর সদর উপজেলার ফতেপুর গ্রামের কৃষক মিরাউল হক জানায়, ‘আমারে যত কষ্ট এই শুষ্ক মৌসুমে, ধরেন সারা বছরই আমারে এই মাঠে আবাদ করি বাঁচতি হয় শ্যালো পাম্পের (অগভীর নলকুপ) পনির উপর। প্রতি বছরই নতুন নতুন কইরি পানির লিয়ার (স্তর) নীচে নাইমি যাচ্ছে। দেকা যাইচ্ছে, ২ থেইকি ৫ ঘন্টা পর্যন্ত মটর চালিউ এক বিগি ভুঁই ভিজাইত পাচ্চিনি’। এতে যে খচ্চা হইচ্চে, তাতে আবাদ কইরি খরচই উইটপে না। সরকার যদি মাটের মধ্যি মধ্যি মোটা পাইপের ডিপটি (গভীর নলকুপ) বসা দিতি তাহলি হয়ত আমারে জানডা এট্টু বাঁইচতি’।
পরিবেশবিদ গৌতম কুমার রায় বলেন, ‘আমাদের জীবনের মূল চলকশক্তি হলো পানি। পৃথিবীর মধ্যে বাংলাদেশীরাই ভাগ্যবান যে এতো সহজে সু-পেয় পানির চাহিদা পুরন করছি যা পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশেও এমন এ্যাক্সেস নাই। অথচ সমন্বিত পরিকল্পনার অভাবে পানির মর্ম না বুঝতে পারায় আমরা দিন দিন মরুময়তার দিতে ধাবিত হচ্ছি। বর্ষা মৌসুমের যে পানি আমরা পায় সেগুলিকে যদি ধরে রাখার জলাধার সৃষ্টি করতে পারতাম তাহলে আজ এমন হাপিত্যেস করতে হতো না। আমাদের সমুদ্র উপকুলের মানুষ জীবন ধারনের জন্য বর্ষা মৌসুমের পানি ধরে রেখে সারা বছর সু-পেয় পানির সংস্থান করে থাকে। এমন উদাহরণ তো আমাদের দেশেই আছে; মানুষ তার প্রয়োজনে সব পারে’। আজকে আমাদের ভু-গর্ভস্থ সু-পেয় পানির স্তরের উপর যে মাত্রাতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে গৃহস্থালী ও জীববৈচিত্রকে ঝুঁকিপূর্ন করে তোলা হয়েছে সেই সংকট উত্তোরনে এখনই কার্যকরী উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ হলে অবশ্যম্ভাবী মহামারি থেকে আমরা কেউই মুক্ত হবো না।
কুষ্টিয়া জনস্বাস্থ্য বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী ইব্রাহিম মো: তৈমুর বলেন, ‘বৈশি^ক উষ্ণায়নে উর্দ্ধগামী তাপদাহে জীববৈচিত্রসহ পরিবেশ বিপর্যয়ের ভয়াবহতা থেকে উত্তোরনে প্রাধিকার বিবেচনায় সমন্বিত পরিকল্পা গ্রহন এবং পানি সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলির পক্ষ থেকে বাস্তবানুগ উদ্যোগ নেয়া ছাড়া কোন বিকল্প পথ নেই। এক্ষেত্রে ভু-উপরিস্থ জলাধার সংরক্ষন এবং অত্যবশ্যক প্রয়োজন বিবেচনায় গভীর নলকুল স্থাপন করে ভু-গর্ভস্থ অগভীর স্তরের সু-পেয় পানির মজুত সুরক্ষার উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। না হলে প্রতি বছরই পানির এই স্তর ক্ষয়ে যাওয়ার ফলে বর্তমানে বছরের প্রায় ৬মাস পানির লেয়ার সংকটে থাকে অগভীর স্তরের পানি সংগ্রহের যন্ত্রগুলি। আগামীতে হয়ত এই সংকটকালের পরিধি ক্রমশ: উর্দ্ধগামী হতেই থাকবে; কারণ বিজ্ঞানীরা বলছেন আগামী ২০৭০ সাল নাগাদ অতিরিক্ত আরও ৩ ডিগ্রী তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাবে। সেক্ষেত্রে দেশের দক্ষিন-পশ্চিমাঞ্চলের কয়েকটি জেলার ভু-গর্ভস্থ পানির মজুত সংকট নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যেতে পারে।
কৃষি জমিতে নিরাপদ ও সাশ্রয়ী খরচে সেচ সরবরাহে অতি নগন্য বা অপ্রতুল হলেও বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশ বিএডিসি গভীর নলকুপ ও এলএলপি পাম্পের মাধ্যেমে উপরিস্থ জলাধারের পানি থেকে সেচ ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করে চাষীদের ফসল উৎপাদন খরচ হ্রাসের যে দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে তার বিবরণ তুলে ধরার পাশাপশি এই ধরনের সেচ ব্যবস্থা আরও শতগুন বেশী সম্প্রসারনের দাবি চাষীদের।
চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার দিগড়ী গ্রামের সুভিধাভোগী চাষী দেলুয়ার হোসেন বলেন, ‘আমাদের মাঠ অতি উর্বব দো’আশ মাটি হলেও অনেক উচু হওয়ায় সেচ সংকটে দীর্ঘদিন ধরেই দো-ফসলি ছিলো। গত দুই বছর আগে বিএডিসির ‘মজিবনগর সেচ সম্প্রসারণ প্রকল্প’ গভীর নলকুল স্থাপন করে এর আশপাশে প্রায় ৩শ বিঘা জমি এখন তিন ফসলি হয়ে উঠেছে। বিদ্যুৎ চালিত সরকারী এই পাম্পে একদিকে সীমিত সেচ খরচ অন্যদিনে পূর্বে এই তিন’শ বিঘা জমিতে ছিলো ৭২টি অগভীর শ্যালো এখন বন্ধ হয়ে গেছে।
মেহেরপুরের রশিকপুর গ্রামের চাষী তাহের উদ্দিন বলেন, দুই বছর আগে আমাদের ভৈরব নদীর পানি দিয়ে সেচের ব্যবস্থা করে দিয়েছে বিএডিস

Discussion about this post