শেখ জাহাঙ্গীর আলম শাহীন, লালমনিরহাট:
জেলার বুক চিরে প্রবাহিত হয়েছে নদী তিস্তা। পানি শূন্য চরে এ বছর ব্যাপক হারে রবি ফসল চাষ করেছে। একরের পর একর জমিজুড়ে আবাদ করা হয়েছে পিয়াজ, ভুট্টা, গম, বাদাম, আলু, মরিচ, মিষ্টি আলু, মিষ্টিকুমড়া, মরিচ, সরিষা, তামাক, গাঁজর, ধান, ধনিয়াপাতা সহ নানা শাকসবজি।ফসলের এসব খেতে কাজ করছেন কৃষক কৃষাণী ও কয়েক শত দিনমজুর কৃষি শ্রমিক। কেউ সেচযন্ত্রে (শ্যালো মেশিন), কেউ বা সৌরচালিত আবার কেউ বা বৈদ্যুতিক পাম্প দিয়ে খেতে পানি দিচ্ছেন। কেউ নিড়ানি দিচ্ছেন। আবার কেউ আগাছা তুলছেন। কর্মব্যস্ত তিস্তা পাড়ের নদীকূলের কৃষি ও দিনমজুর পরিবার গুলো। সবার স্বপ্ন বাম্পার ফলন হবে। সেই স্বপ্নের প্রধান বাঁধাও আছে, তা হচ্ছে উজানি ঢলে হরকার (আকস্মিক) বন্যায় ফসলহানির আশস্কা।
গত বর্ষা মৌসুমে বন্যার কারনে এবারে তিস্তার চরে বাম্পার ফলন হয়েছে, সেই বন্যার আশস্কায় ফসলহানিতে ভুগছে কৃষক পরিবার গুলো। কৃষক পরিবার গুলোর দাবী সরকারের উচ্চ পর্যায়ে যাতে আলোচনা করে রাখে তিস্তায় উজানের ঢল যেন শুস্কমৌসুমে হঠাৎ না ছাড়ে। যাতে কমপক্ষে উঠতি ফসল তোলার সময় দেয়। অনেকে শিক্ষিত বেকার ধার দেনা করে প্রজেক্ট আকারে আলু, গম, ভুট্টা, গাঁজর চাষ করেছে। এসব প্রজেক্টে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে।
জেলার লালমনিরহাট সদর উপজেলা, আদিতমারী উপজেলা, কালীগঞ্জ উপজেলা, হাতীবান্ধা উপজেলা ও পাটগ্রাম উপজেলার উপর দিয়ে প্রায় ১৩৫ কিলোমিটার তিস্তা নদী প্রবাহিত। কোথাও এর প্রস্থ ৮ হতে ১২ কিলোমিটার। শুস্কমৌসুমে বিশাল চর জেগে উঠেছে। বিস্তৃত চরে এখন আবাদ হচ্ছে রবি ফসল। অথচ কয়েক বছর আগেও অবস্থা এ রকম ছিল না। মাঠের পর মাঠ পরে থাকত ধু ধু বালুচর। তিস্তা বর্ষা ও শুস্ক দুই মৌসুমে ছিল মানুষের কাছে অভিশাপ । এখন দিন পাল্টে গেছে। তিস্তার চরের বালুর এসব জমিতে এখন নানা রকমের শাকসবজি ফলিয়ে আয় করছেন স্থানীয় কৃষকেরা।
গত কয়েক বছরের চেয়ে এবার দুই উপজেলায় সর্বাধিক রবিশস্যের আবাদ হয়েছে। কারণ, গত বছরের বন্যার পর এবার চরে পলি পড়েছে বেশি। গত বর্ষা মৌসুমে ভারতের ৪০০ বছরের পুরনো একটি বাঁধ ভেঙ্গে যায়। সেই বাঁধের পলিমাটি প্রবাহিত হয়ে আসে তিস্তা নদী দিয়ে। গোটা তিস্তায় বালুতে জমে যায় প্রায় ৪ ইঞ্চি পুরুত্বের পলি জমে যায়। সেই পলির কারনে ফসল হয়েছে সবুজের সমারোহ।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রমতে, ‘তিস্তা ও ধরলা নদী বাংলাদেশ-ভারতের আন্তসীমান্ত নদী। এ নদী দুটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের জলপাইগুড়ি ও কোচবিহার জেলা হয়েস প্রবাহিত। গতিপথ পরিবর্তন করে উপজেলা দহগ্রাম ইউনিয়নের বৃহত্তর অংশ জুড়ে বয়ে চলেছে তিস্তা। মূলত দহগ্রাম হতে আবার ভারত হয়ে চলে গেছে পরে আবার ভারত হয়ে পাশের হাতীবান্ধায় তিস্তা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এভাবে কুড়িগ্রামে গিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদে গিয়ে মিশে গেছে। অপরদিকে ভারতের চ্যাংড়াবান্দা হয়ে পাটগ্রামে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে ধরলা নদী। পাটগ্রাম উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে আবারও ভারতে ঢুকেছে। এভাবে আবারও লালমনিরহাট সদর উপজেলার মোগলহাট ইউনিয়নে ধরলা নদী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। নদী দুইটির প্রবশে মুখে ভারত সরকার বাঁধ তৈরি করেছে। এতে করে ভারত এই নদী দুইটির পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। তারা শুস্কমৌসুমে পুরো পানি প্রত্যাহার করে নেয় আবার বর্ষা অতিরিক্ত পানি ছেড়ে দেয়। এতে দেশের বিস্তীর্ণ এলাকা পানিতে প্লাবিত হয়। ২০২৩ সালের (গত বছর) ৪ অক্টোবর ও ১৮ অক্টোবর উজান হতে আকস্মিক ঢল ছেড়ে দেওয়া তিস্তা নদীর উপকূল দহগ্রাম সহ তিস্তা পাড়ের কমপক্ষে ৫৫টি গ্রামে প্রবল বন্যা দেখা দেয়। বর্তমানে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তিস্তা নদীল পানির তোড়ে প্রতিবছর দহগ্রাম ছিটমহলটির জমি ভেঙে বিলীন হয়ে যাচ্ছে তিস্তা নদী গর্ভে। এমন চলতে থাকলে বাংলাদেশের মানচিত্র হতে একদিন হারিয়ে যাবে দহগ্রাম আঙ্গোরপোতা ছিটমহলটি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কার্যালয় সূত্র জানায়, হাতীবান্ধা উপজেলায় ২৩ হাজার ৫২৭ হেক্টর আবাদযোগ্য জমি আছে। শুধু তিস্তার চরে ভুট্টার চাষ হয়েছে ১ হাজার ৮৯৭ হেক্টর জমিতে। এ ছাড়া গম ১৫ হেক্টর, আলু ১৫ হেক্টর, মরিচ ১০ হেক্টর, চিনাবাদাম ৭৫ হেক্টর জমিতে আবাদ হচ্ছে। আর পাটগ্রাম উপজেলায় ২১ হাজার ২৬০ হেক্টর চাষযোগ্য আবাদি জমি রয়েছে। এবার উপজেলার দহগ্রাম তিস্তার চর ও জগতবেড় এবং জোংড়া ইউনিয়নের ধরলা নদীর চরাঞ্চলে ভুট্টা আবাদ হচ্ছে ৬৫ হেক্টর জমিতে। একই সঙ্গে গম ২৫ হেক্টর, আলু ১৫ হেক্টর, মিষ্টিকুমড়া ৮ হেক্টর জমিতে চাষ করা হচ্ছে। জেলায় তিস্তার চরাঞ্চল নিয়ে কোন পৃথক হিসেব কৃষি বিভাগের কাছে নেই। তি স্তার চরাঞ্চলের কৃষি নিয়েও কোন পৃথক পরিকল্পনা কৃষি বিভাগের নেই। তারা জেলার কৃষির মধ্যে চরের কৃষিকে অন্তর্ভুক্ত করে রেখেছে। চরের কৃষক ও কৃষি নিয়ে কৃষি বিভাগের কোন মাথা ব্যাথা নেই। তিস্তা ও ধরলা চরের কৃষি যে, পৃথক কৃষি পরিকল্পনায় হয়ে আসছে সেটার পুরো কৃত্রিত্ব চরের কৃষকের।
পাটগ্রামের কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ আবদুল গাফ্ফার ও হাতীবান্ধা কৃষি কর্মকর্তা মো. সুমন মিয়া জানান, বর্ষার শেষ দিকে তিস্তা ও ধরলা নদীতে হরকা বন্যা হয়। এতে বর্ষা মৌসুমের বন্যার পানির সাথে ব্যাপক ঘোলা পানি আসে। শুস্কমৌসুমে নদীর পানি স্থির হলে সেই ঘোলা পানি চর গুলোতে কাদামাটির আস্তরন ফেলে, সেইটি মূলত পলিমাটি। এতে স্থানীয় কৃষকেরা সবাই তিস্তার চরে চাষাবাদে ঝুঁকে পড়েছে। এবারে ফসল ফলেছে বাম্পার। কম খরচে ফসল বেশ ভালো হয়েছে। রবি ফসল আলু, বেগুন, কপি ও সবজিতে কৃষক দামও পেয়েছে। বাড়তি পেঁয়াজ, রসুন, কাউন, ধান, তামাক, গম, ভুট্টা ফসল চরে রয়েছে। কৃষকের ভয় আকস্মিক বন্যার। যদি আকস্মিক বন্যা না হয়, ফলন ভালো হবে। তাঁরা অনুমান করছেন, এসব চরে উৎপাদিত ফসলের মূল্য পুরো তিস্তার চরে প্রায় ৮ লাখ হেক্টরে একশত কোটি টাকা হবে। তিস্তা চরের কৃষি রংপুর বিভাগের ৮টি জেলা কে ঘিরে। ৮টি জেলায় তিস্তা নদীর চরে প্রায় একশত কোটি টাকার কৃষি শস্য উৎপাদন হয়। ২০২৩ সালে ৪ অক্টোবরের বন্যায় শুধুমাত্র লালমনিরহাট জেলায় ক্ষতি হয়েছে একশত কোটি টাকা। এই ক্ষয়ক্ষতি জেলা প্রশাসন নিধারণ করেছে।
বড়খাতা কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক ভুট্টা সহ কৃষি ঋণ বিতারণ করেছে এ বছর প্রায় একশত কোটি টাকা। উপজেলা কৃষি কার্যালয় থেকে চরাঞ্চলে চাষাবাদে জন্য পৃথক কোন কর্মসূচি নেই। তবে চরের কৃষক প্রয়োজনমত সকল পরামর্শ পেয়ে আসছে। কৃষকদের চাহিদা মত প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। তবে চরের কৃষি ও কৃষক নিয়ে পৃথক সরকারি কার্যক্রম গ্রহন করলে অর্থনৈতিক ভাবে দেশ ও কৃষি অনেক এগিয়ে যাবে।
বাংলাদেশের সাথে ভারতের ৫৪টি অভিন্ন নদী রয়েছে এরমধ্যে কুশিয়ারি নদী ছাড়া কোন নদীর পানি বন্টন চুক্তি বাংলাদেশের সাথে নেই। এমন কী বর্ষা মৌসুমের ৬ মাস ছাড়া ভারতের সাথে অভিন্ন নদীর পানি প্রবাহের তথ্য বা আকস্মিক বন্যার তথ্য আগাম সর্তকতা হিসেবে বাংলাদেশ সরকারের পানি উন্নয়ন বোর্ডকে জানায় না। পুরো বছর যাতে আগাম তথ্য জানানো হয়। এ বিষয়ে দাবী উঠেছে। লালমনিরহাট জেলার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ উল্ল্যাহ জানান, তিস্তা চরের উজানি ঢলের খবর ভারত জানালে তাৎক্ষণিক পানি উন্নয়ন বোর্ডের সূত্রে জানানো হয়। ভারত হরকার বন্যার খবর জানালে আমরা দ্রুত চরাঞ্চলের মানুষ কে জানাব। ফসল রক্ষায় হঠাৎ যাতে শুস্কমৌসুমে বন্যা না আসে বিষয়টি সরকারকে জাননো হবে। আপনারাও পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাথে যোগাযোগ রাখবেন।
শুষ্ক মৌসুমে তিস্তার বুকে জেগে ওঠে চর। এতে আবাদ হয় ভুট্টা, আলু, মিষ্টিকুমড়া, পেঁয়াজ, রসুনসহ নানা শস্য। ভোর থেকেই শুরু হয় কর্মচাঞ্চল্য। সারা দিন ব্যস্ত সময় কাটে কিষান-কিষানির। তিস্তার রংপুরের গঙ্গাচড়া অংশ থেকে ছবিগুলো সম্প্রতি তোলা।
দৈনিক দেশতথ্য//এইচ//
![প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন](http://dailydeshtottoh.com/wp-content/plugins/wp-print/images/printer_famfamfam.gif)
Discussion about this post