এস আর সেলিম
দেশের অন্যান্য স্থানের মতো কুষ্টিয়ার দৌলতপুরেও আজ রোববার তৃতীয় ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। উপজেলার ১৪ ইউনিয়নের ১৫১টি কেন্দ্রে সকাল ৮টা থেকে শুরু হয়ে টানা বিকেল ৪টা পর্যন্ত ভোটগ্রহণ চলবে। নির্বাচন উপলক্ষে প্রশাসনের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। গতকাল শনিবার কেন্দ্রগুলোতে ভোটগ্রহণের সরঞ্জাম পৌঁছে দেয়া হয়। তবে দুটি দুর্গম ইউনিয়ন ছাড়া অন্য ইউনিয়নগুলোতে ব্যালট পেপার পৌঁছানো হবে আজ রোববার সকালে। উপজেলায় ২ হাজার ৮৬৩ জন কর্মকর্তা ভোটগ্রহণের দায়িত্বে রয়েছেন। ১ হাজার ৬শর বেশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও ২ হাজার ৮শর মতো আনসার সদস্য নির্বাচনে নিয়োজিত থাকবেন। চিলমারী ও রামকৃষ্ণপুর ইউনিয়নে গতকাল ব্যালট পেপার নিয়ে যাওয়া হলেও তা রাখা হয়েছে স্থানীয় বিজিবি ও পুলিশ ক্যাম্পে। এসব ব্যালট পেপার ভোটকেন্দ্রে পৌঁছাবে ভোটের দিন আজ রোববার সকালে। উপজেলা পরিষদ থেকে গতকাল দিনভর বিভিন্ন পরিবহনে কেন্দ্রগুলোতে ভোটের এসব সরঞ্জাম নিয়ে যাওয়া হয়। একইসাথে প্রিসাইডিং অফিসারসহ অন্যান্য ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা দূরবর্তী কেন্দ্রগুলোয় অবস্থান নিয়েছেন। নির্বাচনের জন্য সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে প্রশাসন। এখন শুধু অপেক্ষার পালা। আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা পর শুরু হবে আলোচিত এই নির্বাচনের ভোটগ্রহণ। এদিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা সর্বাত্মক সতর্কাবস্থায় থাকলেও নির্বাচনকে ঘিরে সংঘাত-সহিংসতার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এবারের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন নিয়ে উপজেলার সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক কৌতূহল ও অন্য রকম আগ্রহ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তৃণমূলের সবচেয়ে বড় এই নির্বাচন উপলক্ষে উৎসবমুখর পরিবেশ দেখা যাচ্ছে।এবারের নির্বাচনী মাঠের চিত্র অনেকটাই ভিন্ন। বদলে গেছে আগের দৃশ্যপট। আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীদের পাশাপাশি স্বতন্ত্র হয়ে দলটির বিদ্রোহী প্রার্থীদের অংশগ্রহণ এই নির্বাচনকে অনেকটাই ভিন্নমাত্রা এনে দিয়েছে। ঠেলে দিয়েছে সহিংসতার দিকে। বিএনপির নেতারাও স্বতন্ত্র হিসেবে নানা প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। কিন্তু তাদের প্রচার-প্রচারণা দেখা যায়নি বললেই চলে। নির্বাচনে বিএনপির স্বতন্ত্র প্রার্থীরা কেউ কেউ নীরব গণসংযোগ চালিয়েছেন আবার কেউ কেউ শুধুমাত্র ‘দায়সারা’ পোস্টার লাগিয়ে ঘরে বসেই সময় পার করেছেন। তাদের নিষ্ক্রিয় অংশগ্রহণ জয়ের ব্যাপারে কতটুকু কাজে আসবে সেটাই এখন দেখার বিষয়। যদিও বিএনপির স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নীরব ভোট বিপ্লবের আশায় রয়েছেন। যা দিন শেষে স্পষ্ট হবে।
অন্যদিকে বিভিন্ন প্রতীকে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীরা শুরু থেকেই নৌকার বিপক্ষে বেশ শক্ত অবস্থানে রয়েছেন। স্থানীয় আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা বিভিন্ন নির্বাচনী সমাবেশে দলের সবাইকে প্রকাশ্যে টেবিলের ওপর নৌকা প্রতীকে সিল মারার আহ্বান জানিয়ে প্রতিপক্ষের প্রতি হুঙ্কার দিয়েছেন। কিন্তু তাদের ওই বক্তব্যকে নির্বাচনী মাঠ গরম করা আর উসকানিমূলক বক্তব্য হিসেবে ধরে নিয়েছেন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা। নেতারা সমাবেশে প্রকাশ্যে নৌকায় ভোট দিতে বললেও কেউ কেউ আবার গোপনে বিদ্রোহীদের মধ্যে কারো কারো সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে এসেছেন বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে।
এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ধারাবাহিক সহিংসতার ঘটনা ঘটায় তা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হওয়ার পাশাপাশি পক্ষপাতিত্বমূলক ও অনেকটা একপেশে ভূমিকা পালন করায় নির্বাচনের চারদিন আগে (২৪ নভেম্বর) দৌলতপুর থানার ওসি নাসির উদ্দিনকে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। নৌকা ডোবাতে দলের বিদ্রোহীরা একাট্টা হওয়ার কারণে নৌকার প্রার্থীরা এমনিতেই কোণঠাসা হয়ে পড়েন। ওসি নাসিরকে সরিয়ে নেয়ার পর নির্বাচনী মাঠ সবার জন্য সমান হয়ে যায়। এতে নৌকার প্রার্থীরা জয় নিয়ে পুরোপুরি হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। ইতোমধ্যে মথুরাপুর ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সরদার হাসিম উদ্দিন হাসু কোনো রাখঢাক ছাড়াই নিজের হতাশার কথা প্রকাশ করেছেন।
এদিকে দীর্ঘদিন পর একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে জেনে মানুষজনের মাঝে উৎসবমুখর অবস্থা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ইতোমধ্যে থেমে গেছে মাইকিং প্রচারের শব্দ দূষণের বিড়ম্বনা। সঙ্গত কারণেই এবারের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে রয়েছে ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা। মানুষের মাঝে রয়েছে ব্যাপক কৌতূহল আর আলাদা রকমের আগ্রহ। সবখানেই চলছে নির্বাচন কেন্দ্রিক আলোচনা। সবচেয়ে বেশি নির্বাচনী আলোচনায় সরগরম হয়ে উঠেছে চায়ের দোকানগুলো। চায়ের দোকান এখন ‘বিশ্লেষণ কেন্দ্রে’ পরিণত হয়েছে। চলছে চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের জয়-পরাজয় নিয়ে নানামুখী বিশ্লেষণ। এসব আমেজের পাশাপাশি নির্বাচনকে ঘিরে এক ধরনের ভীতিকর অবস্থাও বিরাজ করছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে ১৫১টির কেন্দ্রের মধ্যে বেশিরভাগ কেন্দ্রকেই কমবেশি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে বলে জানা যায়। অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। পুরো উপজেলা জুড়ে তিন স্তরের নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা উপজেলার বিভিন্ন স্থানে নিয়মিত টহল দিচ্ছেন।
এ ছাড়া নির্বাচনী মাঠে রয়েছে পাঁচটি জুডিশিয়ালসহ কয়েকটি মোবাইল কোর্ট। নির্বাচনী এলাকায় মোটরসাইকেলসহ বিভিন্ন যানবাহন চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। তবে নির্বাচন কমিশনের অনুমতি বা স্টিকার সংবলিত কার, মাইক্রোবাস ও মোটরসাইকেল চলাচলে বাধা নেই। সাংবাদিক, নির্বাচন পর্যবেক্ষক ও প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের চলাচলের জন্য কমিশন থেকে এগুলো ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হয়েছে। জেলার সবচেয়ে বড় এ উপজেলায় মোট ভোটার রয়েছেন ৩ লাখ ৫২ হাজার ৮৮৪ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৭৮ হাজার ৪৭ জন এবং নারী ভোটার রয়েছেন ১ লাখ ৭৪ হাজার ৮৩৭ জন। এদিকে গতকাল শনিবার কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার খাইরুল আলম দৌলতপুর উপজেলায় নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারী পুলিশ সদস্যদের ব্রিফিং করেন। এ সময় তিনি যথাযথভাবে নিজেদের দায়িত্ব পালনের জন্য পুলিশ সদস্যদের কঠোর নির্দেশ দেন।
নির্বাচনে উপজেলার ১৪ ইউনিয়নে চেয়ারম্যান পদে ৯০ জন, মেম্বার পদে ৬২৫ জন ও সংরক্ষিত মহিলা মেম্বার পদে ১৭৪ জন প্রার্থী অংশ নিয়েছেন। এই নির্বাচনে বিএনপির স্বতন্ত্র প্রার্থীরা লাইম লাইটে না থাকলেও আওয়ামী লীগই আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়িয়েছে। সব ইউনিয়নেই ক্ষমতাসীন দলের বিদ্রোহী প্রার্থীরা শক্ত অবস্থানে থাকায় দলটির মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থীরা নিজেদের জয় নিয়ে চরম দুশ্চিন্তার মধ্যে রয়েছেন। অপরদিকে ওসি নাসির উদ্দিনকে প্রত্যাহার করায় শেষ মুহূর্তে এসে বিদ্রোহীরা রয়েছেন আরো সুবিধাজনক অবস্থানে। ১৪টির মধ্যে বেশিরভাগ ইউনিয়নেই বর্তমান চেয়ারম্যানদের পরাজরের সম্ভাবনা রয়েছে বলে অনেকে ধারণা করছেন।
এদিকে ভোটগ্রহণের আগের রাতে দৌলতপুর ইউনিয়নের ১. ৩. ও ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সংরক্ষিত মহিলা মেম্বার প্রার্থী ফিরোজা খাতুন (৫০) হার্টঅ্যাটাকে মারা গেছেন। গতকাল রাত ৮টার দিকে তিনি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে দৌলতপুর হাসপাতালে নেয়ার পর মৃত্যুবরণ করেন। তিনি বক মার্কা প্রতীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছিলেন। তার বাড়ি চক দৌলতপুর গ্রামে।
নির্বাচনের মাঠে প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের মধ্যে গত কয়েকদিন ধরে ধারাবাহিকভাবে সংঘাত-সহিংসতা চলে আসছে। এই নির্বাচনে পুনরায় নৌকার টিকেট পাওয়া বর্তমান চেয়ারম্যানদের ওপর নানা কারণেই মানুষজন ক্ষুব্ধ হয়ে রয়েছেন। নৌকার প্রার্থীরা প্রথমের দিকে বিভিন্নভাবে তাদের শক্তিমত্তা জানান দিলেও দলটির বিদ্রোহী প্রার্থীদের একাট্টা দাপটে এখন তারা অনেকটাই দিশাহারা হয়ে পড়েছেন। তারপরেও তারা শেষ কামর দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। এ কারণে রোববার ভোটগ্রহণের দিনেও ক্ষমতাসীনদের দুই পক্ষের মধ্যে বড় ধরনের সহিংসতার আশঙ্কা রয়েছে বলে অনেকে মনে করছেন।
দৌলতপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) এসএম জাবীদ হাসান জানান, ১৫১টি ভোট কেন্দ্রের সবগুলোই গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করে সেই মোতাবেক তিন স্তরের নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলা হয়েছে। পুরো উপজেলাকে চারটি জোনে ভাগ করা হয়েছে। এতে পুলিশের পক্ষে নেতৃত্বে থাকবেন চারজন এডিশনাল এসপি। প্রতিটি ইউনিয়নে একজন করে পুলিশ ইন্সপেক্টরের নেতৃত্বে স্ট্রাইকিং পার্টি দায়িত্ব পালন করবেন। গুরুত্ব অনুযায়ী প্রতিটি কেন্দ্রে একজন করে এসআই এবং এএসআইসহ প্রয়োজনীয়সংখ্যক পুলিশ সদস্য নিয়োজিত থাকবেন। প্রতি তিনটি কেন্দ্র থাকবে একটি করে মোবাইল পার্টি। এ ছাড়া কয়েকটি স্ট্যান্ডবাই পার্টি থাকবে। এই নির্বাচনী এলাকায় বিজিবি, র্যাব ও পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ১ হাজার ৬শর বেশি সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। এর বাইরে ২৮শর মতো আনসার সদস্য ভোট কেন্দ্রে থাকবেন বলে ওসি জানিয়েছেন।
উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা গোলাম আজম জানান, নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী কেন্দ্রগুলোতে ভোটের দিন (রোববার) সকালে ভোটগ্রহণের নির্ধারিত সময়ের আগেই ব্যালট পেপার পৌঁছে যাবে। তবে দুর্গম দুটি ইউনিয়নে (চিলমারী ও রামকৃষ্ণপুর) ব্যালট পেপার পাঠানো হলেও সেগুলো বিজিবি ও পুলিশ ক্যাম্পে রাখা হয়েছে। যা একইভাবে ভোটগ্রহণের আগেই কেন্দ্রে পৌঁছানো হবে। ভোটগ্রহণের অন্যান্য সরঞ্জাম নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা এরই মধ্যে কেন্দ্রগুলোতে অবস্থান নিয়েছেন। ১৫১ কেন্দ্রে মোট ২ হাজার ৮৬৩ জন কর্মকর্তা ভোটগ্রহণের দায়িত্ব পালন করবেন।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আব্দুল জব্বার সাংবাদিকদের বলেন, ‘ভোটগ্রহণের জন্য আমরা সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছি। অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে এ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষে সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। মানুষ যাতে নির্বিঘ্নে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে সেই জন্য কঠোর নিরাপত্তার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। ১৪ ইউনিয়নে সাতজন রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করছেন। একেকজন কর্মকর্তা দুটি করে ইউনিয়নের দায়িত্বে রয়েছেন। পাঁচটি জুডিশিয়ালসহ আরো কয়েকটি মোবাইল কোর্ট নির্বাচনী এলাকায় দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছে। কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার খবর পেলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’