নওগাঁর বদলগাছী উপজেলায় ছোট যমুনা নদী থেকে অনুমোদন ছাড়াই বালি উত্তোলন করছেন আওয়ামী লীগের তিন নেতার বিরুদ্ধে।
অবৈধভাবে উত্তোলন করা এসব বালি কোটি টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ) সড়ক প্রশস্তকরণ কাজে। ইজারা না নিয়েও যত্রতত্র বালি তোলায় ভাঙনের মুখে পড়েছে নদীর বাঁধ ও তীরবর্তী এলাকা। নদী ও নদীতীরবর্তী জনপদ রক্ষায় দ্রত বালি তোলা বন্ধে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন স্থানীয়রা।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, গত বছরের (১৪২৯ সন) ৯ মার্চ নওগাঁয় আটটি বালিমহাল সরকারিভাবে ইজারা দেয়ার জন্য দরপত্র আহব্বান করা হয়।
যেখানে বদলগাছী উপজেলার ছোট যমুনা নদীর ৭১ দশমিক ৫৭ একর বালি মহালের সরকারি ইজারামূল্য ধরা হয় ৩৯ লাখ ২৫২ টাকা। কার্যাদেশ অনুসারে দরপত্র আহব্বানের মাধ্যমে ৬২ লাখ ৩১ হাজার ৭১১ টাকায় বালিমহালের ইজারা পান বদলগাছী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক তপন কুমার মন্ডল। বালি উত্তোলনে তাকে ১০টি মৌজা নির্ধারণ করে দেয়া হয়। এর মধ্যে তেজাপাড়া মৌজায় রয়েছে ১ দশমিক ৭৭ একর। চলতি বছর ওই নদীতে উত্তোলনযোগ্য
বালি নেই বলে একটি প্রতিবেদন পাঠায় উপজেলা প্রশাসন। যার পরিপ্রেক্ষিতে এ বছর নদীর বালিমহাল ইজারা দেয়া হয়নি।
বদলগাছী উপজেলার দেউলিয়া ও তেজাপাড়া এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ১৪২৯ সনে তেজাপাড়া মৌজায় ১ দশমিক ৭৭ একর এলাকা থেকে বালি উত্তোলনের অনুমতি নিয়ে অবৈধভাবে প্রায় ৩০ একর এলাকা থেকে বালি উত্তোলন করা হয় ।
নদীতে পানি থাকা অবস্থায় বালি উত্তোলনে ব্যবহৃত হয় ড্রেজার। বর্তমানে শুষ্ক মৌসুমে বালি কাটতে ব্যবহৃত হচ্ছে এস্কেভেটর। এতে নদীতীরবর্তী বেশকিছু স্থানে ফসলি জমি ধসে পড়েছে। কোথাও ধসে পড়ার উপক্রম হয়েছে।
অনুমোদন ছাড়াই এভাবে অবাধে ছোট যমুনা নদী থেকে বালি তুলছেন বদলগাছী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক তপন কুমার মন্ডল, বর্তমান উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আব্দুস সালাম ও সাংগঠনিক সম্পাদক ভগিরথ কুমার। তাদের নেতৃত্বেই বড় একটি বাহিনী কাজ করছে মাঠে।
মাঠ পর্যায়ে ব্যবসাটি তদারকিতে কাজ করছেন বদলগাছী উপজেলা কৃষক লীগের সভাপতি সানাউল হোসেন হিরো।
উপজেলার আধাইপুর ইউনিয়নের দেউলিয়া ও তেজপাড়া মৌজায় ছোট যমুনা নদীর তীরবর্তী জমি পত্তনী নিয়ে দীর্ঘ ১৮ বছর যাবত চাষাবাদ করে আসছেন মজিবর রহমান, নুরুল ইসলাম ও আশরাফুল ইসলামসহ ২৭ কৃষক। তারা বলেন, ‘সরকার আমাদের ফসল আবাদ করতে এ জমি দিয়েছে। সেই জমি পুরোটাই নদীগর্ভে বিলীন হওয়ার উপক্রম। অবৈধভাবে বালি উত্তোলনের কারণে জমির একাংশ এরই মধ্যে ধসে গেছে। প্রশাসন বিষয়টি দেখেও না দেখার ভান করে আছে।’
দেউলিয়া গ্রামের বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আওয়ামী লীগ নেতা তপন ইজারার সময় পেরিয়ে গেলেও বালি উত্তোলন বন্ধ রাখেননি। বালি মহালের নির্ধারিত স্থান থেকে বালি না কেটে যত্রতত্র বালি কেটে বিক্রি করা হচ্ছে। নদীর প্রায় দুই কিলোমিটার তীরবর্তী এলাকার বালি কেটে বিক্রি করায় যেকোনো মুহুর্তে বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগে হুমকির
মুখে পড়বে আশপাশের গ্রাম।’নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেশ কয়েকজন বালি ব্যবসায়ী বলেন, ‘গত বছর বালি মহাল ইজারা নিয়ে নির্ধারিত মৌজার প্রত্যেকটি এলাকা ছাড়িয়ে অবৈধ পয়েন্ট খুলে বসেন ইজারাদার তপন। বালি উত্তোলনের সময় পেরিয়ে গেলেও দেউলিয়া-তাজপুরে প্রায় ৩০ একর এলাকা থেকে অবৈধভাবে কোটি কোটি টাকার বালি উত্তোলন করেন তিনি। কয়েক কোটি টাকার বালি অবৈধভাবে বিক্রির পর তাকে মাত্র ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেছে উপজেলা প্রশাসন। নিয়মিত মামলা করার সুযোগ থাকলেও তা করেননি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা।’বদলগাছী উপজেলা কৃষক লীগের সভাপতি সানাউল হোসেন হিরো বলেন, ‘তপন কুমার আমাদের ব্যবসায়িক পার্টনার। সওজের সড়ক প্রশস্তকরণ কাজে এবার কোটি টাকার বালি লাগছে। একজনের মধ্যস্থতায় ছোট যমুনা থেকে কিছু বালি উত্তোলন করে সেখানে বিক্রি করা হয়েছে। বৈশাখে পর তেজাপাড়া থেকে উত্তোলন করা বালি ইউএনও স্যারের একটি প্রকল্পে পাঠিয়েছি। উপজেলা আওয়ামী লীগের অনেকেই আমাদের বালি ব্যবসায় সম্পৃক্ত।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বদলগাছী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক প্রচার সম্পাদক তপন কুমার মন্ডল তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘আমি বা আমার ব্যবসায়িক পার্টনারদের কেউই নির্ধারিত স্থানের বাইরে বালি উত্তোলন করিনি। বৈশাখ মাসের পর আর বালি উত্তোলন হচ্ছে না। বালি মহাল ইজারা নিয়ে গত বছর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় হাইকোর্টে রিট করেছি।’
বদলগাছী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আতিয়ার রহমান বলেন, ‘নদী ইজারা না হওয়া সত্তেও ওই এলাকা থেকে বালি আসার বিষয়টি অবগত আছি। বৈধ-অবৈধ পয়েন্ট চেনা মুশকিল। জেলা প্রশাসন উদ্যোগ নিলে ব্যবস্থা গ্রহণে সহযোগিতা করা হবে। পুলিশ সেখান থেকে কোনো টাকা নেয় না।’
বদলগাছী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আলপনা ইয়াসমিন বলেন, ‘নির্ধারিত পয়েন্টের বাইরে বালি উত্তোলন করায় গত এপ্রিলে তপন কুমারকে ৫০ হাজার টাকা অর্থদন্ড প্রদান করা হয়েছিল। ওই মুহুর্তে তাকে সতর্ক করার পরও সে ইজারা না নিয়েও পুনরায় বালি কাটছেন বলে জেনেছি। সেখানে কত একর জমির বালি অবৈধভাবে কেটে বিক্রি করা হয়েছে তা পানি উন্নয়ন বোর্ডের সহযোগিতায় জরিপ করে দেখা হবে। এরপর প্রয়োজনে তার বিরুদ্ধে আইননুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
নওগাঁ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী ফইজুর রহমান বলেন, ‘ছোট যমুনা নদী আমাদের সম্পদ না। এটি জেলা প্রশাসনের সম্পদ। তাই নদী রক্ষায় তাদেরকেই প্রথমে এগিয়ে আসতে হবে।’
নওগাঁর জেলা প্রশাসক খালিদ মেহেদী হাসান বলেন, ‘বালি মহাল ইজারার ক্ষেত্রে কোন জায়গা থেকে কীভাবে বালি তুলতে হবে সে বিষয়ে সুষ্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। এটি ভঙ্গ করলে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ রয়েছে। বদলগাছী বালি মহালে উত্তোলনযোগ্য বালি না থাকায় এ বছর ইজারা দেয়া হয়নি। ইজারা ব্যতীত কেউ অবৈধভাবে বালি উত্তোলনের চেষ্টা করলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
এবি//দৈনিক দেশতথ্য//মে ১৮,২০২৩//
প্রিন্ট করুন
Discussion about this post