নওগাঁ প্রতিনিধি:
এক মাস আগেও মাঠ পর্যায়ে সরব উপস্থিতি ছিল নওগাঁ জেলা পুলিশের। ছিল সাধারণ জনগণের কাজে নিয়োজিত। পুলিশ আতঙ্কে ছিল অপরাধীরা। আতঙ্কে ছিল মাদক ব্যবসায়ী ও সেবনকারীরা। নিয়ন্ত্রণে ছিল অপরাধ ও মাদক সংশ্লিষ্ট কারবার। পুলিশের পাশাপাশি মাদক নিয়ন্ত্রণের জন্য আছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কার্যালয়। এছাড়া বিভিন্ন অপরাধ ও মাদক নিয়ন্ত্রণে অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান তো ছিলই।
কিন্তু বর্তমানে তার উল্টো চিত্র দেখা গেছে নওগাঁ জেলায়। এখানে মাঠ পর্যায়ে পুলিশের কম উপস্থিতির সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে অপরাধী ও মাদক ব্যবসায়ীরা। শহর ও জেলার ১১টি উপজেলায় বেড়েছে নানা অপরাধ। সেই সাথে বেড়েছে মাদকের জমজমাট কার্যক্রম। অনায়াসে বিক্রি হচ্ছে মাদক, সেবন চলছে বিনা আতঙ্কে। থেমে নেই জুয়াও। তাই দ্রুত মাঠ পর্যায়ে পুলিশদের সরব উপস্থিতি কামনা করছেন সাধারণ জনগণ। তবে এবার অন্যভাবে, ছাত্র-জনতার মাধ্যমে স্বাধীন এই জেলায় পুরোপুরি স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে। এদিকে জনগণের কথার সাথে সায় দিয়ে একাধিক পুলিশ কর্মকর্তারা জানান আমরাও স্বাধীনভাবে কাজ করতে চাই। কেউ যেন আমাদের উপর প্রভাব বিস্তার করতে না পারে।
জানা যায়, গত সোমবার (৫ আগষ্ট) বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার এক দফা দাবির মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে যান শেখ হাসিনা। এরপর দেশব্যাপী শুরু হয় এক অস্থির পরিবেশের। স্ব স্ব জায়গার দায়িত্ব পালনের কর্তব্য থেকে নিজেদেরকে সরিয়ে রাখেন সারা দেশের মতো নওগাঁ জেলার পুলিশ সদস্যরা। এরপর গত ১০ আগস্ট থেকে সবকটি থানার কার্যক্রম সীমিত পরিসরে চালু হলেও নানা কারণে পূর্ণাঙ্গভাবে সেবা দেওয়া যাচ্ছিল না। ইতিমধ্যে ১১টি থানাতেই পুলিশ সদস্যরা কাজে যোগ দিয়েছে। থানার বাইরে আপাতত কোনো অভিযানে যাচ্ছে না তারা। সেইসঙ্গে আছে পুলিশ সদস্যদের মানসিক ট্রমা। তাদের দিনগুলো কাটছে আতঙ্কের মধ্যে। তবে পুলিশ কিছু কিছু জায়গায় টহলে গেলেও সঙ্গে পাহারায় থাকছেন সেনাসদস্যরা।
ফলে এখনও পুরোপুরিভাবে কাজে ফিরতে পারেনি পুলিশ সদস্যরা। মাঠে তাদের কার্যক্রম গত দুই আগেও ছিলনা। বলা যায় জনগণের কাছ থেকে এক প্রকার বিচ্ছিন্ন ছিল। তবে মাঠ পর্যায়ে কাজে ফিরতে শুরু করেছে পুলিশ। এখনও পুলিশশূন্য বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ন জায়গা। আর এই সুযোগে পেশাদার অপরাধী ও মাদক ব্যবসায়ীরা সক্রিয় হয়ে উঠেছে। আবার কেউ কেউ নতুন করে অপরাধের সাথে জড়িত হচ্ছে। বর্তমানে জেলার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় চেকপোস্ট না থাকার কারণে অবাধে ঢুকছে মাদক। বিশেষ করে সীমান্তবর্তী জেলা হওয়ায় এই সুযোগ বেশি নিচ্ছে মাদক ব্যবসায়ীরা।
সড়ক পথের পাশাপাশি নওগাঁর পার্শ্ববর্তী সান্তাহার রেলপথেও মাদক নিয়ে আসে ব্যবসায়ীরা। এই রেলপথে নিরাপদ মনে হয় তাদের। আর এভাবেই বিভিন্ন জায়গায় অবাধে চলছে মাদক সেবন ও বেচাকেনা। আবার রাতে পুলিশের টহল না থাকার সুযোগ নিচ্ছে অন্যান্য অপরাধীরা। এছাড়া সম্প্রতি জেলার ১১টি উপজেলার কোথাও না কোথাও চুরি, হামলা, মারপিট ও দখলের পরিমাণ বেড়েছে। নওগাঁ শহরের নুনিয়া পট্রি, সদর উপজেলার চকপ্রাণে বেশি মাদকের কারবার চলছে, ছোট যমুনায় নদীপথে ভাসমান নৌকায় হচ্ছে জুয়া। জেলার বদলগাছী উপজেলার সাগরপুর, জগপাড়া, মিঠাপুর, পাইকপাড়া, সাগরপুর গোয়ালপাড়া, পোরশা উপজেলার নিতপুর ইউনিয়নের মনোহরপুরে তৈরি হয় বাংলা মদ, নিতপুর সদর হাড়িপাড়ায় হচ্ছে গাঁজা বিক্রি। এছাড়া কলোনিপাড়ায় চলছে বিদেশী মদ, ফেনসিডিলসহ সকল ধরণের মাদক বেচা কেনা। এর আগে পোরশায় গত দুই দিন আগে রাস্তায় ছিনতাইয়ের ঘটনাও ঘটেছে বলে জানা যায়। নিয়ামতপুরে চলছে অনায়াসে মাদক বেচাকেনা। হয়েছে হামলা, মারপিট ও দখলের মতো ঘটনাও। জেলার সাপাহার উপজেলায় এখনও চুরি ও ডাকাত আতঙ্কে রাত জেগে পাহারা দিচ্ছেন এলকাবাসী। এবং মাদক বিক্রি ও সেবন তো চলছেই। মান্দা উপজেলার জোতবাজার, কশব ইউনিয়নের পাজরভাঙ্গায়, পলাশবাড়িসহ অনেক জায়গায় বেড়েছে মাদকের বেচাকেনা। হামলা ও দখলের ঘটনাও আছে। এছাড়া এই কয়েক দিনে ধামইরহাট, পত্নীতলা উপজেলায় বেড়েছে মাদকের বিক্রি ও সেবন। পাশাপাশি অবনতি হয়েছে আইনশৃঙ্খলার।
এদিকে সরাসরি শুধু মাদক নিয়ে কাজ করার জন্য আছে মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সদস্যরা। তারপরও মাদক নিয়ন্ত্রণে তাদের তেমন নেই কোনো ভূমিকা। তাই সচেতনরা বলছেন অন্তত এই সময়ে পুলিশের মতো মাঠে থেকে মাদকের বিরুদ্ধে কাজ করা উচিত মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সদস্যদের।
পুলিশের কম উপস্থিতিতে মাদক বেড়েছে, আপনাদের করণীয় আছে কিনা এমন প্রশ্নের বিষয়ে জানতে চাইলে নওগাঁ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক লোকমান হোসেন মুঠোফোনে বলেন, অবশ্যই করণীয় আছে। মাদকের বিরুদ্ধে গোয়েন্দা কার্যক্রম চলমান আছে। আমাদের প্রত্যেকটি ইউনিট তাদের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও করবে। তাছাড়া মাদকের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান চলমান আছে। এক্ষেত্রে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করার জন্য অনুরোধ জানান তিনি।
জানতে চাইলে নওগাঁর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস্) আহসানুজ্জামান, পিপিএম মুঠোফোনে বলেন, নওগাঁ জেলায় বড় কোনো সহিংসতার ঘটনা ঘটেনি। এই জেলা এখনও ভালো আছে। তবে ঘটে যাওয়া পরিস্থিতির কারণে একটু সময় লাগছে। তারপরও জেলা পুলিশ মাঠে আছে এবং মাঠে থেকে গুরুত্বসহকারে কাজ করছে। আশা করি অল্প কিছুদিনের মধ্যে সব ঠিক হয়ে যাবে। এবং সাধারণ জনগণের জন্য কাজ করতে পারবে।