নওগাঁয় দাদন ব্যবসায়ীদের সুদের টাকার চাপে শাহিনা বেগম(৩৫) নামে এক গৃহবধুর আত্মহত্যার অভিযোগ উঠেছে। গত বুধবার (১০ মে) সকাল ৮টার দিকে সদর উপজেলার চন্ডিপুর ইউনিয়নের চুনিয়াগাড়ী গ্রামে এ ঘটনাটি ঘটে। নিহত শাহিনা ওই গ্রামের শাহীন হোসেনের স্ত্রী ও একই উপজেলার বিলভবানীপুর গ্রামের সৌরভের মেয়ে। ওইদিন দাদন ব্যবসায়ীদের বাঁচাতে ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে ইউডি মামলা নেয়ার অভিযোগ উঠেছে সদর থানা পুলিশের বিরুদ্ধে।
স্থানীয় গ্রামবাসী ও নিহতের পরিবার সূত্রে জানা যায়, নওগাঁ সদর বিলভবানীপুর গ্রামের সৌরভের মেয়ে শাহিনা বেগমের সাথে চন্ডিপুর ইউনিয়নের চুনিয়াগাড়ী গ্রামের শাহীন হোসেনের বিয়ে হয় প্রায় ২০ বছর আগে। বর্তমানে তাদের সংসারে ৩টি সন্তান রয়েছে। তিন সন্তানের খরচ চালাতে এক প্রকার হিমশিম খাচ্ছিলেন শাহিন। এক পর্যায়ে সিলেটেও থাকতে হয় তাকে। তবে নিজের আর্থিক অবস্থার উন্নয়ন না হওয়ায় আবারো ফিরতে হয় নওগাঁতে। এলাকায় থেকে দিনমজুরের কাজ করতেন তিনি। তিন সন্তানকে নিয়ে মাটির তৈরী বাড়িতে থাকা তার জন্য ছিলো অনেকটাই কষ্টসাধ্য। তাই স্থানীয় কয়েকটি এনজিও থেকে ঋণ নিতে হয় শাহিনকে। ঋণের টাকা দিয়ে নির্মাণ করেন টিনের বাড়ি। তবে সেটা করতে গিয়ে আরো ঋণগ্রস্ত হতে হয় শাহিনকে। এনজিও কিস্তি পরিশোধ করতে গিয়ে যখন হিমশিম খাচ্ছিলেন তখন তার স্ত্রীকে চড়া সুদে ২৯ হাজার টাকা ঋণ দিয়ে দুর্বলতার সুযোগ নেয় স্থানীয় সুদ ব্যবসায়ী সুমন ও জাফের। ধারাবাহিকভাবে প্রতি সপ্তাহে তাদের এই টাকার সুদ দিতো হতো শাহিনের স্ত্রীকে। মাঝখানে শাহিনের স্ত্রী শাহিনাকে সুদের টাকা আরো বাড়িয়ে দেয়ার জন্য চাপ দেন সুমন ও জাফের। সেটা দিতে না পারায় গত বুধবার (১০ মে) সকালে তাকে সমুদয় টাকাসহ ঋণের টাকা ফেরত দিতে চাপ দেন সুমন ও জাফের। বাড়ি গিয়ে টাকার জন্য হুমকি ধামকি ও অকথ্যভাষায় শাহিনাকে গালিগালাজ করেন তারা। এর কিছুক্ষণ পর ঋণের চাপ সহ্য করতে না পেরে শাহিনা গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন। ওই মুহুর্তে বিষয়টিকে ধামাচাপা দিতে তৎপর হয়ে উঠেন স্থানীয় চেয়ারম্যান ও থানা পুলিশ। রফাদফার মাধ্যমে নেয়া হয় ইউডি মামলা।
একাধিক গ্রামবাসীর অভিযোগ, একজন সুদ ব্যবসায়ীদের মদদদাতা। তিনি নিজেও একজন সুদ ব্যবসায়ী। শাহিনার আত্মহত্যার পর ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে তিনি এলাকায় না গিয়ে থানায় বসে দফারফায় ব্যস্ত ছিলেন। সর্বশেষে চেয়ারম্যানের হস্তক্ষেপে স্পষ্ট হত্যাকান্ডটি ধামাচাপা দিতে ইউডি মামলা নেয়া হয়। শাহীনার পরিবারকে যাতে কারোর সামনে মুখ না খোলে সেজন্য চাপে রাখা হয়েছে।
চুনিয়াগাড়ী গ্রামের বাসিন্দা ময়নুল হোসেন বলেন, এই গ্রামে দাদন ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম অনেক বেড়েছে। তারা গ্রামের সহজসরল মানুষের বিপদের সময় সুযোগ নেয়। চড়া সুদে ঋণ দিয়ে আমাদের সাথে প্রতারণা করে আসছে। সুদের টাকা পরিশোধ করতে না পেরে এবার আত্মহত্যা করলো শাহিনের স্ত্রী। এটা নতুন ঘটনা নয়। এর আগেও শাহিনের ভাই দাদন ব্যবসায়ীদের চাপে পড়ে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছিলো। যাদের জন্য এসব আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে তাদের অবিলম্বে আইনের আওতায় আনার দাবী জানান তিনি।
শাহিন হোসেন বলেন, সুমন ও জাফেরের কাছে থেকে আমার স্ত্রী ২৯ হাজার টাকা চড়া সুদে ঋণ নিয়েছিলো। প্রতি সপ্তাহে এই টাকার সুদ দিতে হতো। সেদিন সকালে হঠাৎ করে বাড়িতে এসে আমার স্ত্রীকে তারা সমুদয় টাকাসহ সুদের লভ্যাংশ ফেরত দিতে চাপ প্রয়োগ করে। টাকা ওই মুহুর্তে দিতে না পারায় স্ত্রীকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ এবং বাড়ির ছাগল নিয়ে যাওয়ার হুমকি দেয়। তাদের মানসিক এই অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে কিছুক্ষণ পরই আমার স্ত্রী গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে দাদন ব্যবসায়ী জাফের বলেন, ৬ হাজার টাকা ঋণ দিয়েছিলাম। ঘটনার দিন শাহিনার বাড়িতে গিয়ে কয়েকবার ডাকাডাকি করেও সে সাড়া দেয়নি। পরে ওই বাড়ির সামনে থেকে চলে এসেছি। তাকে সুদের টাকার জন্য কোন চাপ দেওয়া হয়নি।
একইভাবে অভিযোগটি অস্বীকার করেছেন আরেক দাদন ব্যবসায়ী সুমন। তিনি বলেন, শাহিনার বাড়ির সামনে গিয়ে দুজন মহিলার সামনে তাকে ডেকেছিলাম। তাকে কোন বিষয়ে চাপ প্রয়োগ করা হয়নি।
চন্ডিপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান খুরশিদ আলম রুবেল বলেন, শাহিনার গলায় ফাঁস দেওয়ার খবরটি জানার পরই ওই গ্রামের অনেকের থেকে ঘটনাটি শুনেছি। সবার মুখে শুনে এটা স্বাভাবিক মৃত্যু বলে মনে হয়েছে। রফাদফায় তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগটি অস্বীকার করেন তিনি।
নওগাঁ সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফয়সাল বিন আহসান বলেন, ওই গৃহবধুর আত্মহত্যার খবরটি জানার পরই ঘটনাস্থলে গিয়েছিলাম। পরে মরদেহটি উদ্ধার করে ময়নাতদন্ত শেষে নিহতের পরিবারের কাছে লাশটি হস্তান্তর করা হয়েছে। সুদ ব্যবসায়ীদের সাথে শাহিনার পরিবারের লেনদেনের কোন তথ্য আমরা পাইনি। এখানে রফাদফার যে কথা বলা হচ্ছে তা সঠিক নয়।
এবি//দৈনিক দেশতথ্য //মে ১৩,২০২৩//
![প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন](http://dailydeshtottoh.com/wp-content/plugins/wp-print/images/printer_famfamfam.gif)
Discussion about this post