নাদিরা খানম:
প্রতিবছর ৮ মার্চ বিশ্বজুড়ে উদ্যাপিত হয় আন্তর্জাতিক নারী দিবস। লিঙ্গবৈষম্য দূর করে নারীর প্রতি সম্মান ও সমানাধিকারের বার্তা জানাতেই দিবসটি উদ্যাপিত হয়। চলতি বছরও এর ব্যতিক্রম হচ্ছে না। এটি এমন একটা দিন, যা সূচনাপর্ব থেকে জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে নারীদের সম্মানের কথা মনে করিয়ে দেয়।
নারীরা বিশ্বকে আলোকিত করে তোলে, নারীদের শক্তি তাদের সংগ্রাম আমাদের সকলকে অনুপ্রাণিত করে, আন্তর্জাতিক নারী দিবসে বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব নারীকে নারী দিবসের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। এ দিবসটি প্রতি বছরই আমাদের জীবনে বারে বারে ফিরে আসে। ৮মার্চ আন্দোলনরত নারীদের রাখী বন্ধন, কুশল বিনিময় ও সংহতি প্রকাশের দিন। এই দিনে নারীরা সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভাবে কতদূর এগিয়েছে এবং সেই সাথে শান্তি, সমতা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে নারী আদৌ অগ্রসর হয়েছে কিনা তা নির্ণয় করার দিন।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ‘নারী’ কবিতায় লিখেছেন “কোন কালে একা হয়নি ক জয়ী পুরুষের তরবারী প্রেরণা দিয়েছে, শক্তি দিয়েছে বিজয় লক্ষী নারী।” “বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি, চির কল্যাণকর অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।”
সৃষ্টিকর্তা নারী ও পুরুষকে সমান মর্যাদা সম্পন্ন করেই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো- সমাজে নারী অনেকক্ষেত্রেই বৈষম্যের নির্মম শিকার। নির্যাতন আর অত্যাচারে দুর্বিষহ হয়ে ওঠে অনেক নারীর জীবন। এটা হয়ে আসছে অনেক আগে থেকেই। কারণ, সৃষ্টির কাঠামোতে পুরুষ আর নারীকে সমান দক্ষতায় আঁকা হলেও পুরুষশাসিত সমাজ ব্যবস্থায় নারীকে তার প্রাপ্য সম্মান দেয়া হয়নি। এ সমাজে পুরুষরা স্বঘোষিত মানুষ হয়। কিন্তু নারী যেনো সবসময় মানুষ নয়- তার যেনো রয়েছে অন্য এক অস্তিত্ব। শুধু ভোগ করার সময় তাকে আদর করে মানুষ বলে ডাকা হয়। কিন্তু অধিকারের প্রশ্ন আর মর্যাদার প্রশ্নে পুরুষ নারীকে তার সমকক্ষ হিসেবে স্বীকার করতে দ্বিধা করে। অনেকসময় শারীরিক, মানসিক ও বস্তুগত বৈষম্যের দৃশ্যমান ও অদৃশ্য দেয়াল তুলে তাকে বুঝিয়ে দিতেও কুণ্ঠা করে না যে নারী একটি দ্বিতীয় শ্রেণির ভোগ্যপণ্য বা প্রাণীবাচক অস্তিত্ব। তাই, কিছু ব্যতিক্রম সহজভাবে মেনে নিয়েই বলতে হচ্ছে – নারীর সত্যিকার অধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আমাদের আরো অনেকপথ হাঁটতে হবে।
১৮৫৭ সালে ৮মার্চ আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরে সুতা কারখানায় কর্মরত বৈষম্যের শিকার নারী শ্রমিকেরা তাদের বেতন বৈষম্য, নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা, কাজের পরিবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও ভোটের দাবী জানাতে একজোট হয়ে আন্দোলন করার জন্য রাস্তায় নামতে বাধ্য হয়। সেদিন আন্দোলনরত নারীদের উপর কারখানার মালিকেরা এবং তাদের মদদপুষ্ট প্রশাসন দমন – পীড়ন চালায়। ফলে দাবী নিয়ে নারীর অধিকার আদায়ের সংগ্রাম আরো বিকশিত হতে থাকে, নিউইয়র্ক শহরে প্রায় ১৫ হাজার নারী শ্রমিক মিছিল করে, প্রায় অর্ধ-শতাব্দীর পর ১৯০৮ সালে জার্মানিতে এ দিনটির স্মরণে প্রথম নারী সম্মেলন হয়।
১৯১০ সালে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন। এই সম্মেলনে বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের নেত্রী ক্লারা জেটকিন আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপনের ধারণাটি উথাপন করেন। তিনি প্রস্তাব করেন, নারীর অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে বছরে একটি দিন নারী দিবস হিসেবে বিশ্বের প্রতিটি দেশ উদযাপন করবে। এই সম্মেলনে ১৭টি দেশের একশরও বেশী নারী প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন এবং প্রত্যেকেই একমত হয়েছিলেন। এভাবে নারীদের জন্য বছরে একটি বিশেষ দিন আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালনের সূচনা ঘটে। ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘ ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসাবে স্বীকৃতি দেয়।
বাংলাদেশ সরকারও যদি ৮মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসকে সরকারি ছুটির দিন হিসাবে ঘোষণা করতো তাহলে বাংলাদেশের নারীরাও এই দিবসটিকে যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে পালন করতে পারতো। বাংলাদেশে সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হয় ষাটের দশকের শেষ দিকে গোপনভাবে সীমিত আকারে। নিষিদ্ধ বামপন্থী সংগঠন পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির উদ্যোগে। ১৯৬৯সালে সর্ব প্রথম প্রকাশ্যে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হয় পূর্বপাকিস্তানে মহিলা সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে। এই মহিলা সংগ্রাম পরিষদ ১৯৭০ সাল ৪ এপ্রিল মহিলা পরিষদ নামে আত্নপ্রকাশ করে। সভাপতি হয়েছিলেন বাংলাদেশের নারী অধিকার ও নারী অগ্রযাত্রার অগ্রদূত কবি সুফিয়া কামাল।
এই সকল কর্মসূচিতে সমাজের প্রগতিশীল সকল শ্রেণী পেশার নারী পুরুষকে সম্পৃক্ত করা হয়। স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ সর্বপ্রথম ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করে। এই অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন মহিলা পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি কবি সুফিয়া কামাল। নারী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নারীর অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। দীর্ঘ ও অবিরাম সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের নারীসমাজ ধীরে ধীরে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে। বাংলাদেশের সংসদের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই প্রধানমন্ত্রী নারী, বিরোধী দলের নেতা নারী ও স্পিকার নারী। প্রায় ৩০ বছর ধরে বাংলাদেশের নারী প্রধানমন্ত্রী দেশ পরিচালনা করছেন। বিশ্বের অন্যকোন দেশে এরকম উদাহরণ নাই। এ কারণেই আমাদের দেশের নারীর অবস্থান কিছুটা উন্নত। নারীরা এখন আর নারী নাই। তারা মানুষ হিসাবে মাথা উঁচু করে পুরুষের পাশাপাশি পরিবার সমাজ ও রাষ্ট্রের সকল গুরুত্বপূর্ণ কাজে অংশগ্রহণ করে সফলতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে তা ইতিমধ্যে প্রমাণিত। আগে সন্তানের পরিচয় ছিল বাবার নামে। বর্তমানে আইন করে বাবা এবং মা উভয়ের নামের পরিচয়ে সন্তানরা পরিচিত হয়। নারীরা অন্দরমহল ভেদ করে চার দেয়াল থেকে বের হয়ে ইট ভাঙ্গা, মাটিকাটা, কৃষিকাজ, পোশাক শিল্প, নির্মাণ শিল্প, সেনাবাহিনী, পুলিশ, শিক্ষক ডাক্তার, পাইলট, প্রকৌশলী খেলাধুলা সব সেক্টরে কাজ করছে । শিক্ষায় নারীরা এগিয়ে আছে প্রশাসন এবং নীতিনির্ধারণী ক্ষেত্রেও নারীর উপস্থিতি লক্ষ্যণীয়। প্রতিটি উন্নয়নমূলক কাজে নারীর সম্পৃক্ততা আছে। শ্রম বাজারেও নারী উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে সক্ষম হচ্ছে। নারীরা তার যোগ্যতা, দক্ষতা, অভিজ্ঞতা, মেধা ও মননশীলতা দিয়ে খ্যাতির আসনটা ক্রমশ দখল করে নিচ্ছে। দেশে কিছু সংখ্যক নারী মা ও বোনের মর্যাদা বাড়লেও এক বিরাট অংশ নারী এখনো মর্যাদাহীন অবস্থায় বিরাজ করছে। তারা এখনো সমস্ত রকমের সুবিধা থেকে বঞ্চিত, লাঞ্ছিত, নির্যাতিত, নিগৃহীত ও শোষিত। এক কথায় বলতে গেলে সব রকমের বৈষম্যের শিকার সেই সাথে নিরাপত্তাহীনতাও আছে। নারীরা আমাদের দেশসহ অনেক দেশেই নারীরা পথে ঘাটে, ঘরে-বাইরে এমনকি কর্মক্ষেত্রেও বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার। চলন্ত বাসেও নির্যাতনের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না নারীরা। চাকরির ইন্টারভিউতে নারী প্রার্থীকে নানারকম মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়। ইন্টারভিউ করে যোগ্যতার ভিত্তিতে চাকরিতে যোগদান করার পরও একজন নারীকে নানা রকম হেনস্তার সম্মুখীন হতে হয়। একজন মানুষের কাজের মূল্যায়ন হয় দোষ-গুণের ভিত্তিতে। কিন্তু নারীর ক্ষেত্রে দেখা যায় তার ভালো গুণের বিষয়টি চাপা দিয়ে খুটিয়ে খুটিয়ে দোষের বিষয়টিকে তুলে ধরা হয়। এসব ক্ষেত্রে অনেক নারী মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। যার ফলে অনেকই চাকরি করতে উৎসাহ হারিয়ে ফেলছে। একজন কৃষাণী ধান রোপণ থেকে শুরু করে বাজারে বিক্রি করা পর্যন্ত ২২ ধরনের কাজের মধ্যে ১৯ ধরনের কাজ করে থাকেন। অথচ শেষ পর্যন্ত টাকার মালিক হয় স্বামী। যে স্বপ্ন ও লক্ষ্য নিয়ে নারী শ্রমিকেরা আন্দোলন শুরু করেছিলেন সেই আন্দোলনের শত বছর পার হয়ে প্রায় আরো এক যুগ হতে চলেছে কিন্তু আজও নারী শ্রমিকেরা মজুরী বৈষম্যের শিকার। নারী শ্রমিককে কেবল শ্রমিক হিসেবে বিবেচনা না করে নারী শ্রমিক হিসেবে গণ্য করা হয় যার ফলে পুরুষ শ্রমিকের তুলনায় নারী শ্রমিককে কম মজুরি দেওয়া হয়। বিশেষ করে নিম্ন আয়ের শ্রমজীবীদের মধ্যে নারী পুরুষের তুলনায় কম মজুরী পেয়ে থাকেন। ১৯৯৭ সালে জাতীয় নারী উন্নয়ননীতি বাস্তবায়নের কথা বলা হলেও আজও তা বাস্তবায়ন না হওয়ার ফলে নারীরা উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত; ফলে সম্পত্তি থেকেও বঞ্চিত। মুসলিম নারীরা নামমাত্র সম্পত্তির অংশ পেলেও অমুসলিম নারীদের পিতা ও স্বামীর সম্পত্তিতে তাদের কোন অংশীদারত্ব নেই। জাতীয় রাজনীতিসহ সর্বক্ষেত্রে নারীর ৩৩% অংশ গ্রহন এখনও বাস্তবায়ন হয়নি। স্থানীয় সরকার পর্যায়ে নারীর ক্ষমতায়ন ফলপ্রসূ হচ্ছে না। সংরক্ষিত নারী আসন ও সংরক্ষিত নারী কোটা নারীকে আরো পিছনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। সংসদে এক তৃতীয়াংশ আসন নারীর জন্য বরাদ্দের কথা বলা হলেও আজও বাস্তবায়নের কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। ছয় মাস মাতৃত্বকালীন ছুটি সরকারিভাবে ঘোষণা দেওয়া সত্ত্বেও সব নারী আজও ছয় মাস মাতৃত্বকালীন ছুটি ভোগ করতে পারে না। এ ব্যাপারে নারীকে নানা রকম হয়রানির মুখোমুখি হতে হয়। যৌতুকের কারণে নারীকে নানা রকম নির্যাতনের শিকার হতে হয়। এমনকি অনেককে মৃত্যুবরণও করতে হচ্ছে। দেশে বাল্য বিবাহের হার ক্রমেই বেড়ে চলেছে। রাত নটার পরে নারী ঘরের বাইরে থাকবে কেন? এই কথাটি নারীকে আজও শুনতে হয়।
নারী দিবসের রং নির্ধারিত হয়েছে বেগুনি এবং সাদা, যা নারীর প্রতীক। বেগুনি রং সুবিচার ও মর্যাদা নির্দেশ করে। ১৯৮৩ সালে পুলিৎজার পুরস্কার বিজয়ী মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গ লেখক এবং নারীবাদী অ্যালিস ও যাকারের প্রশংসিত উপন্যাস ‘দ্য কালার পারলে’ বইটি এ রং নির্ধারণে অনুপ্রেরণা যোগায়। এ বইতে তিনি নারীদের অধিকারের কথা তুলে ধরেছেন। ধারণা করা হয়, সেখান থেকেই নারীবাদী আন্দোলনের সঙ্গে জুড়ে গেছে বেগুনি-সাদা রং।
প্রগতিশীল সকল শ্রেণী পেশার নারী-পুরুষ উভয়ে মিলে ঐক্যবদ্ধ নারী আন্দোলনে সমবেত হয়ে এমন একটি সমাজ প্রতিষ্ঠা করি যে সমাজে নারীরা অবাধে চলাফেরা করতে পারবে, স্বাধীন ভাবে কথা বলতে পারবে। থাকবেনা কোন বৈষম্য ও নির্যাতন। আসুন আমরা নারী-পুরুষ উভয়ে মিলে সমস্বরে বলি এই আকাশ এই মাটি ও এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড নারী পুরুষ উভয়ের। আন্তর্জাতিক নারী দিবসের ভাবনা সকলের মধ্যে জাগ্রত করা গেলে ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস সার্থক ও সফল হবে।
লেখক : নাদিরা খানম, সিনিয়র সহকারী শিক্ষক, কুষ্টিয়া সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।
এবি//দৈনিক দেশতথ্য//মার্চ ১১,২০২৪//
![প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন](http://dailydeshtottoh.com/wp-content/plugins/wp-print/images/printer_famfamfam.gif)
Discussion about this post