কোটি কোটি টাকা অবৈধ ফি আদায়ের অভিযোগ
হাসান আলী॥ কুষ্টিয়া প্রতিনিধি॥ ২৯ জানুয়ারী, ২০২৫॥
কুষ্টিয়ায় সরকারী নীতিমালা বাস্তবায়নে জেলা শিক্ষা প্রশাসনের নেয়া ভর্তি ও টিউশন ফি সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত মানছে না জেলার কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
সরেজমিন গৃহীত সিদ্ধান্ত সঠিক ভাবে মানা হচ্ছে কিনা সেবিষয়ে কার্যকরী কোন মনিটরিং না থাকায় শিক্ষর্থী ভর্তি ও মাসিক টিউশন ফি আদায়ে নীতিমালা ধার্যকৃত ফি’র তুলনায় ক্ষেত্র বিশেষে প্রতিষ্ঠানগুলি যাচ্ছেতাই আর্থিক বোঝা (২শ গুনেরও অধিক) অভিভাকদের উপর চাপিয়ে দিচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের রহস্যজনক নিরবতায় প্রতিষ্ঠানগুলির এমন বেপরোয়া আচরণে ভুক্তভোগী অভিভাবকদের মধ্যে পুঞ্জিভুত ক্ষোভ তীব্র হয়ে উঠছে বলেও প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন। তবে এবিষেয়ে সুনির্দিষ্ট কোন লিখিত অভিযোগ পাননি জানিয়ে অভিযোগের সত্যতা যাচায় করে ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো শিক্ষা প্রশাসনের।
২০২৫ সালের নতুন শিক্ষা বর্ষে ভর্তি সংক্রান্ত পরিপত্র সূত্রে জানা যায়, ‘মহানগরী/সিটি কর্পোরেশন, পৌর-জেলা ও পৌর উপজেলা এবং মফস্বল ভেদে শিক্ষা
প্রতিষ্ঠানগুলি ক্ষেত্র বিশেষে নতুন ক্লাশে ভর্তির জন্য অনধিক ২১ টি খাত উল্লেখ করত: পৌর জেলা ও পৌর উপজেলা এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হলে অনধিক ১
হাজার ৮শ ৫০টাকা নিতে পারবে এবং মফস্বল এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হলে অনধিক ১ হাজার ৬শ ৪৫টাকা আদায় করা যাবে। তবে শর্ত থাকে যে প্রতিষ্ঠানগুলিতে উল্লেখিত খাত সমুহের বাস্তব উপস্থিতি বা শিক্ষার্থীদের
এসব খাতের ইউটিলিটি নিশ্চিত থাকতে হবে। যদিও পরিপত্রে উল্লেখিত ২১টি খাতের মধ্যে অর্ধেক সংখ্যক খাতেরও কোন উপস্থিতি প্রতিষ্ঠান গুলিতে নেই।
পরিপত্রে পরীক্ষার ফি বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে- ৩ঘন্টার পরিক্ষার জন্য প্রতিটা বিষয় বাবদ ৪০টাকা হারে আদায় করা যাবে। অত:পর টিউশন ফি নির্ধারণ সংক্রান্ত
জেলা কমিটির ধার্যকৃত প্রতি শ্রেণীর মাসিক টিউশন ফি বাবদ নেয়া যাবে যথাক্রমে পৌর জেলা ও পৌর উপজেলার মধ্যে ৬ষ্ঠ শ্রেনীতে (প্রতিষ্ঠানের
ফ্যাসিলিটির উপর ভিত্তি করে) নূন্যতম ৮০টাকা তবে অনধিক ১২০টাকা আদায় করা যাবে। একই ভাবে ৭ম শ্রেনীতে নূন্যতম ৯০টাকা এবং অনধিক ১৩০টাকা। ৮ম
শ্রেনীতে ১শ থেকে ১৪০ টকা, ৯ম ও ১০ম শ্রেনীতে ১শ ২০টাকা থেকে ২শ টাকা পর্যন্ত, একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেনীতে ২শ থেকে ২শ ৮০টাকা পর্যন্ত। তবে এক্ষেত্রে মফস্বল এলাকার প্রতিষ্ঠানের জন্য নির্ধারিত মাসিক টিউশন ফি ধার্য করা হয়েছে যথাক্রমে- ৬ষ্ঠ শেনীর জন্য ৫০ থেকে ১শ টাকা, ৭ম শ্রেনীতে ৬০ থেকে ১১০টাকা, ৮ম শ্রেনীতে ৭০ থেকে ১৪০টাকা, ৯ম ও ১০ম শ্রেনীর জন্য ৮০টাকা থেকে ১শ ৮০টাকা এবং একাদশ-দ্বাদশ শ্রেনীর জন্য ১শ ৭০ থেকে ২শ ২০টাকা পর্যন্ত।
ইতোমধ্যে জেলার সকল এমপিও ভুক্ত ও নন এমপিও ভুক্ত বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি কোন ভাবেই মানছেন না নীতিমালা নির্ধারিত ভর্তি ও টিউশন ফি
বাবদ ধার্যকৃত ফি আদায়ের সিদ্ধান্ত। এ সংক্রান্ত নির্দেশনা দিয়ে সরকার গত ২৭ অক্টোবর ২০২৪ একটি পরিপত্র জারী করেছে। এই পরিপত্র অনুযায়ী দেশের সকল মাধ্যমিক ও উচ্চ উচ্চশিক্ষা বিভাগের আওতাধীন এমপিও ভুক্ত ও নন এমপিও প্রতিষ্ঠানের জন্য টিউশন ফি নীতিমালা প্রনয়ন করা হয়েছে। জেলা পর্যায়ে জেলা প্রশাসককে সভাপতি ও জেলা শিক্ষা অফিসার মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারকে সদস্য সচিব করে টিউশন ফি নির্ধারণ কমিটি গঠন করা হয়। একমিটিতে এমপিও
ভুক্ত ও নন এমপিও ভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানদেরও সদস্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। গেলো ২৯ ডিসেম্বর কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে জেলা
শিক্ষা কমিটির সংশ্লিষ্ট সদস্যদের অংশ গ্রহনে অনুষ্ঠিত সভায় প্রথম শ্রেনী থেকে দ্বাদশ শ্রেনী পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের মাসিক টিউশন ফি নির্ধারন করে একটি পরিপত্র জারী করা হয়েছে।
অথচ কেউই মানছেননা নীতিমালা ও জেলা শিক্ষা কমিটি কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্ত। সরেজমিনে জেলা শীর্ষস্থানীয় দুটি এমপিও ভুক্ত এবং দুটি নন এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানে ২০২৫ সালে নতুন বর্ষে ৬ষ্ঠ শ্রেনীতে ভর্তি ও মাসিক টিউশন ফি বাবদ শিক্ষার্থী/অভিভাবকদের কাছ থেকে আদায়কৃত তুলনামূলক টাকার পরিমান চিত্রে দেখা যায় যথাক্রমে- স্বয়ং জেলা প্রশাসন কর্তৃক পরিচালিত এমপিও ভুক্ত ‘কুষ্টিয়া কালেক্টরেট স্কুল এন্ড কলেজে’ ভর্তি ফি- ৩হাজার ৩শ টাকা এবং মাসিক টিউশন ফি- ৭শ টাকা। জেলার পুলিশ প্রশাসন কর্তৃক পরিচালিত
এমপিওভুক্ত ‘পুলিশ লাইন্স স্কুল এন্ড কলেজে’র ভর্তি ফি ৩হাজার ৫শ ২০টাকা এবং মাসিক টিউশন ফি- ৭শ টাকা। একই ভাবে জেলার শীর্ষস্থানীয় দুটি নন এমপিও
ভুক্ত প্রতিষ্ঠান যথাক্রমে- ‘এডুকেয়ার আইডিয়াল স্কুল এন্ড কলেজে’র মোট ৪টি খাত উল্লেখ পূর্বক ভর্তি ফি আদায় করছেন- ১২ হাজার ৬শ টাকা এবং মাসিক
টিউশন ফি- ২হাজার ৮শত টাকা। অপর নন এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘হাসিব ড্রিম স্কুল এন্ড কলেজে’র (বাংলা মাধ্যম) ৪টি খাত উল্লেখ পূর্বক ভর্তি ফি আদায় করছেন- ২০ হাজার টাকা এবং মাসিক টিউশন ফি- ২ হাজার ৭ শত টাকা ছাড়াও
মাসিক টিফিন ফি- ৪শত টাকা। এছাড়া শহরের প্রানকেন্দ্র থানামোড়স্থ ‘সান আপ স্কুল এন্ড কলেজ’ এ (বাংলা মাধ্যম) ৬ষ্ঠ শ্রেনীতে ভর্তি ফি নেয়া হচ্ছে-
১০ হাজার ৩শ টাকা এবং প্রতি ১ মাসের বেতন ১ হাজার ৮শ টাকা।
কুষ্টিয়া জেলা শিক্ষা অফিসের গবেষনা কর্মকর্তা মো: সবুজ হোসেন বলেন, ‘২০২৫ সালে নতুন শিক্ষাবর্ষে ৬ষ্ঠ শ্রেনীতে ভর্তিকৃত ৪৬ হাজার ৩শ ৫০ জন শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যের বই সরবরাহ করা হয়েছে। এসব শিক্ষা
প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে রয়েছে- সরকারী, এমপিওভুক্ত এবং নন এমপিওভুক্ত সকল প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের এসব নতুন বই দেয়া হয়েছে। এছাড়া অন্যান্য শ্রেনীর বই পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা যথাক্রমে- ৭ম শ্রেনী- ৪২ হাজার ৬শ ৫০জন, ৮ম শ্রেনী- ৪১ হাজার ২শ, ৯ম শ্রেনী- ৩৮ হাজার ৫শ ৫০ জন ও ১০ম শ্রেনীতে ৩৪ হাজার ৯শ ৫০জন নতুন বছরের বই পেয়েছে’।
জেলা শিক্ষা অফিসের এই পরিসংখ্যান মতে জেলায় এবছর নতুন শ্রেনীতে ভর্তিকৃত শুধুমাত্র ৬ষ্ঠ শ্রেনীর শিক্ষার্থীদের কাছ থেকেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি
নীতিমালা বহির্ভুত অবৈধ ভাবে গড়ে (ভর্তি ও টিউশন ফি খাত) থেকে মাত্র এক হাজার টাকা অতিরিক্ত আদায় করে থাকলেও সেই টাকার পরিমান দাঁড়ায় ৪ কোটি ৬৩
লক্ষ ৫০ হাজার টাকা। এভাবে ৬ষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেনী পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানগুলি অভিভাবকদের কাছ থেকে প্রতি শ্রেনীতে পৃথক ভাবে যে টাকা আদায় করেছে তার পরিমান যোগ বিয়োগ গুন ভাগ করলে যে কোন প্রাথমিক শিক্ষার জ্ঞান সম্পন্ন ব্যক্তি বা নাগরিকই বুঝতে পারবেন কি পরিমান টাকা অবৈধ ভাবে শিক্ষা খাত থেকে আদায় করা হচ্ছে। এতোবড় পুকুর চুরির ঘটনায় সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রশাসনের উদ্যোগহীন নীরব ভুমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে বলে মনে করছেন ভুক্তভোগী অভিভাবকরা।
কুষ্টিয়া শহরের কোর্ট পাড়ার বাসিন্দা অভিভাবক শেহাব উদ্দিন তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, ‘এসব জেগে থাকা ঘুমন্ত কর্তাবাবুদের ভেলকিবাজি তামাসা ছাড়া কিছুই না। নতুন ক্লাশে ভর্তি ও মাসিক টিউশন ফি
বিষয়ক সরকারী পরিপত্র এবং মন্ত্রনালয়ের কঠোর নির্দেশনা থাকার পরও সেগুলি তুছজ্ঞান করে চলেছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি ? তারা রাষ্ট্রের সব রকম
সুবিধা নিবেন আর রাষ্ট্রের বিধি বিধান আইন কানুন মানবেন না; এবং আইন ভঙ্গকারী এসব বেপরোয়া প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন রহস্যজনক
কারনে কোন পদক্ষেপও গ্রহন করবেন না; সেটা কি করে সম্ভব ? বরং অদৃশ্য শত্রু কারনে প্রশাসনের কোন ভুমিকা না থাকায় লাগামহীন ভাবে শিক্ষা ব্যয় বেড়েই
চলেছে’।
শহরের মজমপুর এলাকার অভিভাবক আছমা হক বলেন, ‘জেলা প্রশাসকের সভাপতিত্বে মাসিক টিউশন ফি নির্ধারণ বিষয়ক কামিটি কর্তৃক নির্ধারিত ৬ষ্ঠ শ্রেনীতে মাসিক বেতন নূন্যতম ৮০ টাকা তবে ক্রমাধিক সুবিধা প্রাপ্তির ভিত্তিতে সেটা কোন ভাবেই ১শ ২০টাকার অধিক হবে না। আপনারা যান দেখে আসুন স্বয়ং সভাপতির নিজের স্কুলেই মাসিক বেতন আদায় করছেন ৭শ টাকা। পুলিশ প্রশাসন পরিচালিত পুলিশ লাইন্স স্কুলেও একই অবস্থা। আদৌ কি কেউ আছেন এসব দেখে সমাধানে উদ্যোগ নেবেন’?
নীতিমালা বহির্ভুত ভর্তি ফি এবং অতিরিক্ত টিউশন ফি আদায় বিষয়ে ‘পুলিশ লাইন্স স্কুল এন্ড কলেজে’র প্রধান শিক্ষক মো: নাজমুল আরেফিন বলেন, ‘প্রতি বছরই ভর্তি এবং টিউশন ফি কত টাকা নির্ধারণ করা হবে তা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা পর্ষদের সভায় নেয়া সিদ্ধান্ত থেকে নির্ধারিত হয়ে থাকে’। এখানে কারো ব্যক্তিগত বা মনগড়া কোন সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়ার সুযোগ নেই’।
কুষ্টিয়া জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মুন্সী কামরুজ্জামান বলেন, ‘মাসিক টিউশন ফি নির্ধারণ বিষয়ক জেলা শিক্ষা কমিটি কর্তৃক নির্ধারিত বেতন ফি’র অতিরিক্ত টাকা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি আদায় করছেন এবিষয়ে লিখিত অভিযোগ
পেলে অবশ্যই তদন্ত করে দায়িদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে’।
জেলা শিক্ষা কমিটির সভাপতি ও জেলা প্রশাসক মো: তৌফিকুর রহমান জানান, ‘সরকারী নীতিমালা ও পরিপত্রে নির্ধারিত ভর্তি ফি’র তুলনায় শিক্ষা
প্রতিষ্ঠান অতিরিক্ত টাকা আদায় করছেন, এমন অভিযোগ তদন্তে সত্যতা পাওয়া গেলে ওই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কঠোর ভাবে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে’।
তার নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘কালেক্টরেট স্কুল এন্ড কলেজ’ও নীতিমালা ও পরিপত্রের নির্দেশনা মানছেন না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি’।
এবি//দৈনিক দেশতথ্য //জানুয়ারী ২৯,২০২৫//
![প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন](http://dailydeshtottoh.com/wp-content/plugins/wp-print/images/printer_famfamfam.gif)
Discussion about this post