ইবতেশাম রহমান সায়নাভ (বেরোবি) :
একটি চুপচাপ ছেলেকে দেখে কে বলবে সে একদিন পুরো বিশ্বকে নাড়িয়ে দেবে? অথচ ঠিক সেটাই করেছিলেন আবু সাঈদ। তাঁর মৃত্যু কেবল একটি জীবন হারানোর ঘটনা নয়, বরং একটি আন্দোলনের জন্ম, একটি প্রশ্নের আগুন, একটি প্রতিবাদের অনন্ত প্রতিধ্বনি। ক্লাসে নিয়মিত, বন্ধুবৎসল, বইয়ের পাতায় ডুবে থাকা এক তরুণ। কিন্তু দেশের ভেতরে চলা প্রশাসনিক বৈষম্য, অব্যবস্থাপনা ও অনিয়ম তাঁকে ভাবিয়ে তুলেছিল। তিনি প্রতিবাদমুখর ছিলেন না, তবে নিরবে ক্ষোভ পুষে বেড়াতেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আবু সাঈদ মানে এক ধরনের ভারী শূন্যতা। তিনি কেবল একটি নাম নয়—তিনি একটি যন্ত্রণা, একটি প্রতিজ্ঞা, একটি প্রতিবাদের প্রতীক। আর এই প্রতীকের নাম আবু সাঈদ।
২০২৪ সালের ১৬ জুলাই। বেরোবির আকাশটা তখন স্বাভাবিক ছিল, কিন্তু মাটির নিচে যেন কিছু একটার প্রস্তুতি চলছিল। ক্যাম্পাসে তখন বৈষম্যের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ দানা বাঁধছে। আবু সাঈদ তখন ইংরেজি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। সাধারণ এক ছাত্র, যার মুখে স্লোগান ছিল না, হাতে ছিল না কোনো প্ল্যাকার্ড—তবু তিনি প্রতিবাদের প্রতীক হয়ে ওঠেন।
দুপুর আড়াইটা। পুলিশের লাঠিচার্জ ও টিয়ার গ্যাসে যখন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা ছত্রভঙ্গ তখন আবু সাঈদ বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন একটি লাঠি হাতে। পুলিশ ৫০-৬০ ফুট দূর থেকে ছররা গুলি চালায়, কিন্তু সাহস হারাননি তিনি। গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন আবু সাঈদ, কিন্তু মাথা নত করেননি। আন্দোলনের প্রথম শহীদ হয়ে তিনি হয়ে উঠেন অধিকার আদায়ের এক অমর প্রতিচ্ছবি।
সেদিন অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে গেলে ঘটে সেই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। সহপাঠীদের চোখের সামনেই হামলার শিকার হন আবু সাঈদ। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু ঘটে এই মেধাবী তরুণের।
আবু সাঈদের জীবন ছিল সাদামাটা। পরিবার ছিল সাধারণ, স্বপ্ন ছিল শিক্ষার আলোয় আলোকিত হওয়া। কিন্তু তাঁর মৃত্যু তাঁকে অসাধারণ করে তোলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে তিনিই প্রথম শহীদ—প্রশাসনিক বৈষম্য ও অবিচারের বিরুদ্ধে প্রাণ উৎসর্গকারী।
সেদিন যদি সে না মরত, আমরা হয়তো কখনো জানতে পারতাম না—আমাদের মধ্যে কেউ একজন ছিল, যে নীরবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়ছিল।
আবু সাঈদের মৃত্যুর পর উত্তাল হয়ে ওঠে ক্যাম্পাস তথা পুরো রাষ্ট্র। ছাত্ররা বুঝতে পারে, একটি প্রাণ হারিয়ে গেছে শুধুমাত্র অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায্য অবস্থান নেওয়ার কারণে। ১৬ জুলাইয়ের ধারাবাহিকতায় প্রশাসন ও রাষ্ট্রের কাছে জবাব চাইতে শিক্ষার্থীরা গড়ে তোলে তীব্র আন্দোলন। যেখানে পতন ঘটে দীর্ঘদিন বাঙ্গালির ঘাড়ে চেপে বসে থাকা এক শক্তিশালী ফ্যাসিজমের।
আজ শহীদ আবু সাঈদের নামে কোনো বড় পুরস্কার নেই, নেই কোনো জাতীয় স্বীকৃতি। তবু তাঁর নাম উচ্চারিত হয় শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায়, আর প্রতিবাদের অঙ্গীকারে।
আবু সাঈদ আমাদের চোখে একজন নিঃশব্দ যোদ্ধা। তিনি হাত তুলে বলেননি, “আমাকে মনে রেখো”—তবুও তাঁর নিঃশব্দ মৃত্যু আমাদের কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হয় বারবার।
১৬ জুলাই দিনটি বেরোবি ক্যাম্পাসে হয় শ্রদ্ধাঞ্জলি, রক্তদান কর্মসূচি, স্মৃতিচারণ, বিতর্ক, চিত্রাঙ্কন ও সেমিনারের মত আয়োজন। কিন্তু সবচেয়ে বড় বিষয়—এই দিনে সবাই স্মরণ করে, বিশ্ববিদ্যালয়ের মাটিতে প্রথম যার রক্ত ঝরেছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে।
শহীদ আবু সাঈদের কথা স্বরণ করে ইংরেজি বিভাগের ১১তম আবর্তনের শিক্ষার্থী সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, “পৃথিবীতে কিছু নির্ভীক মানুষের জন্ম হয় ইতিহাস রচনা করার জন্য। আবু সাঈদ ছিল তেমনি নির্ভীক একজন মানুষ।কোন বাধা-বিপত্তি বা ভয় তাঁকে তাঁর সংকল্প থেকে টলাতে পারেনি। সাঈদকে সবসময় শান্ত ছেলে হিসেবে দেখে এসেছি। দেখা হলেই হাসিমুখে গুটিশুটি হয়ে সালাম দিত, কেমন আছি জিজ্ঞেস করতো। ‘চব্বিশের কোটা সংস্কার আন্দোলনে’ ভিন্ন এক সাঈদকে প্রত্যক্ষ করেছি।শুরু থেকেই ও কোটা সংস্কারের দাবিতে সরব ছিল। কোনো আক্রমণ,কোনো হুমকিতে অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ করেনি সে,মাথা নত করেনি। ১১ জুলাই সাঈদকে আক্রমণ করার খবর জেনে যখন ওকে ফোন দিলাম তখনও ওর মধ্যে ন্যূনতম ভয় ছিলোনা। বরং কিভাবে আবার সবকিছু গুছিয়ে আন্দোলন এগিয়ে নেওয়া যায় আমাকে সেই পরিকল্পনা জানাচ্ছিলো। ওঁর দৃঢ়তা দেখে অবাক হয়েছিলাম। সেই দৃঢ়তা নিয়েই সে ১৬ই জুলাই দুই হাত প্রসারিত করে দাঁড়ালো সরকারের লেলিয়ে দেয়া পেটুয়া বাহিনীর বুলেটের সামনে। নিজের জীবন বিসর্জন দিলো ছাত্র-জনতার অধিকার আদায়ের জন্য।তাঁর এই বিসর্জন দেশের জনগণকে অনুপ্রাণিত করলো দেশকে স্বৈরাচার মুক্ত করতে। আবু সাঈদ আমাদের গর্ব। আমরা বীর শহিদ আবু সাঈদকে স্মরণ রাখবো আজীবন।
ইংরেজি বিভাগের ১৪ তম আবর্তনের শিক্ষার্থী আল মুবিন বলেন, “আমি তখন প্রথম সেমিস্টারের একজন সিআর। একদিন ভাই হঠাৎ করে নক দিয়ে বললেন, “ভাই, ব্লাড লিস্টটা দিও।” কথায় ছিল না কোনো হুকুমের সুর—ছিল অনুরোধ, ছিল দায়িত্ব ভাগ করে নেওয়ার আন্তরিকতা। আরও পরামর্শ দিলেন, যেন কাজটা আরও গুছিয়ে করি। তখন বুঝিনি, এ মানুষটা কতটা মাটির কাছের, কতটা মানুষের জন্য নিবেদিত।
ভাই সবসময়ই মানুষের জন্য কাজ করতেন। তবে তা প্রচারের জন্য নয়—করতেন নীরবে, নিঃস্বার্থভাবে। আমাদের বিভাগের অনেকেই হয়তো তাঁকে খুব ভালো করে চিনতেন না, কারণ ভাই নিজের প্রচার কখনোই চাননি। ছিলেন চুপচাপ, বিনয়ী, আলোচনার আড়ালে থাকা এক যোদ্ধা।
কোটা বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলনের শুরুতে একদিন ভাই আমাকে ফোন করে বললেন,
“মুবিন, মানববন্ধন করবো, ব্যাচে জানিয়ে দিও।”
এরপর কয়েকদিন এমন যোগাযোগ ছিল। সব সময়ই পরিকল্পনা ছিল বাস্তব আর মানবিক।
১৬ জুলাই সকাল ১০টা ৩৪ মিনিট। ভাইয়ের সঙ্গে শেষ কথা হয় সেদিনই।
বললাম, “পরিস্থিতি ভালো না ভাই, আজকে কি বের হবেন?”
উত্তর এল, “রেডি থাকো, জানালেই চলে আসবে। সাবধানে থেকো।”
সেই ‘সাবধানে থেকো’ শব্দটা এখনও কানে বাজে। আমি তো এখনো বেঁচে আছি,
কিন্তু আপনি আমাকে সাবধান থাকতে বলে চিরতরে চলে গেলেন, ভাই।
আমার চিৎকার, “সাঈদ ভাই, সরে যান!”—তা যদি একবার শুনতেন!
আপনি হয়তো মরে গিয়েও বেঁচে আছেন,
আর আমি বেঁচে থেকেও প্রতিদিন একটু করে মরে যাচ্ছি—অসহায় এক যন্ত্রণায়, অপরাধবোধে।
আপনি আমাদের শিখিয়ে গেলেন, মানুষ শুধু বড় পদ বা পরিচয়ে বড় হয় না—মানুষ মানুষের জন্য কাজ করেই ইতিহাস হয়ে ওঠে।
আপনার মতো সাহস হয়তো আমাদের কারও হবে না, তবে আপনার রেখে যাওয়া আলো পথ দেখাবে আমৃত্যু। সালাম, বীর।”
আবু সাইদের সহযোদ্ধা ও গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ১৩তম আবর্তনের শিক্ষার্থী শাহারিয়ার সোহাগ বলেন, “২০২৪ এর ৫ই জুন ২০১৮ সালে বাতিল হওয়া কোটা পদ্ধতি আবারও সম্পুর্নভাবে পূনর্বহাল করা হলে সারাদেশের মতো বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও এই আন্দোলনে সক্রিয় হয়।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম আন্দোলন হয় ৩০ জুন। বাংলা বিভাগের শামসুর রহমান সুমন, ইংরেজি বিভাগের মো. শফিকুল ইসলাম, ফাইন্যান্স এন্ড ব্যাংকিং বিভাগের ফয়সাল, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের গোলাম শাওন, পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের কামরুল হাসান কাব্য সহ আরও কয়েকজন শুরুতে হয়ে আন্দোলনের ডাক দেয়।
এ সময় বাংলা বিভাগের আয়োজনে একটি আন্তর্জাতিক সেমিনার চলছিল। সেমিনারে অংশ নেওয়ায় প্রথম দিনের আন্দোলনে যুক্ত হতে পারলেও তাদের ব্যানার আমার চোখে পড়ে। লক্ষ্য করি, তারা ব্যানারে লিখেছে ‘১৮ এর পরিপত্র পূনর্বহাল করতে হবে’। এটি দেখে কামরুল হাসান কাব্যের সাথে যোগাযোগ করে তাকে জানাই, “কোটার মাত্রা ৫৬ শতাংশ হওয়া যেমন অন্যায্য তেমনি কোটা শূন্য শতাংশ হওয়াও অসাংবিধানিক। আমাদের উচিৎ হবে কোটা পদ্ধতির সংস্কার করে এটিকে সহনীয় ও যৌক্তিক পর্যায়ে আনার দাবি তোলা।”
এই আলোচনার পর পরবর্তী আন্দোলনগুলো আর ১৮এর পরিপত্র পুনর্বহাল নয় বরং কোটা সংস্কারের দাবিতে হয়।
পহেলা জুলাইয়ের আন্দোলনে আবু সাঈদ ভাইসহ আমরা অনেকে যুক্ত হলে আন্দোলন আন্দোলন বেগবান হয়। আন্দোলনে যুক্ত হয়ে সেদিন গণমাধ্যমকে আমি জানাই, ‘যখন আমাদের ব্যস্ত থাকার কথা শিক্ষা-গবেষণা-খেলাধুলায়, সেখানে কোটাব্যবস্থার পুনর্বহাল আমাদের একটি ভাত দে টাইপের আন্দোলনের দিকে ঠেলে দিয়েছে।’
জুলাইয়ের শুরু থেকে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন যখন বড় হচ্ছে, তখন আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারীদের মধ্যে ছাত্রলীগের ব্যাপক প্রভাব লক্ষ করি। তারা মূলত আন্দোলনের গতিপথ নির্ধারণ করে দিচ্ছিল। তবে ৭ জুলাইয়ের একটি ঘটনা সব ঘুরিয়ে দেয়।
সেদিন সারা দেশের সঙ্গে সমন্বয় রেখে আমরা ঢাকা-কুড়িগ্রাম মহাসড়কের মডার্ন মোড়ে ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি পালন করছিলাম। কর্মসূচি চলাকালে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি পোমেল বড়ুয়া হঠাৎ ওই স্থানে আসেন এবং তৎক্ষণাৎ কর্মসূচি তুলে নিতে বলেন। তখন গতানুগতিকভাবে ছাত্রলীগের অন্যায় নির্দেশ মেনে অনেকে কর্মসূচি শেষ করতে চাইলে আমি দৃঢ় কণ্ঠে তার প্রতিবাদ জানাই। এই প্রতিরোধের ফলে অন্য শিক্ষার্থীরাও ধীরে ধীরে কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে দাঁড়িয়ে যায়। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে ছাত্রলীগ সভাপতি স্থান ত্যাগ করেন।
৭ জুলাইয়ের এই প্রতিরোধ সাধারণ শিক্ষার্থীদের ভয় ভেঙে দেয়। ১০ জুলাই আসতে আসতে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে ওঠে আন্দোলনের অন্যতম দুর্গ।
১০ জুলাই অভিযোগ আনা হয়, ছাত্রলীগ সভাপতির সঙ্গে বিরোধ বাধিয়ে আমি সবার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গেছি। ‘বিভেদ সৃষ্টিকারী’ আখ্যা দিয়ে নেতৃত্বের একটি অংশ আমাকে আন্দোলন পরিচালনার কেন্দ্রীয় গ্রুপ থেকে বহিষ্কার করে। আমি সাময়িকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি।
১১ জুলাই পূর্বঘোষিত কর্মসূচিতে ছাত্রলীগ অকস্মাৎ দলবদ্ধভাবে হামলা করে। ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে বুক আগলে দাঁড়ান আবু সাঈদ ভাই। অন্যান্য শিক্ষার্থীর সঙ্গে সেদিন তিনি আক্রমণ ও লাঞ্ছনার শিকার হন। আকস্মিক এ হামলা আন্দোলনকারীদের মনোবল ভেঙে দেয়। আমি ফেসবুক পোস্ট দিই, ‘বেরোবির (বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়) আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারীদের বিভিন্ন সময়ের আপসকামী ও নতজানু ভূমিকা নিয়ে আমাদের সমালোচনা রয়েছে। তাদের এই আপসকামী ও নতজানু মনোভাবের জবাব বেরোবির সাধারণ শিক্ষার্থীদের দিতে হবে।’
এরপর আবু সাঈদ ভাই আবার আমাকে আন্দোলন পরিচালনার কেন্দ্রীয় গ্রুপে যুক্ত করেন। গ্রুপের একজন অ্যাডমিনও করেন। পরে তিনিই আমাকে সারা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ‘সমন্বয় সারাদেশ’ গ্রুপে যুক্ত করেন।
১২ জুলাই আন্দোলনে ফেরার পর মনে হয়, সমন্বয়ক প্যানেল প্রকৃত আন্দোলনকারীদের দিয়ে ঢেলে সাজাতে না পারলে আন্দোলনে গতি আসবে না। আবু সাঈদ ভাইয়ের সঙ্গে পরামর্শ করি। একটি সভায় সবার সিদ্ধান্তে বিভিন্ন বিভাগের জ্যেষ্ঠ শিক্ষার্থীদের যুক্তকরা হয়। দুজন নারী, ইংরেজি বিভাগের সাবিনা ইয়াসমিন ও ব্যবস্থাপনা অধ্যয়ন বিভাগের সাবিনা আক্তারকে সমন্বয়ক হিসেবে যুক্ত করে প্যানেলটি ঢেলে সাজানো হয়।
১১ জুলাই রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে হামলা ও গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে শিক্ষার্থীদের নিয়ে ক্যাম্পাসে আমরা বিক্ষোভ মিছিল করি। মূলত এদিনই বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কোটা আন্দোলন ছাত্রলীগের ‘ছায়া আন্দোলন’ থেকে বেরিয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন হয়ে ওঠে। শিক্ষার্থীরা সাহসী হয়ে ওঠে। ১৩ ও ১৪ জুলাই আন্দোলন কর্মসূচিতে শিক্ষার্থীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নেয়।
১৩ জুলাই জানতে পারি, তাজহাট থানায় কয়েকজন আন্দোলনকারীর নাম তালিকাভুক্ত হয়েছে। তাতে আবু সাঈদ ভাই, আমিসহ আরও কয়েকজনের নাম আছে।
১৪ জুলাই শেখ হাসিনা ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ বলে আখ্যায়িত করলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও ক্ষোভে ফেটে পড়ে। রাতে এই বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় ডাক দেওয়া বিক্ষোভ মিছিলে অংশ নিতে মেয়েরা হলের তালা ভেঙে বের হয়ে আসে। ক্যাম্পাস পরিণত হয় জনসমুদ্রে। বঙ্গবন্ধু ও শহীদ মুখতার ইলাহী হলের সন্ত্রস্ত ছাত্রলীগ কর্মীরা দেশি অস্ত্র নিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায়। ‘কোটা সংস্কার আন্দোলন’ এই দিনে ‘রাষ্ট্রসংস্কার আন্দোলনে’ রূপ নেয়।
ছাত্রলীগের সশস্ত্র হামলার কারণে নেতৃত্বস্থানীয় অনেকে আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়ায়। যখন চরম নেতৃত্বশূন্যতায় ভুগছে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, তখন নেতৃত্বে এসে যুক্ত হন ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের আশিকুর রহমান আশিক ও আকিব ভাই।
১৫ জুলাই আবু সাঈদ ভাই ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করতে চাচ্ছিলেন, তখনই কোনো কর্মসূচি দিতে সম্মত ছিলেন না। তবে আন্দোলনের পটপরিবর্তনের সময় ধারাবাহিক কর্মসূচি জারি রাখার গুরুত্ব অনুধাবন করে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের জাব্বার, সাংবাদিকতা বিভাগের দীপ্ত তালুকদার, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শাওনসহ আমরা কয়েকজন আবু সাঈদ ভাইয়ের ছাত্রাবাসে যাই। তাঁর সম্মতি নিয়ে কর্মসূচি হাতে নিই।
কর্মসূচি ঘোষণার পর নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে দেখি, দেশি অস্ত্র হাতে আমাদের জমায়েতের স্থান ছাত্রলীগ আগেই দখলে নিয়েছে। আমরা কর্মসূচি পালন করতে পারিনি। আমরা তাৎক্ষণিক জরুরি সভা ডাকি। অবস্থা সেদিন এতটা ভয়াবহ ছিল যে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশে কোথাও একত্র হতে পারছিলাম না। তাই কারমাইকেল কলেজের কাছে গিয়ে সভা করি। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী রিনা মুর্মুর সভাপতিত্বে জেলা পর্যায়ের বিভিন্ন স্কুল-কলেজের সমন্বয়কদের যুক্ত করা হয়। গোয়েন্দা পুলিশ আমাদের ওপর নজর রাখছিল।
আন্দোলনের কিছু কৌশলে পরিবর্তন আনা হয়। সিদ্ধান্ত হয়, ১৬ জুলাই কারমাইকেল কলেজের সামনে কর্মসূচির জমায়েত করব। তবে ১৬ জুলাই আসতে আসতে পরিস্থিতি কঠিন হয়ে পড়ে। শিক্ষার্থীদের কেউ সাউন্ড সিস্টেম ভাড়া দিচ্ছিলেন না। দিলে গ্রেপ্তার বা জরিমানা করা হচ্ছে।
অনেকটা উপায়হীন অবস্থায় গণসংহতি আন্দোলন রংপুরের নেতা তৌহিদুর রহমানের সঙ্গে কথা হয়। তিনি শুরু থেকেই আন্দোলনে সমর্থন দিয়ে আসছিলেন। তিনি সব ব্যবস্থা করে দেন।
১৬ জুলাই সকালে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। বৃষ্টি মাথায় করে আমি, আশিক ভাই ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মুনতাসীর বেরিয়ে পড়ি সব সংগ্রহ করতে। সাউন্ড সিস্টেম ভাড়া না পেয়ে টাউন হলের সামনে থেকে দুটি হ্যান্ডমাইক কিনে নিই। আত্মরক্ষার জন্য তৌহিদ ভাইয়ের নির্ধারিত দোকান থেকে ৫০টি এসএস পাইপ কিনে সেগুলোর সঙ্গে পতাকা বেঁধে নিই। আমাদের পরিকল্পনা ছিল, ৫০ জন পতাকাধারী মিছিলের সামনে ও পেছনে অবস্থান নেবে, যাতে ছাত্রলীগ অস্ত্র নিয়ে হামলা চালালে আমরা অন্তত আত্মরক্ষা করতে পারি।
আমরা বুঝতে পেরেছিলাম, যেখানেই জমায়েতের স্থান দিই না কেন, ছাত্রলীগ আগেই তার দখল নেবে। তাই কর্মসূচি বেলা তিনটায় থাকলেও তাৎক্ষণিকভাবে কয়েকজন মিলে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়ে সকাল ১০টা ১৫ মিনিটে ঘোষণা দিই যে আজকের কর্মসূচি শুরু হবে বেলা ১১টায়।
সিদ্ধান্তটি খুবই কার্যকর ছিল। রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, কারমাইকেল কলেজ, রংপুর কলেজ, পুলিশ লাইনস স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজসহ শহরের সব স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীরা পুলিশ ও ছাত্রলীগের বাধা উপেক্ষা করে কারমাইকেল কলেজের সামনে সংগঠিত হয়। এরপর জনসমুদ্র এগোতে থাকে বিশ্ববিদ্যালয় অভিমুখে।
এরপর যে ঘটনাটি ঘটে, তা এই আন্দোলনকে একেবারে পাল্টে দেয়। সারাদেশের মানুষ বানের জলের মতো রাস্তায় নেমে এসে গ্রাস করে ফ্যাসিবাদের পুরোনো দালান। দুই বাহু মেলে দেওয়া আবু সাঈদ ভাইকে যে বুলেটগুলো বিদ্ধ করল, সেগুলো যেন একেকটি পেরেক হয়ে বিঁধল ফ্যাসিস্টদের কফিনে।
আবু সাঈদ ভাই বা আমিসহ আরও শতাধিক শিক্ষার্থী-জনতা গুলিবিদ্ধ হই। সাঈদ ভাইয়ের ঠিক পেছনেই মাইক হাতে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি। প্রাণপণ ডেকেও তাঁকে ফেরাতে পারিনি। তিনি আত্মহুতি দিলেন। কিন্তু সারা দেশের জন্য হয়ে উঠলেন মুক্তির উজ্জ্বল প্রতীক!”
আবু সাঈদকে স্বরণ করে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ১১ আবর্তনের শিক্ষার্থী সাইদুর জামান বাপ্পি বলেন, “আবু সাঈদ কে নিয়ে লিখতে গেলে যুৎসই শব্দ খুঁজে পাই না, খুঁজে পেলেও সাজাতে পারি না।
আবু সাঈদ — সেই নাম, যা শুধু একটি মানুষের নয়, একটি ত্যাগের ইতিহাস।
জুলাইয়ের গরম দুপুরে যখন চারদিক নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল, তখন আবু সাঈদ বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন দেশের জন্য। নিজের প্রাণকে তুচ্ছ করে এগিয়ে গিয়েছিলেন সেই প্রহরে, যখন পিছু হটলে হয়তো জীবন বাঁচতো, কিন্তু মাথা উঁচু করে বাঁচতো না এই স্বাধীনতা।
তার রক্তের প্রতিটি ফোঁটা এই মাটিকে করেছে আরও বেশি পবিত্র। তার সাহস আমাদের শিখিয়েছে—প্রকৃত বীর কখনো নিজের জন্য নয়, দেশের জন্য বাঁচে, দেশের জন্যই প্রাণ দেয়।
আজ যখন আমরা মুক্ত আকাশের নিচে নিশ্বাস নেই, তখন মনে রাখতে হবে—এই স্বাধীন বাতাস, এই লাল-সবুজ পতাকা, এই নির্ভীক হাঁটা, সবই তার রেখে যাওয়া উপহার।
আবু সাঈদ প্রমাণ করে গেছেন — যোদ্ধারা শুধু মরণক্ষেত্রে নয়, মানুষের হৃদয়ে বেঁচে থাকেন চিরকাল।”
কখনো কখনো কোনো মানুষ নিজে আলোয় না এসেও চারপাশ আলোকিত করে যান। ছিলেন নীরব, ছিলেন সাধারণ, অথচ তাঁর ভেতরে ছিল অসম্ভব সাহস, দায়িত্ববোধ আর গভীর মানবিকতা। আমাদের সাঈদ ভাই ছিলেন ঠিক তেমন একজন মানুষ। তাই তো আবু সাঈদের আরেক সহযোদ্ধা পরিসংখ্যান বিভাগের ১২তম আবর্তনের শিক্ষার্থী খোকন ইসলাম লিখেছেন,
ডানামেলা শান্ত ড্রাগন – আবু সাঈদ
বহু বছর বাদে দেখা হলে,
প্রেমিক ৭ কিংবা ৫ হাত তফাৎ -এ
যেভাবে দু’হাতে মেলে
বুক পাতে, প্রেমিকার মাথা
হৃদপিণ্ডের ভিতর নিতে।
ঠিক্;
ঠিক সেভাবেই আমাদের আবু সাইদ
বুক পেতেছিলো
“পুলিশ ” নামের কিছু বুনো শুয়োরের সামনে
বিশ্বাস করুন বন্ধুগণ
যারা ভালোবাসতে জানে
তারা মানুষ -পশুতে তফাৎ এ-র
প্যারামিটার গুলো জানে না৷
বুকে পাতা সিংহাসন দেখে
লোভ সামলাতে পারে নি,
ঘাতক বুলেট!
পাজর, কোমড় এবং হৃদয়
ঝাঁঝরা হয়ে যায়,
প্রেমিকার মতোন সাঈদ
মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে নেয়।
তার চোখ বুজে আসে
এলোমেলো পায়,
শেষ চুম্বন দিবে বলে
মাতৃভূমিতে লুটিয়ে পরে।
হায় – রক্তে লিখে
শুয়োরের বাচ্চা – দেশটা তোর বাপের একার নয়।
কেবল আফসোস
বিজয়ী সাঈদের কপালে
” মা ” চুমু একে দিতে পারবে না।
আমাদের সাঈদ – এখন
মাতৃভূমির বুকে ঘুমায়!
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের পাশেই স্থাপন করা হয়েছে শহীদ আবু সাঈদ স্মৃতি স্তম্ভ। সেখানে তার একটি কথা লেখা—‘প্রয়োজনে শহীদ হবো, তবু মাথা নত করবো না।’
ছাত্রদের মুখে মুখে ঘুরে বেড়ায় আবু সাঈদের নাম, শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায়। তাঁর মৃত্যু যেন হয়ে উঠেছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজের সাহসিকতার প্রতীক।
শহীদ আবু সাঈদ কোনো বড় মঞ্চে দাঁড়িয়ে ভাষণ দেননি, কোনো দলের পতাকা বহন করেননি। তবুও তিনি ইতিহাসের পাতায় অমর—কারণ তিনি নিজের প্রাণ দিয়ে বলে গেছেন, “প্রতিবাদ না করলেই অন্যায় টিকে থাকে”।
আবু সাঈদ বেঁচে নেই, কিন্তু তিনি আজও জেগে আছেন বেরোবির প্রতিটি ইট-পাথরে, শিক্ষার্থীদের মননে। তিনি কোনো রাজনৈতিক ব্যানারের নাম নন, তিনি একটি মূল্যবোধের প্রতীক—ন্যায়, প্রতিবাদ ও মানবিকতার নাম।
যতদিন অন্যায়ের বিরুদ্ধে একজন শিক্ষার্থী কণ্ঠ তুলবে, আবু সাঈদ ততদিন বেঁচে থাকবেন।
লেখা :
ইবতেশাম রহমান সায়নাভ
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ,
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।

Discussion about this post