Print Date & Time : 4 July 2025 Friday 4:07 pm

নেছারাবাদের মশারি শিল্প ও ২০ গ্রামের মানুষের রুটি রুজি

কি অপূর্ব সৃষ্টি। প্রকৃতির রাজ্যে জাঁকিয়ে রাজত্ব করে যাচ্ছে মশা। মশা পতঙ্গ পরিবারের প্রায় ৩৬০০ প্রজাতির মধ্যে ছোট্ট একটি প্রজাতি। মশা স্প্যানিশ এবং পর্তুগিজ শব্দ। মশা নিয়ে রয়েছে অসংখ্য কথা। এই মশার ভয়ে ঘরের মধ্যে ঘর বানিয়ে পালিয়ে থাকে সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ।

মশার কামড় থেকে বাঁচার জন্য গড়ে উঠেছে অনেক শিল্প কারখানা। এই মশার সুবাদে পিরোজপুরের নেছারাবাদ উপজেলার সুটিয়াকাঠি ইউনিয়নে গড়ে উঠেছে মশারি শিল্প। প্রায় ৫০ বছর ধরে এই শিল্পে শ্রম দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছে ২০ গ্রামের মানুষ।

ওই গ্রামের নারী পুরুষ সবাই মিলে বৈদ্যুতিক ও বৈদ্যুতিক সেলাই মেশিন নিয়ে ঘরেই খুলেছেন মশারি তৈরীর কারখানা। রাজধানীর গাউসিয়া থেকে গজ হিসেবে নেট কাপড় কিনে মশারী বানিয়ে টিকে আছে ৫০ বছর ধরে।

ওই গ্রামের প্রত্যেক পরিবারেই নারী পুরুষের পাশাপাশি দরিদ্র ঘরের শিক্ষার্থীরাও লেখাপড়ার ফাকে ফাকে মশারি সেলাই করে রোজকার করছেন। কোন ঘরের ভিতরে না ঢুকলে কেহ বিশ্বাসই করতে চাইবেনা যে, গ্রামের ছায়াঘেরা বাড়িগুলোয় এত মশারি তৈরি হচ্ছে। বাড়ির বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই কি কর্মযজ্ঞ চলছে বাড়িগুলোর মধ্যে।

এই উপজেলার কেবল সুটিয়াকাঠী ইউনিয়নের ওই একটি মহল্লাই নয়; আশপাশের কৌরিখাড়া, নান্দুহার, ইন্দেরহাট, মিয়ারহাট, সোহাগদল, বিন্না, জিলবাড়ি, চামি, ডুবি, উড়িবুনিয়া ও বলদিয়া ইউনিয়নের পঞ্চবেকি সহ নেছারাবাদ উপজেলার ২০ টি গ্রামে প্রায় ২০০ টি মশারি তৈরির ছোট বড় কারখানা রয়েছে।

এসব গ্রামের অগণিত পরিবারের নিজেরা মশারি তৈরি করছে নিজেদের বসত ঘরে। প্রতিদিন এসব গ্রাম থেকে হাজার-হাজার মশারি স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে পাঠানো হয় ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায়।

তবে, উপজেলার ২০ গ্রামের ২০০ টি পরিবারে কমবেশি লোক মশারি শিল্পে জড়িত থাকলেও সুটিয়াকাঠির ৯নং ওয়ার্ডের পুরো মহল্লার লোকেরা এখনো পেশাটি আকড়ে ধরে বাচার চেষ্টা করছেন।

ওই ওয়ার্ডের প্রত্যেক ঘরেই তৈরি হয় মশারি। গ্রামের অধিকাংশ লোক দরিদ্র হওয়ায় পুজির অভাবে বাপ দাদার এ পেশাকে কোন রকমে আঁকড়ে ধরে বাচার চেষ্টা করছেন।

সরকারিভাবে সহজ শর্তে ঋনের অভাবে তারা স্থানীয় এনজিও থেকে চড়া সুদে ঋন এনে এখন কোনমতে ব্যবসা চালাচ্ছেন।

সুটিকাঠি ইউনিয়নের বৃদ্ধ নজরুল ইসলাম(৮৫) বলেন, স্বাধীনতার পূর্ব থেকে এ গ্রামের লোকেরা মশারি তৈরি করে সাবলম্বি হয়েছেন। তবে গ্রামের বেশির ভাগ লোক অভাবী হওয়ায় পূঁজির অভাবে মজুরির বিনিময়ে অন্যর ঘরে মশারি বানিয়ে সংসার নিয়ে আছেন কোনমতে।

মশারি কারিগর লিটন(৩৭) বলেন, বছরে শীতের মৌসুমে তাদের হাতে তৈরি নেট মশারির চাহিদা কম। এসময় ব্যবসা খারাপ থাকে। তিনি বলেন, তাদের হাতে তৈরী একটি মশারি ২০০-৫০০ টাকায় বিক্রি হয়। একটি ২০০ টাকার মশারিতে ৫০ টাকা এবং ৫০০ টাকার মশারিতে ১২০ টাকা লাভ হয়। একজনে প্রতি দিন দশটি মশারি বানিয়ে বিক্রি করতে পারলে মাসে ২০ থেকে পচিশ হাজার টাকা লাভ হয়। তা থেকে খরচপত্রাধি বাদ দিলে ১৫ থেকে ষোল হাজার টাকা থাকে।

দৈনিক মুজুরি বিনিময়ে মশারিকারিগর শিল্পি বেগম(৩৩) বলেন আমাদের ঘরে মোট পাঁচজন সদস্য। ঘরের ভিতরে আমরা দু’জনে মশারি বানিয়ে যা পাই ছেলে মেয়ে লেখা পড়া করিয়ে সুন্দরভাবে সংসার চলে। তবে ডাল সিজনে কাজ কম থাকে তখন এনজিও থেকে ঋন নিয়ে সংসার চালাই। তখন কিছুটা কষ্ট হয়। যদি নিজেদের ব্যবসাটা হতো। তাহলে কোন কষ্ট হতনা। এনজিও দিয়ে চড়া সুদের ঋনে এ ব্যবসা চালানো কষ্টকর।

নেছারাবাদ উপজেলা সদর থেকে সন্ধ্যা নদীর পশ্চিম পাড় সুটিয়াকাঠী গ্রাম। এ গ্রামের মহল্লায় মহল্লায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে বাড়ির আঙ্গিনায় গড়ে তোলা হয়েছে মশারি তৈরির কারখানা। তবে একটি মহল্লার সবকটি পরিবার মশারি তৈরির পেশায় নিয়োজিত। কারখানাগুলোয় ইলেকট্রিক্যাল আর প্যাডেল সেলাই মেশিনের ঠক ঠক শব্দ আর নানা যন্ত্রের ছন্দে ভোর থেকেই গভীর রাত পর্যন্ত চলে কর্মযজ্ঞ। চারদিকের নিস্তব্ধতা ভেঙে অবিরাম শব্দের মূর্ছনা যেন জানিয়ে দেয় এটা আর পাচঁটা মহল্লার মতো নয়, অজপাড়াগাঁয়ের এই মহল্লাটির নাম মশারী পট্টি। এখানকার দরিদ্র মানুষের হাতে এই শিল্পের গোড়াপত্তন হলেও ভাগ্য বদলায়নি তাদের। দাদন ব্যবসায়ী আর চড়া সুদে এনজিও থেকে লোন নিয়ে কোনভাবে তিন বেলা দু’মুঠো খেয়ে বাপ দাদার আদি ব্যবসা কে টিকে আছে এখানকার লোকগুলো।