নেপথ্যে দূর্ণীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান:
বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী
হাসান আলী\ কুষ্টিয়া প্রতিনিধি\
দখলে বাধা পেয়ে পদ্মার গতিপথ বদলে ভয়াবহ ভাঙ্গন বিপর্যয় ও আগ্রাসন ঠেকাতে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা প্রাক্কলন ব্যয়ে অনুমোদিত বাস্তবায়নাধীন ‘পদ্মা নদীর ভাঙ্গন হতে কুষ্টিয়া জেলার মিরপুর উপজেলাধীন তালবাড়িয়া এবং কুমারখালী উপজেলাধীন শিলাইদহ ইউনিয়নের কোমরকান্দি রক্ষা শীর্ষক প্রকল্প’ হাতে নেয় সরকার। কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ডের চরম অবহেলা গাফিলতি ও অনিয়মে অনিশ্চয়তার মুখে প্রকল্পটি। এতে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাবাসী বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে। ধ্বসে যাওয়ার শংকায় তীব্র প্রতিক্রিয়া ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের। তাদের অভিযোগ, সংশ্লিষ্ট উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ কতিপয় অসাধুদের অবৈধ সুবিধা দিতে এমন অনিয়ম ও ত্রæটিপূর্ন প্রক্রিয়ায় বাস্তবায়নাধীন জরুরী ও গুরুত্বপূর্ন এই প্রকল্পটিকে অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিয়েছে। তবে কিছু অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করলেও অবৈধ সুবিধার বিনিময়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড কোন দন্ডপ্রাপ্ত অযোগ্য ও কালো তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠান বিডিপিএল’কে উদ্দেশ্যমূলক ভাবে কাজ দেয়ার চেষ্টাকে অস্বীকার করছেন নির্বাহী প্রকৌশলী।
সরেজমিনে জানা যায়, জাতীয় মহাসড়ক, বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন, সেচপ্রকল্প, ৪১০ মেগা কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, সরকারী বেসরকারী নানা গুরুত্বপূর্ন প্রতিষ্ঠান ও অবকাঠামো, ঘরবাড়ি কৃষিজমিসহ বিস্তীর্ন এলাকাকে পদ্মা নদীর ভয়াল ভাঙ্গনের কবল থেকে রক্ষায় ডানতীরে প্রায় সাড়ে ১০ কিমি: দৈর্ঘের প্রকল্পটির আংশিক কিছু স্থানে ইতোমধ্যে বাঁধ নির্মান কাজ শুরু হয়েছে। তবে একযোগে কাজ না হওয়ায় চরম বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার বাসিন্দারা। তাদের অভিযোগ, এভাবে বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত স্থানে কাজ করার ভয়াবহ পরিনতি ঘটেছিলো শিলাইদাহ রক্ষা বাধ নির্মান প্রকল্পে। এমন দৃষ্টান্ত থাকার পরও পানি উন্নয়ন বোর্ড কার স্বার্থে আবার সেই একই ঘটনার সম্ভাবনাকে তুচ্ছ করে দেখছেন? অবিলম্বে জরুরী ভিত্তিতে সৃষ্ট জটিলতার নিরসন করে অদক্ষ প্রতিষ্ঠানকে বর্জন করে একযোগে কাজ শুরুর দাবি স্থানীয়দের।
মতিন কন্সট্রাকশন লি: এর সাইট ম্যানেজার রুপম হোসেন জানান, ‘পদ্মা নদীর ডানতীরে প্রায় সাড়ে ১০ কিমি: দৈর্ঘের প্রকল্পটির অতি জরুরী ভিত্তিতে আংশিক কিছু স্থানে ইতোমধ্যে কার্যাদেশপ্রাপ্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ শুরু করলেও আমরা আশঙ্কা করছি, নিয়ম বহির্ভুত এই প্রক্রিয়ায় আংশিক স্থানগুলিতে যে কাজগুলি হচ্ছে এবং সরকারের অর্থব্যয় হচ্ছে তা পুরোটায় গচ্চা যেতে পারে। এতে সময়মতো এবং সঠিক পদ্ধতিতে মান সম্মত কাজ অনিশ্চিত হয়ে যাবে তাতে কোন সন্দেহ নেই’।
অভিযোগ আছে, ২০১৬ সালে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড কুষ্টিয়া ডিভিশনের তত্বাবধায়নে ১শ ৭৬ কোটি ৫০লাখ টাকা ব্যয়ে এই প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ন অংশ “কুষ্টিয়া জেলায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুঠিবাড়ী সংলগ্ন এবং পাশ্ববর্তী এলাকায় পদ্মা নদীর ডান তীর সংরক্ষণ” প্রকল্পের সুলতানপুর অংশে ২হাজার ৭২০ মিটার এবং শিলাইদহ অংশে ১হাজার মিটার সংরক্ষন বাধ নির্মাণ কাজে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ডিজেল প্লান্ট লি: বা বিডিপিএল এর সাথে যোগসাজসে অবৈধ সুবিধা লাভের বিনিময়ে প্রকল্প কর্তৃপক্ষের ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির কারনে ওই বাধটি নির্মানকালেই ধ্বসে যায়। এতে সরকারের কোটি কোটি টাকা গচ্চা যায়। বিষয়টি মূল্যায়ন ও পরিবীক্ষন কমিটি (আইএমইডি)র প্রতিবেদনে সত্যতা উঠে আসায় তাৎক্ষনিক প্রকল্প পরিচালককে ভৎসর্না করার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বিডিপিএলকে ক্ষতি পূরণ বাবদ ২ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়। একই সাথে প্রতিষ্ঠানটিকে অযোগ্য বা কালো তালিকাভুক্ত করেন উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ। বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পের সাথে ৭ বছর পূর্বে ধ্বসে যাওয়া এবং অসম্পূর্ন প্রায় ১.৫৩ কিমি: দৈর্ঘের কাজও সংযুক্ত রয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দা আইনুল হক বলেন, ‘অনেক ক্ষয়ক্ষতির বিনিময়ে ও আন্দোলন সংগ্রামের মধ্যদিয়ে শুরু হওয়া এই বাঁধের কাজে কোন রকম অনিয়ম দুর্নীতি ও নি¤œমানে কাজ কোন ভাবেই আমরা মেনে নেবো না। এমনকি পানি উন্নয়ন বোর্ডের কোন গাফিলতি বা অবহেলায় এখনও পুরাপুরি বাধের কাজ শুরু না হওয়াকেও মেনে নেবোনা’।
ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান নাসির উদ্দিন মোল্লা এন্টারপ্রাইজের সাইট ম্যানেজার রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘নিয়ম বহির্ভুত প্রক্রিয়ায় বিচ্ছিন্ন ভাবে কাজ করার ফলে শিলাইদাহ বাধে দুই অংশের মাঝখানে ১হাজার ৫শ ৩০মিটার কাজ না হওয়ার কারনে পানির চাপে নির্মিত বাধ ধ্বসে গিয়ে ওই বাধটাই ক্ষতিগ্রস্ত ও চরম ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের চোখের সামনে এমন দৃষ্টান্ত থাকার পরও কিভাবে এই ধরনের বাধ নির্মানে এমন অযোগ্য কালো তালিকাভুক্ত বিডিপিএল এখানে কাজ করবে ? নিশ্চয় কোন অবৈধ সুবিধার আশায় পানি উন্নয়ন বোর্ড বাস্তবায়নাধীন এই বিশাল প্রকল্পে কাজ দেয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে ?
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ন্যাচারাল কন্সট্রাকশন এর স্বত্ত¡াধিকার এহসানুল হক বাবুর অভিযোগ, ‘ভাঙ্গন কবলিত নদী তীর রক্ষা বাধ নির্মান কাজের প্রধান পূর্বশর্ত হলো সমগ্র প্রকল্প আয়তনের পুরোটা জুরেই একযোগে কাজ শুরু করা। নচেৎ পানির তলদেশে এই কাজ বিচ্ছিন্ন ভাবে করলে সেই কাজের সামনে বা পিছনে, ডানে বা বামে পানির তলদেশে স্কাউরিং সৃষ্টি হলে চলমান কাজে ধ্বস বা ওয়াস আউট হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে পরে। এই ঘটনা ঘটলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান যেমন আর্থিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় একই সাথে সরকারের ব্যায়িত টাকাও গচ্চা যায়। বাস্তবায়নাধীন এই প্রকল্পে সেই পরিস্থিতির শংকার মধ্যেই কাজ করতে হচ্ছে আমাদের। এখানে তালবাড়িয়া অংশের প্রায় ৯ কি:মি: এর মধ্যে পৌনে ৪ কিমি:র কার্যাদেশ পেয়ে নির্মানকারী প্রতিষ্ঠানগুলি ভিন্ন ভিন্ন স্থানে ডাম্পিংএর কাজ শুরু করেছে। কিন্তু এই কাজ পানির স্রোতে যে কোন মুহুর্তে ডাম্পিংগুলি ওয়াস আউট হয়ে যেতে পারে। তখন এই ক্ষতির দায় কে নেবেন’ ?
অপর ঠিকাদার জিল্লুর রহমান বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন যাবত পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাজ করি। এক্সুয়ালি নদী বা পানির মধ্যে কাজ করা খুব কঠিন ও জটিল। সাধারনত: পানির মধ্যে কাজ করার ক্ষেত্রে প্রকল্পাধীন আয়তনের পুরোটাই নির্ধারিত এ্যালাইনমেন্ট ধরে একসঙ্গে কাজ করতে হয়। না হলে আগে পিছে খালি থাকলেই সমস্যা। যেকোন মুহুর্তে ওয়াস আউট হয়ে যায়। নির্মান শেষের আগেই এমন ঘটনা ঘটলে বিশাল আর্থিক ক্ষতি শিকার হতে হয়’। অথচ তালবাড়িয়া পদ্মা নদীর বাধ নির্মানের ক্ষেত্রে পানি উন্নয়ন বোর্ডের চরম অবহেলার লক্ষন দেখা যাচ্ছে। নদীর মধ্যে কাজের উপযুক্ত শুষ্ক মৌসুমের দেড় মাস সময় ইতোমধ্যে অতিবিাহিত হয়ে গেছে, অথচ এখনও বাকী সাড়ে ৫কিমি:র কাজ শুরু করতে পারেনি এবং কবে পারবে তারও কোন লক্ষন দেখছি না’।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড কুষ্টিয়ার নির্বাহী প্রকৌশলী মো: রাশিদুর রহমান জানান, ‘১হাজার ৪শ ৭২ কোটি টাকা প্রাক্কলন ব্যায়ে ২ বছর বাস্তবায়নককাল ধরে শুরু হওয়া পদ্মা নদীর ডান তীর রক্ষা বাধের কাজ ৩২টি প্যাকেজে দরপত্র আহবান করা হয়। ইতোমধ্যে ১৮টি প্যাকেজের কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে। অবশিষ্ট প্যাকেজগুলির কার্যাদেশ এখনও দেয়া হয়নি। এতে ৫.৩৫ কিমি: দৈর্ঘের ১৫টি প্যাকেজের কাজ এখনও শুরু করা যায়নি। কিছু জটিলতা সৃষ্টি হওয়ায় এমনটি হয়েছে। উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত ও আদেশ পেলেই উদ্ভুত জটিলতা কেটে যাবে। তবে এক্ষেত্রে অনৈতিক সুবিধা নিয়ে বিশেষ কোন অযোগ্য কালো তালিকাভুক্ত বা পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক দন্ডপ্রাপ্ত বিডিপিএলের মতো প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়ার চেষ্টায় এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে সেই অভিযোগ সঠিক না’।
উল্লেখ্য, রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের গ্রোয়েনে বাধা পেয়ে নতুন গতিপথের সন্ধানে প্রমত্ত পদ্মার ভয়াল আগ্রাসনে ভাঙ্গছে পাড় বিপন্ন জনপদ। ইতোমধ্যে সরকারী বেসরকারী জনগুরুত্বপূর্ন স্থাপনা ও অবকাঠামো বিলীন হয়েছে পদ্মার গর্ভে। পদ্মার ডানপাড়স্থ কুষ্টিয়া মিরপুর উপজেলার বহলবাড়িয়া ও তালবাড়িয়া দুই ইউনিয়নের ৯কি:মি এলাকায় প্রবল ভাঙ্গনে কৃষিজমি, বাড়িঘর, স্কুল মাদ্রাসা বিলিন হয়েছে ইতোমধ্যে। জাতীয় বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনের কয়েকটি টাওয়ার ভেঙ্গে পরেছে নদী গর্ভে। এছাড়া উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টিজেলার সাথে সংযুক্ত একমাত্র মহাসড়কটিও পাড়ে দাঁড়িয়ে চরম ঝুঁকিতে। এবছর নতুন করে আক্রান্ত হয়েছে দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প গঙ্গা কপোতাক্ষ ও ভেড়ামারা ৪১০ মেগা কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রসহ নানা অবকাঠামো। ‘পদ্মার ডান তীরে ভাঙ্গন কবলিত এলাকায় স্থায়ী বাধ নির্মানে ১ হাজার ৪শ ৭২ কোটি টাকা প্রাক্কলন ব্যয় ধরে অনুমোদন প্রাপ্ত উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শেষ হওয়ার নির্ধারিত সময়সীমা ২০২৬সালের ৩১মে’র মধ্যে।
এবি//দৈনিক দেশতথ্য //জানুয়ারী ৬,২০২৫//