ড.মো. হাফিজুর রহমান, গবেষক প্রাবন্ধিক:
বর্ষ বরণ অনুষ্ঠান কোনো জাতির জন্য নতুন কিছু নয়। পৃথিবীর অনেক দেশে অনেক জাতির মধ্যে এই বর্ষ বরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। তবে সকল দেশের নিজস্ব বর্ষ পঞ্জিকা নেই। কিন্তু আমাদের নিজস্ব পঞ্জিকা তথা ক্যালেন্ডার আছে। সেই বর্ষের সূচনা হয় পহেলা বৈশাখের দিনটিতে।
নতুন বছরের প্রথম দিন এবং বিদায়ী বছরের শেষদিনকে ঘিরে নানা ধরণের আয়োজন ছুঁয়ে যায় অনেক দেশের মানুষের মতো সকল বাঙালি তথা বাংলাদেশকে ঘিরে। নানান ধর্মের এ দেশটাকে ঘিরে পহেলা বৈশাখের আয়োজন সর্বস্তরের মানুসকে আলোড়িত করে নানানভাবে। বাঙালির ঘরে, সমাজে, আর্থনীতি সংস্কৃতিতে এরকম উৎসব দ্বিতীয়টি আর নেই। সার্বজনীননতার কারণে বলা হয়ে থাকে ধর্ম যার যার উৎসব সবার। বৈশাখের এই উৎসবকে সর্বজনীন উৎসব বলা হয় এই কারণে যে এই উৎসবে সকল ধর্মের মানুষ অংশগ্রহণ করে। বাঙালি জীবনের মৌলচেতনা হল অসাম্প্রদায়িকতার চর্চা ও বাস্তবায়ন দেখা যায় এ অনুষ্ঠানে। সেই চেতনা এখানে হাজার বছর ধরে প্রবহমান। বাঙালি সমাজের গড়নই হল এমন যে, এখানে সবাই যার যার মতো করে জীবন যাপন করতে পারে এবং নিজস্ব রীতিনীতি-কৃষ্টি-সংস্কৃতি ও ধর্মানুযায়ী আচার ও ধর্ম পালন করতে পারে। বাঙালির এটিই প্রধান আত্মপরিচয়।
বাংলা নববর্ষ অর্থাৎ নতুন বছরের প্রচলন করেন মোঘল বাদশাহ সম্রাট আকবর। বাংলাপিডিয়র তথ্য মোতাবেক, “কৃষিকাজের সুবিধার্থে মুগল সম্রাট আকবর ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ বা ১১ মার্চ বাংলা সন প্রবর্তন করেন এবং তা কার্যকর হয় তাঁর সিংহাসন আরোহণের সময় থেকে (৫ নভেম্বর ১৫৫৬)।” প্রধানত কৃষকদের খাজনা দেয়ার সুবিধার্থে এই সনের প্রবর্তন করেন তিনি। এ কারণে এই সনের আরেক নাম ‘ফসলি সন’। বর্তমানে কৃষি সমাজের চেয়ে ব্যবসায়ীরা এ সন অধিক কাজে লাগাচ্ছেন হালখাতা তথা সন উদযাপনের মাধ্যমে। যা প্রায়শ আমাদের দৃষ্টিগোচর হচ্ছে।
বর্তমানের বাংলাদেশ তথা পূর্ববঙ্গ এবং পশ্চিমবঙ্গ মিলে ছিল বঙ্গ বা ‘বেঙ্গল প্রেসিডেন্সী’। এখানে প্রধানত দুই ধর্মের মানুষের বসবাস। এর বাইরে আরও আছে বৌদ্ধ, খ্রিস্টান এবং নৃতাত্বিক ধর্মগোষ্ঠীর মানুষপৃথক ধর্ম বিশ্বাস। জাতিগতভাবে এরা বাঙালি হলেও ধর্মীয় দিক দিয়ে প্রত্যেকে স্বতন্ত্র ও বৈচিত্র্যপূর্ণ। এঁরা প্রত্যেকে প্রত্যেকের মতো করে ধর্ম পালন করে। এখানকার রীতি ও নীতি হল, রাষ্ট্র-সমাজ সকলের, ধর্ম যার যার। ফলে ধর্মীয় উৎসবগুলো যে যার মতো করে পালন করে থাকেন।বঙ্গ অঞ্চলে এসবের বাইরে রয়েছে লোকধর্মকেন্দ্রিক কিছু উৎসব। যেসব অঞ্চলে লোকধর্মের প্রভাব বেশি সেখানে এই ধর্মের বৈশিষ্ট্যগত কারণে রয়েছে সকল ধর্মাবলম্বীদের অংশগ্রহণ করার প্রবণতা। কিন্তু বাংলা নবাবর্ষের এ অনুষ্ঠান সার্বজনীন অনুষ্ঠান। এখানে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই সমানভাবে অংশগ্রহণ করতে পারেন।
বঙ্গাব্দ সনের শুরু হয় প্রধানত কৃষকের সুবিধার্থে। কৃষক ও কৃষি সংশ্লিষ্ট সকলেই নিজেদের জীবনের আর্থিক ৱেনদেন সুষ্ঠু রাখার চেষ্টা করেন এই সনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে। পরবর্তীতে এর সঙ্গে যুক্ত হয় বণিকের স্বার্থ, বিশেষ করে খুচরো ও মধ্য পর্যায়ের ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর হিসাবের খাতা সংরক্ষণ ও কার্যকর রাখা হতো এই সনের দিন তারিখ ও মাসের সঙ্গে মিলিয়ে। বাঙালি ব্যবসায়ীদের জীবনে হালখাতার প্রচলন শুরু হয় এই সনের বিদায়ী মাসের শেষের কয়েকদিন ও আগমনী বর্ষের শুরুর কয়েকটা দিনকে ঘিরে এবং এর মধ্যে মুখ্য হয়ে দেখা দেয় পহেলা বৈশাখের দিনটা, যা বৈশাখী উৎসব হিসেবেই সকলের কাছে পরিচিত ও বিশেষভাবে নন্দিত। হালখাতাকে ঘিরে এই যে আয়োজন ও উৎসব এটা প্রধানত ব্যক্তিকেন্দ্রিক হলেও এখন তা হয়ে উঠেছে একটি উৎসবে। মিষ্টি, লুচি, পিঠা নানা ধরণেন খাবারের পাশাপাশি নান ধরণের উপহার উপঢৌকন লেনদেন করা হয় এ উৎসব ঘিরে।
লক্ষনীয় বিষয় হল, পহেলা বৈশাখের আয়োজন এভাবে উৎসবের আমেজ ছড়াতে ছড়াতে এই অঞ্চলের মানুষের কাছে প্রধান উৎসবে পরিগণিত হয়ে ইঠছে। যে দিনটি ছিল কেবল কৃষক ও কৃষি সংশ্লিষ্ট মানুষের নানাবিধ হিসাব নিকাশের জন্য আজ সেই দিনটি বিশেষ বঢঞ্জনা সৃষ্টি করেছে অর্থের কারবার করা ব্যবসায়ী সমাজ ও তার সংশ্লিষ্ট সকলের মধ্যে। বিস্ময়কর হলেও সত্য যে, এটাই একমাত্র উৎসব যেখানে সমাজের সকল স্তরের মানুষের অংশগ্রহণের সুযোগ ঘটে। যা বাঙালি ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক।
পহেলা বৈশাখের উৎসবের সঙ্গে সকলেরই যোগ হওয়ার সুযোগ আছে। ধর্ম বা কোনো অনুশাসন এখানে বাধা হতে পারে না। কারণ এই উৎসবের অর্থনৈতিক গুরুত্ব তৈরি হয়েছে। যখনই কোন উৎসবের সঙ্গে অর্থনীতির নানা প্রান্তের যুক্ত হওয়ার সুযোগ তৈরি হয় তখনই সেই উৎসব সর্বজনীন হয়ে ওঠে, পহেলা বৈশাখের উৎসবের ক্ষেত্রে তেমনটাই ঘটেছে। এই উৎসবে কেউ ক্রেতা হয়ে আনন্দ উপভোগ করেন আবার কেউ বিক্রেতা হয়ে আনন্দ উদযাপনের অংশ হন।
ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষেরাও পহেলা বৈশাখের অনুষরঠানে অংশ গ্রহণ করেন। তারাও নিজেদের মতো করে উৎসবের রঙ ছড়ান। সেখানেও দেখা গেছে চমৎকার সব ভাবনার প্রকাশ ঘটেছে। বিদায়ী বর্ষের চৈত্রসংক্রান্তির দিন এবং নতুন বর্ষের প্রথম দিনকে ঘিরে পাবর্ত্য জেলাসমূহে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের ঐতিহ্যবাহী উৎসব বৈসাবি’ উদযাপিত হয়। এর নামকরণ হয়েছে বৈসুক, সাংগ্রাই ও বিজু এই শব্দগুলোর আদ্যক্ষর থেকে। উল্লেখ্য, এ উৎসবকে চাকমারা বিজু, মারমারা সাংগ্রাই, ত্রিপুরারা বৈসুক বলে অভিহিত করেন। পুরো পার্বত্য এলাকায় এর সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে বৈসাবি’ নামে।
পহেলা বৈশাখের সর্বজনীন রূপ নানানভাবে বিকশিত ও সমৃদ্ধ হয়েছে। এ দিনে দেখা যায়, রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করা হচ্ছে। প্রতিবছর মঙ্গল শোভাযাত্রার যে আয়োজন তাতে বাঙালির অসাম্প্রদায়িক মননচর্যার চিত্রই উপস্থাপন করা হয়। সেই বিশ্বাসে ধর্মীয়বোধের চেতনা হাজির যেমন থাকতে পারে, তেমনই থাকতে পারে লোকধর্মের অন্তরঙ্গ উপস্থিতিও। এ কারণে মঙ্গল শোভাযাত্রা মূলত বাঙ্গালির হাজার বছরের পথচলার সম্মিলিত সহাবস্থানের প্রতীকী উপস্থাপনা। যার মধ্যে আমরা অতীত ও বর্তমানের সেতুবন্ধ যেমন রচনা করি তেমনি আমাদের প্রত্যয়ের অনুষঙ্গগুলোকেও হাজির রাখি। বাঙ্গালি সত্তার চিরন্তন রূপের প্রকাশ ঘটে নববর্ষের প্রথম দিনে।
রমনার বটমূলে ১৩৭২ বঙ্গাব্দ থেকে পহেলা বৈশাখের উৎসবের আয়োজন করে আসছে ছায়ানট। গানে গানে তাদের যে আহবান, তা মূলত বাঙ্গালীর প্রার্থনা সঙ্গীত বিশেষ। এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ। এ গানের ভেতর দিয়ে বাঙালি প্রতি বঙ্গাব্দের প্রথম দিনে নতুন করে বাঁচতে শেখার আশাবাদ ব্যক্ত হয়ে থাকে। বাঙালির মন মনন এবং অধ্যাবসায়ের আদোপান্ত আজ বৈশাখ ধরণ করেছে।
বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে আমরা যেখানে আমাদের ঐতিহ্য ভুলতে বসেছি সেখানে এ বৈশাখ আমাদের ঐতিহ্যের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। শাড়ি, পাঞ্জাবি, ধূতি-লুঙ্গী যে বাঙালির ঐতিহ্য বিজড়িত পোশাক তা আবার একবার আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় পহেলা বৈশাখ। মাটির বাসনে পান্তা ভাত, হরেক রকম পিঠার সমাহার সবই ঘটিয়ে থাকে এই দিনটি। বাঙালির নিজস্ব এ বর্ষ গণনার পঞ্জী আমাদের স্বাতন্ত্রিকতার স্বাক্ষ্য বহন করে।
এবি//দৈনিক দেশতথ্য//১৩ এপ্রিল ২০২৪//
প্রিন্ট করুন
Discussion about this post