‘১৬ বছর জেলখানায় কষ্টে ছিলাম।জামিনে বাড়ি এসে আরেক কষ্ট’
এনামুল হক কুষ্টিয়া: ২০০৯ সালে আলোচিত পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দীর্ঘ ১৬ বছর কারাভোগের পর বাড়ি ফিরেছেন মজিবুর রহমান (৬৭)। গত ২৩ জানুয়ারি নিজ গ্রামে ফেরেন তিনি। দীর্ঘদিন কারাগারে থাকার পর মুক্ত হওয়ায় পরিবারের সবাই খুব খুশি হয়েছেন। তাকে এক পলক দেখার জন্য ছুটে আসছেন আত্মীয়স্বজন ও আশপাশের লোকজন।
মজিবুর রহমান কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলার ধরমপুর ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের উত্তর ভবানী গ্রামের বাসিন্দা। পরিবারে তার তিন মেয়ে ও স্ত্রী রয়েছেন। তিনি দৌলতপুর উপজেলার চিলমারী ইউনিয়নের আমদানি ঘাট গ্রামের মৃত রেহান উদ্দিন দেওয়ানের ছেলে। ১৯৮৭ সালে পদ্মা নদীর ভাঙনে তাদের বসতবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। তারপর দরিদ্র পরিবারের সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় বসবাস করেন। ২০০০ সাল থেকে মজিবুর রহমান শ্বশুর বাড়ি উত্তর ভবানী গ্রামে বসবাস করেন। তিনি ১৯৮৬ সালের মার্চে বিডিআরে সদস্য হিসেবে চাকরিতে যোগদান করেন।
২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পিলখানায় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদর দপ্তরে ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন নিহত হন। ওই ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরক
আইনে দুটি মামলা হয়। পিলখানা ট্র্যাজেডির ঘটনায় বিস্ফোরক আইনে করা মামলার আসামি তিনি ঘটনার দিন খাবার রান্নার কাজ করছিলেন। সেদিন সাড়ে ৩টায় বের হন পিলখানা থেকে। এরপর বিকেল ৪টার দিকে বেড়িবাঁধ থেকে তাকে আটক করে র্যাব। তারপর ঢাকা
কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়। ২৯ তারিখে কাশিমপুর কারাগারে পাঠানো হয়।
এরপর ২০১০ সালের আগস্টে খালাস পান। তারপর গ্রামের বাড়িতে আসেন এবং কক্সবাজারে চাকরি নেন। ২০১১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজারে হোটেলে
কর্মরত অবস্থায় পুলিশ ও বিজিবি তাকে আবার গ্রেপ্তার করে। এরপর থেকে তিনি কারাগারে বন্দি ছিলেন।
কাঁদতে কাঁদতে মজিবুর রহমান বলেন, আমি কোনো অপরাধ করিনি। তবুও এতটা বছর জেলে বন্দি ছিলাম। ১৬ বছর জেলখানায় কষ্টে ছিলাম, জামিনে বাড়ি এসে আরেক কষ্ট। টাকার অভাবে বাজার করতে পারি না, চিকিৎসা করাতে পারি না, চোখে দেখি না, আমার হাত-পায়ের অবস্থা খারাপ। অর্থের অভাবে আমি কোনো দিশা পাচ্ছি না।
বাজার করবো কি দিয়ে? কাপড়চোপড় কিনবো কি দিয়ে? সরকারের কাছে আকুল আবেদন, আমি যেন সাহায্য পাই। আমার ছেলে সন্তান নেই, তিনটা মেয়ে। তাদেরকে নিয়ে আমি যেন বাঁচতে পারি। সরকার যেন সাহায্য দেন, যাতে সংসার ও চিকিৎসাচালাতে পারি। আমাদের চাকরি ফিরিয়ে দেওয়া হোক। আমাদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হোক। বিস্ফোরক মামলা থেকে খালাস দেওয়া হোক। আমার ভিটেবাড়ি নেই, কি নিয়ে
বাঁচবো?
তিনি আরও বলেন, আমি যখন জেলে ছিলাম। তখন আমাকে কেউ দেখাশোনা করতে পারেনি, ১০টা টাকা দিতে পারেনি। টাকার অভাবে স্ত্রী ও মেয়েরা ভাড়া দিয়ে জেলখানায়’যেতে পারেনি আমাকে দেখতে। টেলিফোনে কথা হতো। পরিবারের টাকার অভাবে বাজার করতে পারেনি। অনাহারে-অর্ধাহারে তাদের দিন কেটেছে। আমার তিনটা মেয়ে রাস্তায় রাস্তায় কান্নাকাটি করে বেড়িয়েছে। ছেলে সন্তান থাকলেও তো রিকশা
চালিয়ে ইনকাম করতে পারতো। আল্লাহ ছেলে সন্তান দেয়নি। সংসার চালাবে না মামলা চালাবে? এভাবে অনেক কষ্টে ১৬ বছর কাটিয়েছে তারা। যাইহোক আল্লাহ মুখ তুলে তাকিয়েছেন।
মজিবুর রহমান আরও বলেন, আমি বিডিআরের সাধারণ সদস্য ছিলাম। আমার র্যাংক পাঁক। আমি নিরপরাধ, আমি কোনো অন্যায় করি নাই। তবুও ১৬ বছর ৫ মাস জেল খেটেছি। জেল থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য সরকার, সাংবাদিক ও আইনজীবীদের ধন্যবাদ। তাদের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ফলে আমরা জেল থেকে মুক্তি পেয়েছি। ছাত্র-জনতার প্রতি বিশেষ কৃতজ্ঞতা।
মজিবুর রহমানের ছোট মেয়ে রিমি খাতুন বলেন, আমার বয়স যখন তিন বছর তখন থেকে আমার বাবা জেলখানায় বন্দি ছিলেন। বাবাকে ছাড়া আমরা খুব কষ্ট করেছি। আমরা তিন বোন, কোনো ভাই নেই। বাবাই একমাত্র উপার্জনকারী ছিলেন। বাবার আদর
পায়নি, বাবাকে দেখতে পায়নি, বাবা বলে ডাকতে পারিনি। টাকার অভাবে আমরা তিন বোন পড়াশোনা করতে পারিনি। অসুস্থ হলে চিকিৎসা করাতে পারিনি। কোনো শখ ইচ্ছে পূরণ হয়নি। আমরা এতোটা বছর খেয়ে না খেয়ে পার করেছি। মহাবিপদের সময়
আমাদের পাশে কেউ ছিল না। আব্বুকে জেল থেকে মুক্তি দেওয়ায় আমরা খুশি।
কিন্তু আমার আব্বু কোনো কাজ করতে পারে না। আমাদের খুব অভাব, আমাদের খুব কষ্ট। সংসার চালানোর টাকা নেই। আমরা সরকারের কাছে সাহায্য চাই।
মজিবুর রহমানের স্ত্রী নূরুন নাহার বলেন, আমাদের জায়গা-জমি নাই। টাকার অভাবে ঠিকমতো খেতে পারিনি। তিনটা মেয়েকে পড়াতে পারিনি। খুব কষ্ট করেছি আমরা। কেউ সাহায্য করেনি। তিন মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি, জামাইরা সাহায্য করে।
এভাবে আমার সংসার চলে। আমার স্বামী জেল থেকে বাড়িতে এসেছেন। তিনি অসুস্থ, আমিও অসুস্থ, টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছি না। আমরা সরকারের কাছে সাহায্য চাই।
প্রতিবেশী ও স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, তাদের সংসার ভালোই চলছিল। কিন্তু জেলখানায় বন্দি হওয়ার পর থেকে তাদের সংসারে কষ্ট নেমে আসে। টাকার অভাবে
তারা খুব কষ্ট করেছেন। ঠিকমতো খেতে, চিকিৎসা করাতে, কিংবা মেয়েদের লেখাপড়া করাতে পারেননি। জেল থেকে মুক্তি পাওয়ায় আমরা খুশি। কিন্তু তিনি
অসুস্থ, কাজ করে উপার্জন করার অবস্থায় নাই। তাদের সংসার চালানোর ক্ষমতা নেই। তাদের কষ্ট দেখে আমাদেরও খুব কষ্ট লাগে। এরা গরীব অসহায় মানুষ। তাই সরকারের পক্ষ থেকে তাদের সাহায্য করা হোক।
মজিবুর রহমানের বড় মেয়ে রত্না বলেন, আমার বাবা নির্দোষ নিরপরাধ মানুষ।
তবুও প্রায় ১৭ বছর জেলে বন্দি ছিলেন। এই ১৭ বছর আমরা খুব কষ্ট করেছি। আমার বাবাই একমাত্র উপার্জনকারী ছিলেন। তিনি জেলে যাওয়ার পর থেকে আমরা অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাঠিয়েছি। পড়াশোনা করতে পারিনি। আত্মীয়-স্বজনরা ছোটবেলায় আমাদের বিয়ে দিয়ে দেন। আমার স্বামী ও বোনের স্বামীর সহযোগিতায় আমাদের সংসার চলে কোনোমতে। আব্বু জেল থেকে বাড়িতে এসেছেন। টাকার অভাবে সংসার চলছে না, চিকিৎসা করাতে পারি না। আমার মা-বাবা দুজনেই অসুস্থ। আমরা সরকারের কাছে সাহায্য চাই।
এবি//দৈনিক দেশতথ্য //জানুয়ারী ২৯,২০২৫//
![প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন](http://dailydeshtottoh.com/wp-content/plugins/wp-print/images/printer_famfamfam.gif)
Discussion about this post