শেখ জাহাঙ্গীর আলম শাহীন, লালমনিরহাট থেকে:
প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রে এমডি মিজানের জড়িত এমন খবরের পর বেড়িয়ে আসতে শুরু করেছে অন্য সদস্যদের নাম। মহিষখোচায় এই চক্রের সকলের নাম সাধারণ মানুষের মুখে মুখে। গ্রেফতার এড়াতে অনেকে গা ঢাকা দিয়েছে।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, মহিষখোচায় প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের মূলহোত দুই মিজান। এক মিজানের পরিচয় সনাক্ত হয়েছে। অন্য মিজান ধরাছোঁয়ার বাহিরে রয়েছে। মহিষখোচার একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তিনজন সরাসরি এই প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের সাথে জড়িত। সেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একজন সহকারি শিক্ষক প্রশ্নফাঁস করে স্ত্রীকে বিসিএস কর্মকর্তা বানিয়েছে। সেই হঠাৎ করে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছে। রংপুরে মিজান ২৫ শতাংশ জমি কিনেছে। এই চক্রের নাম সকলের মুখেমুখে। গ্রেফতার এড়াতে অনেকে ইতোমধ্যে গা ঢাকা দিয়েছে।
প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের হোতা এমডি মিজান গ্রামে দানবীর হিসেবে পরিচিত। অভিযুক্ত মিজানুরের সম্পদের পরিমাণ সম্পর্কে এখনো সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি। তার রয়েছে অঢেল সম্পদ। আরও যাদের নাম শুনা যায় তারা হলেন, মিজান (টু), শেফাউল, রেল জাকির, কাহার, বাদশা, রাজ সহ অনেকে। যাদের নাম সাধারণ মানুষের মুখে মুখে। এরা সকলে কোটি কোটি টাকার সম্পদের মালিক। এসব সম্পদ মাত্র ১০-১২ বছরে গড়ে তুলেছে। তাদের দৃশ্যমান কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নেই। কেউ শিক্ষক, কেউ সাবেক এপিএস, কেউ কৃষক ঘরে সন্তান। সকলে ভবঘুরে। তবে তারা বিলাসি লাইফলীড করে থাকে। চলাফেরা করেন দামি গাড়িতে।
এমডি মিজানকে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসে জড়িত থাকার অভিযোগে লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলা আওয়ামী লীগের কমিটি সহসভাপতি পদ হতে অব্যহতি দেয়া হয়েছে। এমডি মিজান ছিলেন সাবেক সমাজকল্যাণ মন্ত্রী নুরুজ্জামান আহম্মেদের খুব কাছের মানুষ। আরেক মিজান ছিলেন তার সাবেক এপিএস। দুই মিজান কে এলাকার সাধারণ মানুষ দানবীর হিসেবে চেনেন। এমডি মিজানুরের বাড়ি লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা ইউনিয়নের কুটির-পাড়া গ্রামে। তিনি সপরিবারে ঢাকায় (ধানমন্ডিতে) বসবাস করেন । বছরে ৫-৭ বার গ্রামে বাড়িতে আসেন। এবার গ্রামে দীর্ঘ সময় ছিলেন। এমপি ও উপজেলা ইলেকশনে সময় দিয়েছেন। গ্রামে এলে গরু জবাই করে গ্রামবাসীকে খাওয়ান। মানুষকে আর্থিক-সহযোগিতা করেন। গ্রামের মসজিদ ও মাদ্রাসায় বড় অংকের অনুদান দিয়েছেন। দাতা হিসাবে মসজিদের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে মার্বেল পাথরে নিজের নাম বাঁধিয়ে রেখেছেন। এভাবে তিনি দানবীর। মিজানুরের সম্পদের পরিমাণ সম্পর্কে এখনো সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি। গ্রামে স্থাবর কোনো সম্পত্তি না থাকলেও একটি ডুপ্লেক্স বাড়ি নির্মাণ করছেন। তবে দিনাজপুর শহরে শশুরবাড়িতে ও ঢাকায় একাধিক বহুতল ভবন ও মার্কেটের মালিক তিনি। বিপুল পরিমাণ সম্পদ গড়েছেন স্ত্রী লাকী বেগম ও তিন সন্তানের নামে। মিজানের বাবা মৃত আবু বক্কর সিদ্দিক ছিলেন পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই)। তার ছোট ভাই মশিউর রহমান পুলিশের এসআই।
প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের সদস্য বিজি প্রেসের এটিএম গোলাম মোস্তাফা বাড়ি এই মহিষখোচার কুটিবাড়িতে। এমডি মিজানের প্রতিবেশী সে। বিজি প্রেসের কর্মচারী এটিএম গোলাম মোস্তাফার প্রাইভেট গাড়ি চালকের কাজ নেয়। সেই হতে মিজানুর ঢাকায় থাকতে শুরু করেন। বিজি প্রেসের চাকরির প্রশ্নপত্র ফাঁসের একটি চক্র পরিচালনা করতেন এটিএম গোলাম মোস্তাফা। রংপুরে এটিএম মোস্তফা র্যাবের হাতে আটক হয়। সেই প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় ২০১৩ সালে বিজি প্রেস থেকে চাকরিচ্যু হয় এটিএম মোস্তফা ও তার স্ত্রী। তারপরেও পিএসসির প্রশ্নফাঁসের সিন্ডিকেটের অপকর্ম থেমে থাকেনি। এটিএম গোলাম মোস্তফার গাড়ি চালক হিসেবে এমডি মিজানুরের মাধ্যমে চক্রটি সারা দেশে নেটওর্য়াক গড়ে তুলেন। ১০ বছর আগে এক মন্ত্রী, মন্ত্রীপুত্র ও এপিএসের সংর্স্পশে এসে যায়। এমডি মিজান হয়ে যায় ক্ষমতা ধর। সাবেক মন্ত্রী ও মন্ত্রী পুত্রের ছত্রছায়ায় দুই মিজান মিলে গড়ে তুলে আন্ডারওয়ার্ল্ড। দুই মিজান ২০২৩ সালে স্থানীয় আদিতমারীর রাজনীতিতে সাবেক মন্ত্রীর আর্শীবাদে যায়গা করে নেয়। কোনদিন আওয়ামীলীগের রাজনীতি না করেও এমডি মিজান হয়ে যায় আদিতমারী উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। এক মিজান হয়ে যায় যুগ্ন সাধারণ সম্পাদক। প্রশ্নপত্র ফাঁসে তার নাম আসলে গত রোববার হতে এমডি মিজানুর আত্মগোপনে চলে যায়। মিজানুরের ছোট ভাই এসআই মশিউর শনিবার দুপুর পর্যন্ত গ্রামের বাড়িতে ছিলেন। মিজানুরের কেলেঙ্কারি সামনে আসার পর বিকেলে বাড়ি ছেড়েছেন। মিজান ও মিজানের স্ত্রী ফোন বন্ধ ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের এক কর্মকর্তা ও গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, সিআইডি সহ একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা এমডি মিজানুর সহ পুরো চক্রটির বিরুদ্ধে তদন্ত করছে। তবে আদিতমারী থানার ওসির মাহমুদ উন নবীর বলেছেন, এ ব্যাপারে তার কাছে কোনো তথ্য নেই। এমডি মিজানুর যেমন প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় আলোচনায় আসেন। তেমনি ২০২১ সালে সাবেক এপিএস মিজান আলোচনায় আসে তার স্ত্রীর প্রাইভেট কার হতে বিপুল পরিমান ফেন্সিডিল পুলিশ উদ্ধার করার পর। সেই সময় সমাজকল্যাণ মন্ত্রী নুরুজ্জামান আহম্মেদ এপিএস থাকায় বিষয়টি খুব সহজে ধামাপাচা দিতে পারেন। তবে গাড়ির চালকের নামে মাদক মামলা বিচারাধীন রয়েছে। লালমনিরহাটের এক মিডিয়া কর্মী এপিএসের স্ত্রীর মাদক ব্যবসার জড়িত খবর প্রকাশ করলে তার উপর নেমে আসে ষড়যন্ত্রের খড়গ। চাকরি হারাতে হয়। এপিএস মিজানের বাবাকে সকলে কাঠ নজরুল বলে চিনেন। আর্থিক অবস্থা তেমন ছিলনা। পুত্র মন্ত্রীর এপিএস হওয়ার পর ভাগ্যের পরিবর্তন হয়েছে। পেয়ে গিয়েছে আলোউদ্দিনের চেরাগবাতি। তার এক পুত্রের মিলেছে পিওন পোষ্টে সরকারি চাকুরি। সে সরকারি চাকুরির পাশাপাশি ঠিকাদার হিসেবে সকলে চিনে। তিস্তা নদীর অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে বিক্রি করে ১৫ বছরে শতকোটি টাকার মালিক হয়ে গেছে। সাবেক সমাজকল্যাণ মন্ত্রীর এপিএস ছিল কাঠ নজরুলের পুত্র মিজান। এ সুবাদে চালিয়ে যায় একের পর এক অপরাধ। মহিষখোচায় পানি উন্নয়নবোর্ডের ১৮টি গ্রুপের ৪৪ কোটি টাকার কাজ সাব কনট্রাক্ট বাগিয়ে নেয়। কাজ করেছে অত্যন্ত নিম্নমানের। সামান্য বৃষ্টিতে ধ্বসে পড়েছে পানি উন্নয়ন বাঁধের কাজ। এদিকে সাবেক সমাজ কল্যাণ মন্ত্রীর এপিএস মিজান সহ সমাজসেবা মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের নামে দুদকে একটি অভিযোগ দায়ের হয়। সমাজসেবা মন্ত্রণালয়ের কর্মচারিদের পক্ষে মনি কিশোর নামে এক কর্মচারি দুদকে অভিযোগ করে ছিলেন। এই অভিযোগটি তদন্তের নির্দেশ পর্যন্ত হয়। যার স্বারক নং -০০.০১.০০০০.৫০৩.২৬.০৬৪.২২( ২য় অংশ) -১১৬০৮ তারিখ – ২২.০৩.২২। কিন্তু তদন্তের রহস্যজনক ভাবে কোন দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই।
দৈনিক দেশতথ্য//এইচ//