শেখ সুদীপ্ত শাহীন, লালমনিরহাট: গ্রাম-বাংলার ঐতিহাসিক খেলা চক্কর চাইল। এখনো উত্তরাঞ্চলের লালমনিরহাট জেলার প্রতিটি গ্রামে প্রচলিত রয়েছে। পথে ঘাটে, গাছের ছায়া, বাঁশঝাড়ের ছায়ায়, ঘরের বারান্দায়, উঠনে গুটিসুটি বেধে এখনো খেলতে দেখা যায়। হাজারও আধুনিক খেলার ভিড়ে, তথ্য প্রযুক্তি ও ডিজিটাল র্ভাচুয়াল জগতের রঙ্গিণ নানা খেলার ভিড়ে হারিয়ে যায়নি। উত্তরাঞ্চলের প্রায় প্রতিটি গ্রামে হাজার বছর ধরে সমান জনপ্রিয়তা নিয়ে খেলতে দেখা যায় চক্কর চাইল। এই খেলার কৌশল একই রকম হলেও খেলায় গুটির সংখ্যা ভেদে ও খেলার ঘরের মাটিতে দাগ অংকনের রকম প্রকার ভেদে নানা রকম নামের আছে বৈচিত্রতা। কখনো চক্কর চাইল, কখনো ৬ গুটি, কখনো ১৬ গুটি, ৩২ গুটি, ৩৮ গুটি। এমন নানা নামে রয়েছে। কেউ কেউ আবার পাইত চাইল বলে।
ধৈর্য ও বুদ্ধির খেলা চক্কর চাইল। এই খেলায় উপকরন বলতে, মাটিতে দাগ দিয়ে ঘর করা হয়। দুই জনে খেলে। দুই পক্ষের খেলোয়ার ৩৮টি করে গুটি নিতে হবে। গুটি বলতে পথের ছোট ছোট ইটের টুকরো। দুই পক্ষ দুই রংগের গুটি নিবেন। গুটি পাওয়া না গেলে পথের ধারে অবহেলায় গজিয়ে উঠা লালা ও সবুজ কচুর ডগা অথবা সটি গাছের লাল সবুজ ডগা কেটে ছোট ছোট টুকরো করে গুটি বানিয়ে নেয়া হয়। খেলায় দুইজন খেলে কিন্তু খেলাটিকে উপভোগ্য করে তুলতে ঘিরে বসে ধরে দর্শক। তারাও মনের অজান্তে দুই দলে বিভক্ত হয়ে দুই দলের খেলোয়ার কে বুদ্ধি দিয়ে গুটি চালতে পরামর্শ দিয়ে থাকে। এভাবে গুটি চালিয়ে পাইতে ফেলে এক পক্ষ অন্য পক্ষকে । যার সবগুটি আগে খোয়া যাবে তিনি বিজিতা। যিনি ঘরে তার গুটিকে পাইতের হাত থেকে সুরক্ষা করতে পারেন তিনি বিজয়ী।
এই চক্কর চাইল খেলায় নির্দিষ্ট কোন সময় নিধারণ নেই। দুই পক্ষের মধ্যে খেলা শুরু হলে দুউ পক্ষে গুটি চালাচালি করে পাইতে ফেলতে নানা কৌশল খাটায়। কখনো প্রতিপক্ষ সমান সমান পারদর্শী হলে এই খেলা এক গেম শেষ হতে সারাদিনও লেগে যায়। তবে সাধারণত ২/৩ ঘন্টা সময় লাগে। চৈত্রমাসের ভরদুপুরে গ্রামের মানুষের হাতে কোন কাজ থাকে না। সেই সময় বৃদ্ধ – যুবা, কিশোর মিলে গাছের ছায়ায়, টংঘরের মাচাংয়ে, হাট বাজারের চায়ের দোকানের পাশে এই চক্কর চাইল খেলা খেলতে দেখা যায়। আগে এক সময় এই চক্কর চাইল খেলা নিয়ে গ্রামে গ্রামে ছিল মাতামাতি। যারা চক্কর চাইল খেলায় ধৈর্য ও বুদ্ধি রাখতেন তাদের ছিল খুব কদর। গ্রাম ছাড়িয়ে তাদের এই খেলার পারদর্শীরার খবর দুই চার দশ গ্রামেও ছড়িয়ে পড়ত। চক্কর চাইল খেলার পারদর্শীদের গ্রামের মানুষ ধৈর্ষশীল ও বুদ্ধিমান হিসেবে বিবেচনা করতেন। বুদ্ধিদীপ্ত কোন ধৈর্যশীল কাজে তাদের ডাক পড়ত। বিশেষ করে গ্রাম্য বিচারশালীর ও পারিবারিক কোন বচসা হলে তারা মিটিয়ে দিতেন। তাদের গ্রাম্য সমাজে বিশেষ কদর ছিল। এখনো চক্কর চাইল খেলার কদর কমেনি। গ্রামে ও শহরে কাজের অবসরে শ্রমজীবি মানুষ রাস্তার ধারের উপকরণ ব্যবহার করে চক্কর চাইল খেলতে দেখা যায়। এই খেলায় জয় পরাজয় নিধারণ হয় বুদ্ধির জোরে। কে কাকে কিভাবে হারাবে। এক একটি গুটি চাইল দিতে কোন কোন সময় প্লেয়ার ৫-১০ মিনিট পর্যন্ত সময় নেয়। দুই পক্ষের খেলোয়ার ঝিম ধরে চুপ করে থাকে। মনে হবে যেন, মহা পরিকল্পনার কাজ করছে। অথবা মহাকোন সংকটে পড়েছে। এই সংকট উত্তরণের কোন পথ খুঁজে পাচ্ছে না। মহা পন্ডিত হয়ে সেই সংকট উত্তরণের পথ খুঁজছে। নাওয়া, খাওয়া ভুলে চক্কর চাইল খেলছে। কোন কোন গ্রামে চক্কর চাইল খেলোয়ার প্লেয়ারকে অলস বা রংপুরের আঞ্চলিক ভাষায় বলা হয় কুড়িয়া।
পূর্ব কদমা গ্রামের জাওরানী বাজারে প্রায় প্রতিদিন বৈকালে কিছু মানুষ এখনো নিয়মিত চক্কর চাইল খেলতে দেখা যায়। এই সব মানুষের বেশীরভাগই মধ্য বয়সী। তাদের একজন কৃষ্ণ কমল রায় (৬২)। তিনি বলেন এই খেলাটা আমাদের বাপ – দাদারা খেলেছে। খেলতে বসার আগে চিড়ামুড়ি, চাউল ভাঁজা, পান সুপারি বগলদাবা করি নিয়েছে। চক্কর চাইল খেলছে ও খাচ্ছে। দুই পক্ষের খেলার চাইল দেওয়া দেখতে চারিপাশে নানা বয়সের মানুষ দাঁড়িয়ে, বসে, ঘিরে ধরে দেখত। খেলাটির প্রতিটি পরতে পরতে উত্তেজনা। খেলায় বুদ্ধির কৌশলে হারজিত নিধারণ হয়। আগে যখন চৈত্র- বৈশাখ মাসে ধান চাষাবাদ সম্পূর্ণ প্রকৃতির ওপর সেচ নির্ভর ছিল। তখন চৈত্র- বৈশাখ মাসে গ্রামের মানুষের হাতে কোন কাজ ছিলনা। অলস সময় কাটাত। তখন উত্তরাঞ্চলের জেলার প্রতিটি গ্রামে নানা রকমের খেলাধুলার ধুম পড়ে যেত। এখন দেশী খেলাধুলা প্রায় বিলুপ্তির পথে। তাপর পরেও কিছু খেলা হাজার বছর ধরে সমান জনপ্রিয়। এসব খেলার মধ্যে একটি চক্কর চাইল খেলা। কিছুটা দাবা খেলার মত ধৈর্যের খেলা।
বীরমুক্তিযোদ্ধা রেলওয়ে অবসর প্রাপ্ত কর্মকর্তা মোঃ আব্দুস ছালাম জানান, চক্কর চাইল খেলাটা সম্পূর্ণ বুদ্ধির খেলা। উত্তরাঞ্চলের সাধারণ মানুষের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় ও সমৃদ্ধ খেলা। সকল বয়সের নারী পুরুষ এই খেলাটা খেলতে পারে। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় অবসর সময়ে ট্রেনিং ক্যাম্পে, ব্যারাকে, এমন কী কোন অপারেশনে যাওয়ার পথে খাবার রান্নার বিরতির সময় যারা অলস বসে অপেক্ষায় ছিলাম, তারাও এক সতীর্থের অন্য সতীর্থের সাথে চক্কর চাইল খেলে সময় কাটিয়েছি। মুক্তিযুদ্ধের সময় কখনো কখনো এ্যাম্বুশ করতে ছদ্মবেশ ধারণ করতে হয়ে ছিল। সেই সময় কোন বাঁশঝাড়ে বা রাস্তার পাশে এমন ভাবে চক্কর চাইল খেলছি। নতুন কেউ এসে ভাবত। এরা এই পাড়ার ছেলে । তার মানে সেখানে আমরা চক্কর চাইল খেলার আড়ালে এ্যাম্বুশ করেছি। তিনি বলেন বাংলার এই ঐতিহাসিক খেলা কে উত্তরঞ্চলের মানুষ হারিয়ে যেতে দেয়নি। তাই তো গ্রামেগঞ্জে পথে ঘাটে খেলা সমান জনপ্রিয়তায় এখনো রয়েছে। এই সব খেলা যদি প্রাথমিক শিক্ষায় অন্তরভুক্ত করা যেত শিশুরা গণনা ও ধৈর্যশীল হওয়া শিখত। সেই সাথে গ্রামীণ এই গণনা শিক্ষার ঐতিহ্যবাহী ও ঐতিহাসিক খেলাটি সম্পর্কে জানতে পারত।
দৈনিক দেশতথ্য//এসএইচ//

Discussion about this post