প্রতিনিধি, কুষ্টিয়া:
১১ হাজার ভোল্টের বিদ্যুতের লাইনে কাজ করার সময় বিদ্যুৎ স্পৃষ্ট হয়ে গুরুতর আহত হন সাঈদ আহমেদ (২৫)। পরে তার দুটি হাত কেটে ফেলতে হয়। পা ও শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ক্ষত হয়েছে। সে দুর্ঘটনায় বেঁচে ফিরলেও জীবনযুদ্ধে তিনি প্রায় পরাজিত।
দুই হাত হারিয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। স্বপ্নভঙ্গ হয়েও নতুন করে স্বপ্ন বুনছেন তিনি। সব বাধা ডিঙিয়ে এগিয়ে যেতে চান। কৃত্রিম হাত ও কর্মসংস্থানের জন্য সহযোগিতা চেয়েছেন সাঈদ, তার পরিবার ও স্থানীয়রা।
সাঈদ আহমেদ কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার বহলবাড়ীয়া ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সাহেবনগর গ্রামের দক্ষিণপাড়ার মিলন মালিথার ছেলে। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে সে সবার বড়।
২০২৩ সালের ২৭ অক্টোবর বেলা ১১টা ৪৫ মিনিটের দিকে কক্সবাজারের কুতুবদিয়ায় এ দুর্ঘটনা ঘটে।
বিদ্যুৎ বিভাগের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আইরা কনসট্রাকশনে লাইনম্যান হিসেবে চাকরি করতেন। ১১ হাজার ভোল্টের বিদ্যুতের লাইন বন্ধ অবস্থায় কাজ করছিলেন সাঈদ। এসময় হঠাৎ বিদ্যুৎ সঞ্চালন চালু হয়। এতে বিদ্যুৎ স্পৃষ্ট হয়ে বিদ্যুতের খুঁটি থেকে নিচে পড়ে যায়। প্রাণে বাঁচলে তার দুই হাত কেটে ফেলতে হয়েছে।
সাঈদ আহমেদ বলেন, ২০২৩ সালের ১৭ অক্টোবর প্রতিদিনের মতো বিদ্যুতের খুঁটিতে উঠে লাইনের কাজ করছিলাম৷ আমরা অফিসের নির্ধারিত সময়ে নির্ধারিত জায়গায় কাজ করতাম। লাইনের কাজ শুরুর আগে থেকে কাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত সময় বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ রাখা হয়। সেদিনও কাজ শুরুর আগে বিদ্যুতের সংযোগ বন্ধ ছিল। কিন্তু কাজ শেষ হওয়ার আগেই ফোরম্যান সাহাবুল বিদ্যুৎ লাইন চালু করে দেন। সে আমাদের সাথে কথা না বলেই বিদ্যুৎ চালু করে। তার জন্যই আমি বিদ্যুৎ স্পৃষ্ট হয়ে বিদ্যুতের খুঁটির উপর থেকে নিচে পড়ে যায়। এতে গুরুতর আহত হয়েছিলাম। তখন আমি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। জ্ঞান ফিরলে দেখি যে, আমি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
এসব গল্প বলতে গিয়ে বারবার কেঁদে ফেলেন সাঈদ। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি আরও বলেন, ফোরম্যান সাহাবুলের কারণে বিদ্যুৎ স্পৃষ্ট হয়ে গুরুতর আহত হয় আমি। পরে আমাকে সেখান থেকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে যায়। পরে চিটাগাং হাসপাতালের বার্ণ ইউনিটে ভর্তি করা হয়। সেখানে ১১ দিন ছিলাম। অবস্থা খারাপ হওয়ায় সেখানকার দায়িত্বরত চিকিৎসকরা উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকার বার্ন ইউনিটে রেফার্ড করেন। সেখানে যেয়ে আনুমানিক দেড় মাস চিকিৎসা নিই। সেখানে চিকিৎসারত অবস্থায় আমার দুই হাত কেটে ফেলতে হয়। ঘটনার ১৪ দিন পর ডান হাত আর ২০ দিন পর বাম হাত কেটে ফেলতে হয়। দেড় মাস পরে সেখান থেকে বাসায় চলে আসি। এরপরে টাকার অভাবে আর চিকিৎসা করাতে পারিনি।
তিনি আরও বলেন, আমার বাড়ির পার্শ্ববর্তী বহলবাড়িয়া এলাকার শাহাবুল (৪৫) কুতুবদিয়া এলাকায় বিদ্যুতের কাজের সাব-কন্টাকটার ও আইরা কনসট্রাকশনে ফাইনম্যান হিসেবে কাজ করতো৷ ২০২৩ সালের জুন মাসে ছুটিতে গ্রামের বাড়ি এসে আমাকে কাজ করার জন্য বলেন। তাদের সঙ্গে বেতন, ভাতা এবং ঝুঁকি ভাতার চুক্তি করে আইরা কোম্পানিতে জুলাই মাসে কুতুবদিয়ায় বিদ্যুতের কাজ শুরু করি। সেখানে তিন মাস কাজ করার পরে এ ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনার জন্য শাহাবুল দায়ী। সে আমাদের অনুমতি না নিয়েই হঠাৎ বিদ্যুৎ লাইন চালু করেছিল। চুক্তি অনুযায়ী আমাকে কোন সহযোগিতা করেনা। পরবর্তীতে আমি আইরা কোম্পানির সিনিয়রদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। কেউ সহযোগিতা করেনি। তাদের সাথে যোগাযোগ করায় শাহাবুল আমাকে হুমকি ধামকি প্রদান করে। এজন্য থানায় অভিযোগ দিয়েছিলাম। দুই হাত হারিয়ে আমি পঙ্গু, মানবেতর জীবন যাপন করছি। কেটে ফেলা হাতের দিকে তাকালেই কান্না হয়। আমরা গরীব মানুষ। ঠিকমতো চিকিৎসা হতে পারিনি৷ আমার সব স্বপ্ন ভেঙে গেছে। এভাবে জীবনযাপন করতে খুব কষ্ট হয়। একা একা খেতে পারি না। কোনো কাজ করতে পারি না। সব বাধা ডিঙিয়ে আমি এগিয়ে যেতে চায়। কৃত্রিম হাত ও কর্মসংস্থানের জন্য সহযোগিতা চাই।
সাঈদের দেখভাল করেন তার দাদা-দাদী। দাদী চায়না খাতুন ও দাদা সিরাজ মালিথা বলেন, বিদ্যুতের লাইনে কাজ করতে গিয়ে বিদ্যুৎ স্পৃষ্ট হয়ে গুরুতর আহত হয়। পরে সাঈদের দুই হাত কেটে ফেলা হয়েছে। সে কোনো কাজ করতে পারে না। একা একা খেতে পারে না। গোসল করতে পারে না। আমরা ছোট বাচ্চার মতো তাকে লালনপালন করি। সে পঙ্গু হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। আমরা খুব গরীব মানুষ। অর্থের অভাবে তার চিকিৎসা করাতে পারি না। অভাবের তাড়নায় ভাতই বন্ধ হয়ে আছে। খুব কষ্টের মধ্যে আছি। সবার কাছে সাহায্য চাচ্ছি। তার কর্মসংস্থান ও কৃত্রিম হাতের ব্যবস্থা করে দেন।
হালিম, নাজমা সহ বেশ কয়েকজন প্রতিবেশী বলেন, কাজ করতে গিয়ে কারেন্টে ধরেছিল। তার হাত দুইটা কেটে ফেলা হয়েছে। পায়েও সমস্যা। টাকা পয়সার অভাবে চিকিৎসা হতে পারে না। তারা গরীব মানুষ। তাদের অনেক কষ্ট। সাঈদকে সবাই সহযোগিতা করেন।
ফোরম্যান সাহাবুল ইসলামের সাথে কথা বলার জন্য মুঠোফোনে একাধিকবার কল করলেও তিনি রিসিভ করেন নি।
এবিষয়ে মিরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোমিনুল ইসলাম বলেন, সাঈদ অভিযোগ দিয়েছে। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এবিষয়ে মিরপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) বিবি করিমুন্নেছা বলেন, সে যেই প্রতিষ্ঠানে কাজ করতো। সেই প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ করতে হবে। তারা তাকে সহযোগিতা ও ক্ষতিপূরণ দিতে পারে। আমরা তার প্রতিবন্ধী ভাতার ব্যবস্থা করে দিতে পারবো।