Print Date & Time : 14 March 2025 Friday 6:24 pm

বিশ্ব শিক্ষক দিবসে আমাদের প্রত্যাশা: মোঃ ওবাইদুর রহমান 

আজ ৫ অক্টোবর ২০২৪ – বিশ্ব শিক্ষক দিবস। বিশ্ব শিক্ষক দিবস হল একটি আন্তর্জাতিক দিবস যা শিক্ষকদের কাজ উদযাপনের জন্য প্রতি বছর ৫ অক্টোবর পালিত হয়।

১৯৯৪ সালে প্রতিষ্ঠিত, এটি আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (ILO) এবং জাতিসংঘের শিক্ষাগত, বৈজ্ঞানিক ও সাংস্কৃতিক সংস্থা (UNESCO)-এর সুপারিশে স্বাক্ষরের স্মরণ করে। ১৯৬৬ সালে ‘শিক্ষকদের অবস্থা সম্পর্কিত ILO/UNESCO সুপারিশ’ একটি মান-সেটিং যন্ত্র যা সারা বিশ্বে শিক্ষকদের অবস্থা এবং পরিস্থিতি মোকাবেলা করে। এই সুপারিশটি শিক্ষা কর্মীদের নীতি, নিয়োগ, এবং প্রাথমিক প্রশিক্ষণের পাশাপাশি শিক্ষকদের অব্যাহত শিক্ষা, তাদের কর্মসংস্থান এবং কাজের অবস্থার সাথে সম্পর্কিত মানগুলির রূপরেখা দেয়। 

বিশ্ব শিক্ষক দিবসের লক্ষ্য ‘বিশ্বের শিক্ষাবিদদের প্রশংসা করা, মূল্যায়ন করা এবং উন্নতি করা’ এবং শিক্ষক ও শিক্ষার সাথে সম্পর্কিত বিষয়গুলি বিবেচনা করার সুযোগ প্রদান করা। এ বছর বিশ্ব শিক্ষক দিবসের থিম হলো – শিক্ষকদের কণ্ঠের মূল্যায়ন: শিক্ষার জন্য একটি নতুন সামাজিক চুক্তির দিকে। থিমটি শিক্ষা নীতিতে শিক্ষকদের দৃষ্টিভঙ্গি একীভূত করার এবং তাদের পেশাদারদের জন্য একটি সহায়ক পরিবেশ তৈরি করার গুরুত্ব তুলে ধরে।

শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ অংশীজন হলো শিক্ষার্থী ও শিক্ষক। বর্তমানে তীব্র প্রতিযোগিতার যুগ। মানসম্মত শিক্ষা ছাড়া একবিংশ শতাব্দীতে টিকে থাকা কঠিন। শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করতে শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। ইউনেস্কোর মতে, কোনো দেশের বাজেটের ২০ শতাংশ বা জিডিপির ৬ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ করা উচিত। বিপরীতে আমাদের দেশের শিক্ষা খাতে বরাদ্দ জিডিপির ২ শতাংশেরও নিচে। 

আমাদের সাক্ষরতার হার বেড়েছে। ১৯৭১ সালে সাক্ষরতার হার ছিল ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ। সর্বশেষ জরিপ মতে, বর্তমানে দেশে সাক্ষরতার হার প্রায় ৭৩ শতাংশ। । এ তথ্য থেকে আমরা জানতে পারি শিক্ষায় মানুষের অন্তর্ভুক্তি উল্লেখযোগ্যভাবে হয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোর অনেক উন্নতি হয়েছে। কিন্তু শিক্ষার মানের ক্রমাগত অবনতি হচ্ছে। প্রাথমিক শিক্ষাকে আমরা একমুখী করতে পারিনি। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা মোটা দাগে তিন ভাগে বিভক্ত – বাংলা, ইংরেজি ও আরবি। কারিকুলামের ঘন ঘন পরিবর্তনের সাথে খাপখাইয়ে নিতে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবাইকে বেগ পেতে হচ্ছে। 

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাম্প্রতিক এক জরিপে জানা গেছে, প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত দেশের বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করে। জরিপের তথ্যানুযায়ী বর্তমানে সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করছে ৪৬. ৮৬ শতাংশ শিক্ষার্থী। বাকি ৫৩.১৪ শতাংশ শিক্ষার্থী পড়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। এর মধ্যে এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ২৭.৬৮ শতাংশ লেখাপড়া করে। আর এমপিওবহির্ভূত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করে ১৩.৯৬ শতাংশ শিক্ষার্থী। এর বাইরে উপানুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠানে ৬.৫০ শতাংশ ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে ৪.১৯ শতাংশ শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করে।

শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার মান, পরিবেশ, আস্থাহীনতা ও শ্রেণিবৈষম্যকে (ধনী-গরিব) বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী পড়ার মূল কারণ হিসেবে দায়ী করছেন। এক্ষেত্রে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ ফিরিয়ে আনা, শিক্ষকদের দায়িত্বশীল আচরণ, শিক্ষা খাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো এবারই প্রথম পাঠদানরত প্রতিষ্ঠানের ধরন নিয়ে জরিপ করে। সম্প্রতি বিবিএস ‘বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিক ২০২৩’ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দেশে বাংলা মাধ্যমে পড়ালেখা করছে ৮৮.৪০ শতাংশ শিক্ষার্থী। এর বাইরে ইংরেজি মাধ্যম ০.৬৯ শতাংশ, ইংরেজি ভার্সন ০.১৫ শতাংশ এবং অন্যান্য মাধ্যমে পড়ছে ১০.৭৭ শতাংশ শিক্ষার্থী। জরিপে আরও উঠে আসে সাধারণ শিক্ষায় ৯১.২ শতাংশ, কারিগরি শিক্ষায় ১.২২ শতাংশ, ধর্মীয় শিক্ষায় ৭.২৯ শতাংশ এবং অন্যান্য শিক্ষায় ০.৪৮ শতাংশ শিক্ষার্থী পড়ালেখা করছে।

এখনও বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নের মূল কারণ হিসেবে অভিভাবকদের আস্থার অভাবকেই দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। একই সঙ্গে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যে পরিমাণ বিনিয়োগ প্রয়োজন, সেই পরিমাণ বিনিয়োগ সরকার করছে না বলেও মনে করেন তারা। অভিভাবকরা মনে করেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করলে ভালো ভবিষ্যৎ গড়বে না। বেশি টাকা খরচ হলেও তারা ইংরেজি মাধ্যমে পড়ায়। আবার কেউ কেউ পরকালের প্রাপ্তির জন্য সন্তানদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা করান। এ কারণেই মূল ধারায় সংযুক্ত কম হচ্ছে।

শিক্ষায় বৈষম্য দূর করাসহ এখনো সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা মান্য হচ্ছে না। সংবিধানের ১৭ অনুচ্ছেদে মূলত তিনটি বিষয় উল্লেখ আছে। ‘অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা’ শীর্ষক এই অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রথমত- সরকার একই পদ্ধতির গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সব ছেলে ও মেয়েকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষার ব্যবস্থা করবে। দ্বিতীয়ত- সমাজের প্রয়োজনের সঙ্গে শিক্ষাকে সঙ্গতিপূর্ণ এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও সদিচ্ছাপ্রণোদিত নাগরিক সৃষ্টির ব্যবস্থা করতে হবে। তৃতীয়ত- আইনের দ্বারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিরক্ষরতা দূর করার ব্যবস্থা গ্রহণ করবে সরকার। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, এই অনুচ্ছেদের তিনটি ধারার একটিও পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি।

দীর্ঘদিন ধরেই শিক্ষাখাত অবহেলিত। শিক্ষাখাতে মেধাবীদের আকৃষ্ট করতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। পাশাপাশি যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। বর্তমানে  সরকারি-বেসরকারি স্কুল-কলেজ এবং সমমানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ প্রক্রিয়া উন্নত হয়েছে। বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগে ন্যাশনাল রেগুলেটরি টেলিকমিউনিকেশন কমিশন (এনটিআরসি) চালু হওয়ায় শিক্ষকদের ন্যূনতম মান নিশ্চিত হয়েছে। কিন্তু অতি গুরুত্বপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা স্বচ্ছ ও আধুনিকায়ন এখনও হয়নি। 

শিক্ষকরা, বিশেষত বেসরকারি শিক্ষকরা, নানা বঞ্চনার শিকার। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়ায় এ বছর বিশ্ব শিক্ষক দিবসে নতুন প্রত্যাশার সৃষ্টি হয়েছে। দলমত নির্বিশেষে স্কুল কলেজের শিক্ষকরা আজ বিশ্ব শিক্ষক দিবসে সবাই সমবেত হয়েছে তাদের দীর্ঘদিনের বঞ্চনা কেটে যাবে এই প্রত্যাশায়।

হা/04/1024 dtbangla