বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক দেশ। জাতীয় নদী তার রক্ষা কমিশনের ২০২৩ সালের তথ্যমতে, দেশের বর্তমান নদ-নদীর সংখ্যা ১ হাজার ৮ টি। তবে এই সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে হিমালয় থেকে উৎপন্ন জলের ধারা স্বভাবজাত ধর্ম অনুযায়ী বাংলাদেশের ওপর দিয়ে প্রভাবিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশে। পথিমধ্যে বাংলা নামের এ জনপদকে সমৃদ্ধ করে অসংখ্য নদনদী দিয়ে; বাংলা হয়েছে নদীমাতৃক বাংলাদেশে।
গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ এলাকা হওয়ায় বাংলাদেশ প্রতি বছরেই বর্ষাকালে ছোট থেকে মাঝারি আকারের বন্যায় প্লাবিত হয়ে থাকে। সাধারণত মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর মাস বাংলাদেশে বর্ষা ঋতু। এই সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের প্রধান নদী ও উপনদীগুলো হিমালয়ের বরফগলা ও বৃষ্টির পানিতে তুলনামূলকভাবে পানির উচ্চ প্রবাহে প্রবাহিত হয় এবং বাংলাদেশ বন্যায় প্লাবিত হয়।
বাংলাদেশে সাধারণত সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, রংপুর, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, জামালপুর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ – এসব জেলা বন্যার ঝুঁকিতে থাকে। প্রতিবছর বৃষ্টিপাতের ফলে উযানে সৃষ্ট হওয়া জলপ্রবাহ আমাদের দেশের ভাটি অঞ্চলকে প্লাবিত করে। বাংলাদেশ নিরাপদ পানি আন্দোলনের (বানিপা) তথ্যমতে, ভারত থেকে প্রতিবছর ১.২-২.৪ বিলিয়ন টন পলি নদীবাহিত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। ফলে দেশের নদ-নদীর ও হাওর গুলোর তলদেশে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। আগে বন্যার পানি দ্রুত বৃদ্ধি ও হ্রাস পেত কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এই পানি দ্রুত নিষ্কাশন না হতে পেরে দীর্ঘস্থায়ী বন্যা দেখা দিচ্ছে।
অতীতে বন্যা বাংলাদেশে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে বিশেষ করে ১৯৬৬, ১৯৮৮, ১৯৯৮, ২০০৪, ২০০৭, ২০১৭, ২০২২ ও ২০২৪ সালে। অর্থ্যাৎ দেখা যায়,২০০০ সালের পূর্ব পর্যন্ত প্রতি ১০ বছর পর বাংলাদেশে একটি বড় বন্যা হয়ে ছিল।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা হিসাবে গণ্য করা হয় ১৯৭৪ সালের বন্যাকে। এই বন্যায় দেশের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয় এবং অসংখ্য মানুষের প্রাণহানি হয়। ১৯৮৮ সালের বন্যাটিও বাংলাদেশের জন্য এক বিরাট দুর্যোগ ছিল। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলো ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দেশের ৬০ শতাংশ এলাকা প্লাবিত করে এবং প্রায় ৩০ মিলিয়ন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৯৯৮ সালের বন্যাটি প্রায় ৭০ শতাংশ এলাকা প্লাবিত করে এবং ১,১০০ জন মানুষের মৃত্যু ঘটে। এই বন্যা দেশের অর্থনৈতিক অবকাঠামোতে ব্যাপক ক্ষতি করে। এরপর ক্রমাগত ২০০৪, ২০০৭, ২০১৭, ২০২২, ২০২৪ বন্যা বাংলাদেশে ভয়াবহ রুপ ধারণ করে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ সব সময় এমনি এমনি আসে না; রবং মানবসৃষ্ট নানা প্রেক্ষাপট ও কারণ তৈরি হওয়ার মাধ্যমে আসে। মানুষের কার্যকলাপের কারণে সংঘটিত জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণতার ফলে তাপমাত্রার অস্বাভাবিক বৃদ্ধি, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং ভারীবর্ষণ ঘটে চলেছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণ, নগরায়ণের ফলে জলাভূমি ভরাট হওয়া, নদীর নাব্য হ্রাস পাওয়া, নদ-নদী অপদখলে চলে যাওয়া, হাওরের মাঝখানে রাস্তা বানিয়ে পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত করা, নদীগুলো ড্রেজিং না করা ইত্যাদি কারণে এসব অতিবৃষ্টির পানিপ্রবাহ বিঘ্নিত হচ্ছে। ফলে তা বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ফসল, সম্পদ, ঘরবাড়ির পাশাপাশি মানুষকেও ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের বন্যার জন্য ভারত মোটেও দায় এড়াতে পারে না। বরং দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশ ভারতের পানি আগ্রাসনের শিকার। আন্তর্জাতিক আইন, প্রতিবেশীর অধিকার সব কিছুকেই বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বাংলাদেশের ৫৪টি নদীর উৎসমুখে ফারাক্কা বাঁধ, টিপাইমুখ বাঁধসহ একাধিক বাঁধ ও ড্যাম নির্মাণ করে বাংলাদেশকে তিলে তিলে ধ্বংস করছে ভারত। বর্ষাকালে আমাদের পানিতে ভাসিয়ে মারছে আর খরায় পানি আটকে দিয়ে বাংলাদেশকে মরুভূমি বানিয়ে দিচ্ছে।
আকস্মিক বন্যা প্রতিরোধে আমাদের কার্যকর কিছু পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। যেমন- ১) যেকোনো কঠিন পরিস্থিতিতে ধৈর্যধারণ করতে হবে এবং শক্তভাবে সাহস নিয়ে টিকে থাকতে হবে, ২) বানভাসি মানুষের পাশে সাধ্যমতো দাঁড়াতে হবে এবং তাদের ত্বরিত পুনর্বাসনের প্রক্রিয়া নিতে হবে, ৩) কীভাবে জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি রোধ করা যায়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে তার যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে, ৪) বাংলাদেশের নদ-নদীর নাব্য বৃদ্ধি এবং তা ধরে রাখার কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে, ৫) ভারতের পানি আগ্রাসন বন্ধের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশ ভাটির দেশ হিসেবে উল্লেখযোগ্য নদীগুলোর উৎস দেশের ভূ-সীমানার বাইরে থাকায় অভিন্ন নদীগুলোর গতিপ্রবাহ স্বাভাবিক রাখার ব্যাপারে প্রতিবেশি দেশ ভারতের সঙ্গে এমন গঠনমূলক উদ্যোগ নিতে হবে, যাতে তা কার্যকর ও ফলপ্রসূ হয়, ৬) যত্রতত্র বাঁধ নির্মাণ করে পানির প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করা ও অপরিকল্পিত নগরায়ণ বন্ধ করতে হবে।
বাংলাদেশে বন্যার প্রাকৃতিক কারণ তথা এ অঞ্চলের ভৌগোলিক অবস্থান, উজান থেকে আসা পাহাড়ি ঢল, অতিবৃষ্টি এসব প্রতিকারের কোনো উপায় নেই। তবে এ বিষয়গুলো মাথায় রেখেই এ অঞ্চলের বন্যা মোকাবিলার উপায় বের করতে হবে। সবার আগে প্রয়োজন উজান থেকে আসা পাহাড়ি ঢল বা অতিবৃষ্টির পানি যত বেশি পরিমাণে এবং যত দ্রুত সময়ে নিষ্কাশন করা যায় সেটি নিশ্চিত করা।
এজন্য এ অঞ্চলের নদীগুলোর তলদেশে জরিপ করে প্রয়োজনীয় স্থানগুলোয় ড্রেজিং করে নদীগুলোর পানিপ্রবাহ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে, নদীগুলোর দুই পাড়ে সব অবৈধ দখল উচ্ছেদ করে নদীর প্রশস্ততা বাড়াতে হবে, নদীতে অপরিকল্পিতভাবে বাঁধ দেয়া এবং নদী থেকে অপরিকল্পিতভাবে পাথর ও বালি উত্তোলন রোধ করতে হবে, হাওরের সঙ্গে নদীগুলোর সংযোগ নিশ্চিত করতে হবে, নদীর পাড়ের প্রাকৃতিক প্লাবন ভূমিগুলোয় বসতি স্থাপন ও অপরিকল্পিত নগরায়ণ বন্ধ করতে হবে, বৃষ্টির পানি সাময়িকভাবে ধারণের জন্য জলাধার, নিম্নাচল, পুকুর ভরাট বন্ধ করে সেগুলো সংরক্ষণ করতে হবে।
মোট কথা, এ অঞ্চলের সাম্প্রতিক ভয়াবহ বন্যায় জনদুর্ভোগ ও ক্ষয়ক্ষতির কথা বিবেচনা করে ভবিষ্যতে এ ধরনের বন্যা মোকাবিলার সব কারিগরি ও প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
প্রিন্ট করুন
Discussion about this post