রোমান আহমেদ ,জামালপুর প্রতিনিধি:
জামালপুর জেলার একমাত্র ক্ষুদ্র নৃ-তাত্বিক গোষ্ঠীর বীর মুক্তিযোদ্ধা রুইন্দ্র মারাক এবেন্দ্র। ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ২০২১ সালের ১৪ জানুয়ারি মারা যান তিনি।
জীবন বাজি রেখে দেশকে স্বাধীন করেছেন জেলার বকশিগঞ্জ উপজেলার কামালপুর ইউনিয়নের দিঘলাকোনা গ্রামের বাসিন্দা রুইন্দ্র মারাক এবেন্দ্র। এছাড়াও ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর প্রতিবাদ করেন তিনি। আর এজন্য টানা সাত বছর কারাগারে থাকতে হয় মুক্তিযোদ্ধা রুইন্দ্র মারাক এবেন্দ্রকে। টানা ৫২ বছর পেয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা সম্মাননা ও মুক্তিযোদ্ধা ভাতা।
পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম অভিভাবককে হারিয়ে খুব কষ্টে দিন যাপন করতে থাকে মুক্তিযোদ্ধা রুইন্দ্র মারাক এবেন্দ্রের স্ত্রী মিলন মারাক ও একমাত্র সন্তান জয় দাংগো। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা রুইন্দ্র মারাক এবেন্দ্র মারা যাবার দুই বছর পর ২০২৩ সালের মার্চ মাসে পার্শবর্তী শেরপুর জেলার বাসিন্দা সুবেন্দ্র সাংমা নিজেকে রুইন্দ্র মারাক এবেন্দ্রের সন্তান দাবি করে অভিযোগ করে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রনালয়ে। এরপর দুঃখের দিন শুরু হয় জয় দাংগো ও তার পরিবারের। বন্ধ হয়ে যায় মুক্তিযোদ্ধা ভাতা। এখন কোনমতে চলছে মৃত মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সংসার।
মৃত ওই মুক্তিযোদ্ধার ছেলে জয় দাংগো বলেন-‘ বাবা মারা যাবার পর আমরা অভিভাবক শূণ্য হয়ে পড়ি। এরপর আবার ভাতা বন্ধ হয়ে গেছে। আমি মন্ত্রনালয় থেকে শুরু করে সবার কাছে গিয়েছি। কিন্তু কেউ আমাদের কথা শুনছে না। আমাদের অবস্থা এখন খুবই শোচনীয়।’
জয় দাংগো আরও বলেন-‘যে অভিযোগের ভিত্তিতে আমাদের ভাতা বন্ধ করা হয়েছে। সেই অভিযোগটি মিথ্যা প্রমানিত হয়েছে। সমাজ সেবা সেই প্রতিবেদন মন্ত্রনালয়ে পাঠিয়েছে। তবুও আমাদের ভাতা চালু হচ্ছে না। আমার কোনো চাকরি নেই। এই ভাতার উপর নির্ভর করে আমার সংসার চলতো। আমার বাবা জীবন বাজি রেখে দেশ স্বাধীন করেছে। এখন আমাদের সংসারই ধ্বংস হওয়ার পথে। এভাবে চলতে থাকলে রাস্তায় গিয়ে দাড়ানো ছাড়া আমাদের আর উপায় নেই। আমরা চাই যে আমাদের ভাতা আবার চালু করা হোক।’
মৃত মুক্তিযোদ্ধা রুইন্দ্র মারাক এবেন্দ্রের স্ত্রী মিলন মারাক বলেন-‘যুদ্ধের পর থেকে আমরা ভাতা পায়। হঠ্যাৎ করে একটা অভিযোগের কারনে আমাদের ভাতা বন্ধ হয়ে গেলো। যে নিজেকে রুইন্দ্র মারাক এবেন্দ্রের সন্তান দাবি করছে জাতীয় পরিচয় পত্রে তার বাবার নাম মহেন্দ্র মারাক। তার মা রিনিকা সাংমার জাতীয় পরিচয় পত্রে স্বামীর নাম মহেন্দ্র মারাক। এসব বিষয় তদন্ত না করেই আমাদের ভাতা বন্ধ করে দিলো। কর্তৃপক্ষ একবার চিন্তা করলো না যে আমাদের সংসার কিভাবে চলবে? এমনেই পাহারে আয়ের উৎস নেই। আমরা এই ভাতার টাকায় চলি। সেটা বন্ধ। দিন দিন আমাদের দম বন্ধ হয়ে আসতাছে।’
সুবেন্দ্র সাংমার অভিযোগের প্রেক্ষিতে তদন্ত শুরু করে কর্তৃপক্ষ। ২০২৩ সালের ১৯ জুলাই বকশিগঞ্জ উপজেলা পরিষদে তদন্তের সময় স্বাক্ষ্য দেন উপজেলার সকল মুক্তিযোদ্ধা। তারা সকলে জয় দাংগো তার পরিবারকে মৃত রুইন্দ্র মারাক এবেন্দ্রের পরিবার বলে স্বাক্ষ্য দেন।
বকশিগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধা শাহ আলম বলেন-‘রুইন্দ্র আমার সাথে ছিলো। আমার সাথে ট্রেনিং করেছে। আমি ওদের কোম্পানি টু আইসি ছিলাম। এর ভেতর কোনো সন্দেহ নেই। যারা এখন অভিযোগ দিয়েছে বা দাবি করছে তাহলে তাদের সাথে আমাদের দেখা হলো না কেনো? তারা এতোদিন কোথায় ছিলো?’
কামালপুর ইউনিয়ন পরিষদের কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা মোঃ মজিবর বলেন-‘রুইন্দ্র মারাক এবেন্দ্রের সাথে আমরা একসঙ্গে প্রশিক্ষন নিয়েছি ও যুদ্ধ করেছি। আমরা জীবন বাজি রেখে এই দেশ স্বাধীন করেছি। ভাতার শুরু থেকে আমরা একসাথে ভাতা উত্তোলন করেছি। সে মারা যাবার পর কে কারা অভিযোগ দিয়েছে। সেই অভিযোগের উপর ভাতা বন্ধ করে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ।’
তিনি আরও বলেন-‘ যে অভিযোগ করেছে বা দাবি করছে। তাদের আমরা মুক্তিযোদ্ধারা চিনি না। উড়ে এসে জুড়ে বসেছে। এই বিষয় নিয়ে আমরা তদন্তের সময় সাক্ষ্য দিয়েছি। তবুও কোনো কাজে আসছে না। আমরা বেচে থাকতে যদি আমাদের সন্তানদের এই অবস্থা হয়। তাহলে আমরা মারা গেলে কি হবে। এই বিষয়টি খুবই দুঃখজনক।’
তবে এসব বিষয়ে কোনো কথা বলতে নারাজ অভিযোগকারী সুবেন্দ্র সাংমা।
এসব বিষয়ে বকশিগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অহনা জান্নাত বলেন-‘মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের ভাতা বন্ধ করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রনালয় থেকে। এরপর আমাদের কাছে তদন্তের দায়িত্ব আসলে আমরা তদন্ত করে তার প্রতিবেদন মন্ত্রনালয়ে পাঠিয়েছি। এখন এই বিষয়ে মন্ত্রনালয় সিদ্ধান্ত নিবে। এখানে আমাদের করার কিছু নেই।’
দৈনিক দেশতথ্য//এইচ//

Discussion about this post