ভাষা আন্দোলনে কখন কিভাবে কি হয়েছিল নবীন প্রজন্মের বেশির ভাগের কাছেই তা প্রায় অজানা। তাদের জন্য আজকের এই প্রয়াস।
বাংলা ভাষা আন্দোলনঃ এই আন্দোলনের ব্যাপ্তি ছিলো ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৬ পর্যন্ত। এটা ছিল মূলত তৎকালীন পূর্ব বাংলায় (বর্তমান বাংলাদেশে) সংঘটিত একটি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন।
ভারত ভাগের আগে অর্থাৎ ১৯৪৭ সালের ১৭ই মে খলীকুজ্জমান ও জুলাই মাসে আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডক্টর জিয়াউদ্দিন আহমেদ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা করার প্রস্তাব করেন। এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে প্রবন্ধ লিখে প্রতিবাদ করেন ছিলেন ডক্টর মুহাম্মাদ শহীদুল্লাহ ও মুহম্মদ এনামুল হকসহ বেশ ক’জন বুদ্ধিজীবী৷
ভারত ভাগের পর ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসে করাচিতে অনুষ্ঠিত এক শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত গণপরিষদে উর্দু ও ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা ব্যবহারের দাবি জানান। তার দাবি অগ্রাহ্য হয়। ফলে ২৬শে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ধর্মঘট পালিত হয়। ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে “সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ” পুনর্গঠিত হয়েছিল৷ এবং ১১ মার্চ সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয় এবং বাংলা ভাষা দাবি দিবস ঘোষণা দেওয়া হয়। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম ছাত্রলীগ এই কর্মসূচি পালনে বিশিষ্ট ভুমিকা পালন করে।
১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ পাকিস্তানের গর্ভনর জেনারেল মুহাম্মাদ আলী জিন্নাহ ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঘোষণা দেন “উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা।” এরপর ২৪ মার্চ তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একই ঘোষণা দিলে ছাত্ররা তার উক্তির চরম প্রতিবাদ জানায়।
বাংলা ভাষা নিয়ে পাকিস্তানের উর্দুভাষী শাসকরা ছিল শঙ্কিত। তারা মনে করতো মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ প্রসূত দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়েছে। পাকিস্তানের সব নাগরিক হবে খাঁটি মুসলমান। পূর্ব বাংলা ও ভারতের পশ্চিমবাংলার লোকেরা ভাষা গত ভাবে এক। তাই তাদের মধ্যে হিন্দুয়ানী মনোভাব প্রখর।
পূর্ব পাকিস্তানীদের মন থেকে হিন্দুয়ানী প্রভাব সরিয়ে তাদেরকে খাঁটি মুসলমান বানাতে হবে। সেই লক্ষে ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান সরকার ঘোষণা করে উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।
এতে পূর্ব বাংলার বাংলাভাষী জনগণের মধ্যে ক্ষোভের জন্ম হয়। সেই ক্ষোভ পূর্ব বাংলায় আন্দোলনে রূপ নেয়। এই আন্দোলন দমন করার জন্য ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে মিছিল, সমাবেশ নিষিদ্ধ করে।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি (৮ ফাল্গুন ১৩৫৮) এ আদেশ অমান্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু সংখ্যক ছাত্র ও প্রগতিশীল কিছু রাজনৈতিক কর্মী মিলে বিক্ষোভ মিছিল বের করে।
মিছিলটি ঢাকা মেডিকেলের কাছে এলে পুলিশ আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। গুলিতে নিহত হন বাদামতলী কমার্শিয়াল প্রেসের মালিকের ছেলে রফিক, সালাম, এম. এ. ক্লাসের ছাত্র বরকত ও আব্দুল জব্বারসহ আরও অনেকে। এসময় ১৭ জন ছাত্র-যুবক আহত হয়।
শহীদদের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়ে ওঠে। শোকাবহ এ ঘটনায় সমগ্র পূর্ব বাংলায় ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ২১ ফেব্রুয়ারির ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে আগুন জ্বলে ওঠে। ২২ ও ২৩ ফেব্রুয়ারি ছাত্র, শ্রমিক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক ও সাধারণ জনতা পূর্ণ হরতাল পালন করে এবং সভা-শোভাযাত্রাসহকারে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে। ২২ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে শহীদ হন শফিউর রহমান শফিক, রিক্সাচালক আউয়াল এবং অলিউল্লাহ নামক এক কিশোর। ২৩ ফেব্রুয়ারি ফুলবাড়িয়ায় ছাত্র-জনতার মিছিলেও পুলিশ অত্যাচার-নিপীড়ন চালায়।
ভাষা আন্দোলনের শহীদ স্মৃতিকে অম্লান করে রাখার জন্য মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে রাতারাতি গড়ে ওঠে শহীদ মিনার।
২৪ ফেব্রুয়ারি এই শহীদ মিনার উদ্বোধন করেন শহীদ শফিউর রহমানের পিতা। ২৬ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে শহীদ মিনারের উদ্বোধন করেন দৈনিক আজাদ পত্রিকার সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন।
ক্রমবর্ধমান গণআন্দোলনের মুখে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার শেষ পর্যন্ত নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়। ১৯৫৪ সালের ৭ই মে পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গৃহীত হয়। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণীত হলে ২১৪ নং অনুচ্ছেদে বাংলা ও উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উল্লিখিত হয়।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা প্রবর্তিত হয়। সর্বস্তরে বাংলার ব্যবহার নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকার ১৯৮৭ সালে বাংলা ভাষা প্রচলন আইন জারি করে।
১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো বাংলা ভাষা আন্দোলন, মানুষের ভাষা এবং কৃষ্টির অধিকারের প্রতি সম্মান জানিয়ে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। যা বৈশ্বিক পর্যায়ে সাংবার্ষিকভাবে গভীর শ্রদ্ধা ও যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে উদ্যাপন করা হয়।
ভাষা শহীদদের স্মরণে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে স্থাপিত মোদের গরব ভাস্কর্য।
১৯৫৩ সাল থেকে প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখে মহান ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানানো হয়। এ দিন প্রত্যুষে সর্বস্তরের মানুষ খালি পায়ে প্রভাতফেরীতে অংশগ্রহণ করে এবং শহীদ মিনারে গিয়ে গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন ও পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করে। সারাদিন মানুষ শোকের চিহ্নস্বরূপ কালো ব্যাজ ধারণ করে। এছাড়া আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ইত্যাদির মাধ্যমে ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি তর্পণ করা হয় এবং ভাষা আন্দোলনের শহীদদের আত্মার মাগফিরাত ও শান্তি কামনা করা হয়। ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর থেকে দিনটি কখনো জাতীয় শোক দিবস, কখনোবা জাতীয় শহীদ দিবস হিসাবে রাষ্ট্রীয়ভাবে উদযাপিত হয়ে আসছে।
২০০১ সাল থেকে দিবসটি উদযাপিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। বাংলাদেশে এদিনে সরকারি ছুটি। বাংলাদেশ বেতার, বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরা হয়। দৈনিক সংবাদপত্রসমূহে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করা হয়। বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণে আয়োজিত অমর একুশে গ্রন্থমেলা অনুষ্ঠিত হয় পুরো ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে। বাংলাদেশ সরকার বাংলা ভাষা আন্দোলনকে ঘিরে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের একুশে পদক প্রদান করে।
এবি//দৈনিক দেশতথ্য //২১ ফেব্রুয়ারি,২০২২//