ভোট চাই ভোটারের, দোয়া চাই সকলের, যাবেই যাবে জিতেই যাবে, আমার ভাই তোমার ভাই —+-+——– অমুক ভাই তমোক ভাই, আর কত কি যে শ্লোগানে মুখরিত থাকত নির্বাচনের মাঠ। এবার নির্বাচন আছে, প্রার্থী আছে। নেই কেবল আগের নির্বাচনের উৎসব মূখর পরিবেশ।
অনেক জায়গায় ভোটের আগেই হয়ে গেছে রেজাল্ট। অনেক জায়গায় ভোটে দাঁড়ানোর মতো কোন প্রার্থীই নেই।
কেন নেই সেও তো এক প্রশ্ন বিটে!
জানা গেছে, আগামি ১১ নভেম্বর দ্বিতীয় ধাপে ৮৪৮টি ২৮ নভেম্বর তৃতীয় ধাপে ১ হাজার ৭টি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
এর আগে ২০ জুন ও ২০ সেপ্টেম্বর দুই দফায় প্রথম ধাপে ৩৬৫টি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এবারের ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে সহিংসতার পাশাপাশি বিনা প্রতিদ্বন্বিতায় নির্বাচিত হবার খবর পাওয়া গেছে।
নির্বাচন কমিশনের তথ্যমতে ১১ নভেম্বরের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার আগেই চেয়ারম্যান পদে ৮১, সংরক্ষিত নারী সদস্য পদে ৭৬ ও সাধারণ সদস্য পদে ২০৩ জন বিনা ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন।
দ্বিতীয় ধাপে বিনা ভোটে ১৫৪ জন চেয়ারম্যান ও ১০৬ জন মেম্বার নির্বাচিত হয়েছেন। এই হিসেবে চেয়ারম্যান মেম্বার মিলে ৫৬৬ জন জিতেছেন। তৃতীয় ধাপে প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় ৩১৩ জন জিতে আছেন। সব মিলিয়ে যার বিনা ভোটে জিতার সংখ্যা দাঁড়াবে ৮৭৯।
আর ২৮ নভেম্বরের নির্বাচনের মনোনয়ন বাছাইয়ের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। ১ হাজার ৭টি ইউনিয়ন পরিষদে চেয়ারম্যান, সংরক্ষিত নারী সদস্য ও সাধারণ সদস্য পদে মোট ৫৩ হাজার ৮০১ টি মনোনয়নপত্র জমা পড়েছে।
এরমধ্যে চেয়ারম্যান পদে ৪৩, সংরক্ষিত নারী সদস্য পদে ৭০ ও সাধারণ সদস্য পদে ২০০ জন সহ তিন পদে মোট ৩১৩ জন একক প্রার্থী রয়েছে। তাঁদের বিপক্ষে কেউ মনোনয়ন পত্র দাখিল করেননি।
তাই মনোনয়ন পত্র প্রত্যাহরের শেষ দিনে কোন প্রার্থী মনোনয়ন পত্র প্রত্যাহার না করলে তারা বিনা প্রতিদ্বন্বিতায় নির্বাচিত হবেন। বিষয়টা অনেকটা লুডু খেলায় ছক্কা চাওয়ার মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে।
যেমন লুডু খেলায় সবাই ছক্কা ছক্কা করে। এক ছক্কা দুই ছক্কা হলেই বলে আর নয়। এবার চাই পুট (এক)। এর কারণ হলো তিন ছক্কা হয়ে গেলে সবগুলোই বাতিল হয়ে যায়। এরপর চাল দিয়ে যা পাওয়া যায় তাই নিয়েই মন খারাপ করে গুটি এগিয়ে নিতে হয়।
এবারের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে তিন ছক্কার মতো করে তিন ধাপে অনুষ্ঠিত হবে। ভোট না করেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে গেছেন ৮৭৯ জন চেয়ারম্যান ও মেম্বার। এতে প্রার্থীদের বিজয় হলেও সরকারের জন্য এটা এখন দুই ছক্কা পাওয়ার মতোই বিষয় হয়ে আছে।
তৃতীয় ধাপেও যদি একইভাবে বিপুল সংখ্যক প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে যায় তবে তিন ছক্কার মতোই জনমনে বাতিল হয়ে যাবে নির্বাচনের ক্রেডিবিলিটি।
বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জেতা নতুন কোন বিষয় নয়। তবে সেই জয় ছিল জনপ্রিয়তার জয়। বর্তমানে তা কেবলইমাত্র যে ভয় তা বলার অপেক্ষা রাখেনা।
স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বিপুল সংখ্যক প্রার্থী বিনা ভোটে নির্বাচিত হওয়াটা গণতন্ত্রের জন্য বেমানান।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার ছহুল হোসেন একটি পত্রিকায় সাক্ষাৎকারে বলেছেন “ এত প্রার্থী ভোটের আগেই জয় পেয়ে যাওয়াটা গণতন্ত্রের জন্য দুঃসংবাদ। আমরা সবাই চাই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্বিতা হোক।”
যেকোন নির্বাচনের নিয়ামক শক্তি হলো জনগন তথা ভোটার। ভোট ব্যবস্থার শুরু থেকেই স্থানীয় সরকার নির্বাচনকে জনগন তথা ভোটাররা একটি উৎসব হিসেবেই দেখে আসছে। দল ও মতের বিচার না করে স্থানীয় সরকার নির্বাচন পাড়া, মহল্লা, গ্রাম ও আত্মীয়তাকে কেন্দ্র করে বিভাজিত হয়ে ভোট লড়াইয়ে অবতীর্ন হয়।
যার পরিপ্রেক্ষিতে দেখেছি যে সমস্ত পরিবার চেয়ারম্যান ও মেম্বর পদের ভোটের রাজনীতিতে মাঠে থাকতেন তারা নিজেদের ভোট ব্যাংক বাড়ানোর জন্য নিজ নিজ ওয়ার্ড ও ইউনিয়নের মধ্যে একে অপরের সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ে তুলে ভোট ব্যাংককে স্ফীত করতেন। সেকারনে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন হতো অত্যন্ত প্রতিদ্বন্বিতাপূর্ন।
যে ক’দিন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের ক্যাম্পেইন চলতো সে ক’দিন পাড়া, মহল্লা সর্বোপরি গোটা ইউনিয়নব্যাপি আনন্দের জোয়ার বয়ে যেত। যার যার প্রার্থীর প্রচারণায় কর্মী-সমর্থকেরা দিন-রাত আনন্দমুখর পরিবেশে অতিবাহিত করতেন।
স্থানীয় সরকার ভোটের ক’দিন গ্রাম বাংলায় বয়ে যেত ঈদের আমেজ। পূর্বে স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে দেখেছি শীতকালে। শীতের সময় ভোট প্রার্থী ও তার সমর্থকেরা শীতকে উপেক্ষা করে নিজ প্রার্থীর পক্ষে সারারাত আনন্দ উল্লাসে ভোট ভিক্ষা করে বেড়াতেন। সারারাত পুরা পাড়া, মহল্লা, গ্রাম যেন ভোটের আনন্দে জেগে থাকতো। সে আনন্দের মধ্যেই একে অপরের প্রতি খেয়াল রাখতেন কেউ কোথাও অনৈতিকভাবে ভোট কেনাবেচা করছেন কিনা। বিশেষ করে ভোটের আগের রাতে যাকে স্থানীয়ভাবে ‘ছয় কুলোর রাত’ বলা হতো, সে রাতে সারা ইউনিয়নব্যাপি কর্মী-সমর্থকেরা নিজ নিজ প্রার্থীর ভোট সারারাত জেগে পাহারা দিত।
এখন স্থানীয় সরকার ভোট হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু সে-ই আমেজ, সে-ই আনন্দের পরিবেশ এখন আর লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। কেমন যেন সব পানসে হয়ে গেছে।
এখন স্থানীয় সরকার নির্বাচন হচ্ছে দলীয় ব্যানারে। তাই দলের সিদ্ধান্তের বাইরে নির্বাচন করা যাচ্ছে না। দল করলে তাকে দলীয় সিদ্ধান্ত মানতেই হবে। তাই ইচ্ছা থাকলেও দলীয় মনোনয়ন না পেলে শত ইচ্ছা থাকলেও অনেকের পক্ষে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা হয়ে উঠছে না। আমার মতে সে কারনেই সারাদেশে এত একক প্রার্থীর আধিক্য দেখা যাচ্ছে।
আমি মনে করি, যেকোনো খেলার একটা নিয়ম আছে। খেলাটি হয় মাঠে। নির্বাচন হয় ভোটকেন্দ্রে। সেই ভোটকেন্দ্রের পরিবেশ আনন্দ ও উৎসব মুখর করতে হলে স্থানীয় সরকার নির্বাচনকে ফিরিয়ে আনতে হবে আগের নিয়মে। তাইতো এখন স্থানীয় সরকার নির্বাচনের মাঠে কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে “আছে ভোট, নেই উৎসব।”
লেখকঃ কুষ্টিয়ার মীর আব্দুল করিম কলেজের অধ্যক্ষ।

Discussion about this post