Print Date & Time : 11 July 2025 Friday 9:24 pm

-:মুক্তির কড়চা:-

প্রথম পর্ব:

ভূল করে ব্যাক্তি খেসারত দেয় পরিবার। ভূল করে নেতা মাসুল গুনে দল। ভূল করে রাষ্ট্রনায়ক খেসারত দেয় জাতী। এসব উক্তির অকাঠ্য প্রমান আকসার। আড়াই শত বছর ধরে লড়াই করার পর উপ-মহাদেশে এসেছিল স্বাধীনতা। সেই স্বাধীনতা প্রত্যক্ষ সুফল রক্তের নদীতে পড়ে বিষাদ হয়েছিল। কার ভূলে কিভাবে তা হয়েছিল তা কারো অজানা নয়। তারপরও কেউ ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়নি। দ্বিজাতী তত্বের ভিত্তিতে গড়া পাকিস্তান ২৫ বছরে ভেঙ্গে হয়েছে খানখান। 

১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলন ৬৯ এর গণ অভ্যুত্থান ১৯৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধ বাঙালীর অহংকার। এসব আন্দোলন দেশের রাজনীতি ও রাজনীতিকদের নানা বিষয় তুলে ধরবো। কেবলমাত্র ঢাকা নয়, দেশের কোন জেলায় কি ধরণের আন্দোলন হয়েছিল তা তুলে ধরা হবে।

আজকের প্রথম পর্বে তুলে ধরবো “মমতাজ” আপা নামের এক রাজনৈতিক কর্মীর কথা।

মমতাজ আপা: মিছিল যাচ্ছে। মমতাজ আপা সামনের সারিতে। এই কাবেরী আসো, আহা আসো না। রোকেয়া হলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কাবেরী সেই মমতাজ আপার ডাক এড়াতে পারলো না। মিছিলে ঢুকে পড়লো। ছাত্রীদের মিছিল, জোর পায়ে এগিয়ে চলছে। অনেক শ্লোগান, তবে একটি শ্লোগান কাবেরীর ভেতরটা নাড়া দিলো “বীর বাঙ্গালী অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো”।

গলার সবখানি জোর খাটিয়ে কাবেরী এ শ্লোগানের জবাব দিতে থাকলো। এটাই তার প্রথম মিছিলে যাওয়া। সেই কুমিল্লায় থাকতে মমতাজ আপার সঙ্গে পরিচয় হলেও কাবেরী কখনো মিছিলে যায়নি। কোন রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়নি। বাড়ির নিষেধ আছে। বাবা সরকারী চাকুরীজীবি। তাও আবার পুলিশ বিভাগে। মা বলে দিয়েছেন দ্যাখো, আমরা হিন্দু। পদে পদে আমাদের দোষ। তুমি রাজনীতিতে জড়ালে তার খেসারত দিতে হবে তোমার বাবাকে।

একদিন খাবার টেবিলে মমতাজ আপার গল্প করেছিলো কাবেরী। সে দিন মা অনুমান করেছিলেন, মেয়ে হয়তো রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়তে পারে। তাও আবার শেখ মুজিবের রাজনীতি। সর্বনাশ। সে রাতেই কাবেরীকে সাবধান করেছিলেন তার মা সুমতি মিত্র। বাবা অবশ্য কিছু বলেননি। বরং বাবা মাঝে মাঝে কাবেরীর কাছ থেকে রাজনীতির কথা শুনতেন। মমতাজ আপার দল কতটা শক্তিশালী হচ্ছে সে খবর নিতেন।

মিছিল যাবে সচিবালয়ে। টিএসসিতে এসে ছাত্রদের বিশাল মিছিলের সাথে মিশে গেল কাবেরীদের মিছিল। তবে বেশীদূর এগুতে পারলো না তারা। কার্জন হলের সামনে থাকা পুলিশ বাধা দিলো মিছিলে। শুরু হলো সংঘর্ষ। ছাত্র-ছাত্রীরা মিলে ঢিল ছুড়ছে পুলিশের দিকে। পুলিশ কাঁদুনে গ্যাস  ছুড়ছে। আবার ঢিলও ছুঁড়ছে। কেউ পিছু হটছে না। না মিছিলের লোকেরা, না পুলিশ। বেদম লাটিপিটা চলছে। নির্বিচারে ছাত্রদের পেটাচ্ছে পুলিশ। উর্দুতে কি যেন বলছে পুলিশ । কাবেরী তার বিন্দু-বিসর্গ বুঝতে পারলো না। পায়ের কাছে একটা ইটের টুকরা পেয়ে সেটা ছুড়ে মারলো পুলিশের দিকে। ঢিল ছোঁড়ার কোন অভ্যাস নেই। একেবারে কাছেই পড়লো ঢিলটা। আকেরটি ইটের টুকরা হাতে নিলো।  একটু দূরে সারিবদ্ধ পুলিশের হাতে তাক করা রাইফেল। বেশ ভয়ে পেয়ে গেল কাবেরী, তা হলে কি ওরা গুলি করবে? ইটের টুকরাটা হাত থেকে ছেড়ে দিলো। সামনে পুলিশের দিকে তাকিয়ে আছে সে। ঠিক করতে পারছে না, পেছনে চলে যাবে, নাকি থাকবে? মমতাজ আপাকেও খুজেঁ পাচ্ছে না। ভাবলো মমতাজ আপাকে রেখে চলে যাওয়াটা ঠিক হবে না। পরে দেখা হলে কি জবাব দেবেন আপাকে।

হঠাৎ কাবেরীর চোখ পড়লো একটি ছেলের দিকে। পুলিশ তাকে বেধড়ক পেটাচ্ছে। মাথা ফেটে রক্ত ঝরছে। ওর ভেতরটা হাহাকার করে উঠলো। এভাবে পেটালে তো ছেলেটা মারা যাবে। সাহস করে এগিয়ে গেল সে। যে ভাবেই হোক ওকে পুলিশের পেটানো থেকে বাচিঁয়ে আনতে হবে। তাতে যদি নিজেরও লাঠিপেটা খেতে হয় তো খাবে। জিদ ধরে গেল ওর মনে। কাবেরী নিজেকে প্রশ্ন করলো, আজ যদি ওর আপন কাউকে পুলিশ পেটাতো? আমি কি দাড়িঁয়ে দাড়িঁয়ে দেখতাম?  জবাব পেলো, আমি এগিয়ে যেতাম। বিপদ জেনেও এগিয়ে যেতাম। সামনে দুতিন কদম এগুতেই রক্তঝরা কাপালটা চেপে ধরে দৌড়ে আসলো সে যুবক। চিকৎকার করে উঠলো কাবেরী, অরিত্র তুমি? দ্রুত শাড়ির আচঁল ছিড়ে অরিত্রর মাথার ক্ষতস্থান বেধে দিলো। আরো দুজন ছাত্রের সহাতায় কিছু দূর এসে একটি রিক্সায় অরিত্রকে নিয়ে গেল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। রক্ত বন্ধ হচ্ছে না। কাবেরী ক্ষতস্থান হাত দিয়ে চেপে ধরে রক্ত বন্ধ করার চেষ্টা করছে। পারছে না। ওর শরীরটাও ভিজে যাচ্ছে রক্তে।

  রিক্সাওয়ালা এবং কাবেরী মিলে ওকে নিয়ে গেল ইমার্জেন্সীতে। কাবেরাী পার্স থেকে রিক্সাওয়ালাকে ভাড়া দেওয়ার জন্য টাকা বের করছে। রিক্সাওয়ালা হাত জোড় করে বললো, আপা টাকাটা আপনি ভায়ের ওষুধ কেনার জন্য ব্যয় করুন। আপনারা দেশের জন্য কাজ করছেন, আমাদেরকে জালেমদের হাত থেকে বাচাঁনোর জন্য আন্দোলন করছেন। আমি না হয় একটু গায়ে খেটে দিলাম। পুলিশের লাঠি পেটায় অরিত্রর মাথা ফেটে গেছে। ক্ষতটা বেশ। আটটি সেলাই করতে হলো। অনেক রক্তক্ষরন হয়েছে। ইমার্জেন্সী থেকে, তাকে কেবিনে দিলেন ডাক্তার। মিছিল শুরু হওয়ার আগে মধুর কেন্টিনের সামনে একই সঙ্গে ছিলো অরিত্র ও কাবেরী। দুজন বন্ধু। একই ক্লাসের ছাত্র। অরিত্র মিছিলে যাবে, তা জানে কাবেরী।

(পরবর্তী অংশ পাবেন আগামী কালের সংখ্যায়)