এস এ শফি, সিলেট : দেশের অন্যান্য এলাকার মতো সিলেটেও এবার চামড়া সংগ্রহে ধস দেখা দিয়েছে।
সরকার নির্ধারিত দাম দূরে থাক, নামমাত্র মূল্যেও সংগ্রহ হয়নি কুরবানী হওয়া সকল পশুর চামড়া। সিলেট বিভাগের বেশকিছু এলাকা বন্যা কবলিত হওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাবে সংগ্রহ না করায় তাই কেউ কেউ বাধ্য হয়ে পানিতে ফেলে দিয়েছেন একসময় বৈদেশিক মূদ্রা অর্জনে এগিয়ে অন্যতম শীর্ষ রপ্তানী পণ্য চামড়া।সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে চামড়াজাত পণ্যের দাম কয়েকগুণ বাড়লেও দিন দিন কমছে চামড়ার মূল্য। গেল কয়েক বছর ধরে নায্যমূল্য না পাওয়ায় কুরবানীর পশুর চামড়া পানিতে ফেলতে ও মাটিতে পুতে ফেলতে দেখা গেছে। এবারো সেই পুরনো বৃত্ত থেকে বের হতে পারেনি চামড়া শিল্প। ক্রমাগত লোকসানের দিকে ধাবিত হওয়া এ ব্যবসার আগ্রহ অনেকেই হারিয়ে ফেলছেন।
এ বছর সিলেট জেলায় চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিলো ১ লাখ ২০ হাজার। কিন্তু এবার ৮০ হাজারের মতো সংগ্রহ হয়েছে বলে চামড়া ব্যবসায়ী সূত্রে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সিলেট বিভাগের এবছর ৪ লক্ষাধিক পশু কুরবানী হয়েছে। কিন্তু বিভাগে অর্ধেক পশুর চামড়াও সংগ্রহ হয়েছে কিনা তা নিয়ে সংশয় সিলেটের পাইকারী চামড়া ব্যবসায়ীদের। যদিও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর ও বিসিক সূত্র জানিয়েছে এবছর ছাগল-ভেড়া চামড়া নিয়ে অনাগ্রহ থাকায় সংগ্রহ কম হলেও গরু-মহিষের কোন চামড়া নষ্ট হয়নি। তবে মাঠের পরিস্থিতি অনেকটা বিপরীতমূখী।
ঈদুল আযহার আগের দিন থেকে ভারী বৃষ্টি ও ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলে সিলেট নগরীসহ জেলা, সুনামগঞ্জ ও মৌলভীবাজার জেলাজুড়ে ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি হয়। ফলে নগরীসহ অনেক স্থানে ঈদের দিন কুরবানী দিতে পারেন নি অনেকেই।
একদিকে বন্যা অপরদিকে বৃষ্টি এই দুই কারণে কুরবানী শেষে পশুর চামড়া অনেকের বাড়ীর আঙ্গিনা পড়ে থাকার খবর পাওয়া গেছে। বিনামূল্যেও কেউ চামড়া না নেয়ায় শেষ পর্যন্ত বানের পানিতে ভাসিয়ে দিয়েছেন কেউ কেউ। আবার পরিবেশের কথা চিন্তা করে কেউ কেউ সন্ধ্যার পর মাটিতে পুতে ফেলতে বাধ্য হয়েছেন।
সিলেট নগরী, জেলা শহরের পাশর্^বর্তী উপজেলা সমূহে চামড়ার বাজার মূল্য এবং চাহিদা থাকলেও গ্রাম পর্যায়ের পরিস্থিতি ঠিক এর উল্টো। বিগত সময়ে মাদ্রাসা এবং মৌসুমী ব্যবসায়ীরা চামড়া সংগ্রহ করে থাকলেও এবছর অধিকাংশ মাদ্রাসা যেমন চামড়া সংগ্রহ করেনি আবার অনেক মৌসুমী ব্যবসায়ী চামড়ার ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন। ফলে একদিকে চামড়ার ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত হয়নি, অপরদিকে ভাটা পড়েছে চামড়া সংগ্রহে।
এদিকে ২০২২ সালে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে মাদ্রাসায় সংগ্রহ করা চামড়া সংগ্রহ করা হয়। পরবর্তীতে সেটা বাজারজাত করে অর্জিত টাকা মাদ্রাসার কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেয়া হয়। কিন্তু গতবারের ন্যায় এবারো সিটি কর্পোরেশন থেকে চামড়া সংগ্রহ করা হয়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এবছর ঈদুল আযহায় সিলেট বিভাগে ৩ লাখ ৯৪ হাজার ২৫১ টি পশু কুরবানী হয়েছে। সিলেট জেলায় ১ লাখ ৫০ হাজার ৭০৯টি, সুনামগঞ্জ জেলায় ৫৪ হাজার ৩৬২টি, মৌলভীবাজার জেলায় ৯৮ হাজার ৫৪২ টি এবং হবিগঞ্জ জেলায় এবার কুরবানী হয়েছে ৯০ হাজার ৬৩৮টি পশু। এসবের মাঝে দেড় লাখের অধিক ভেড়া ও ছাগল ছিল। সরকার থেকে দাম নির্ধারণ করা হলেও এবারো চামড়ার ন্যায্যমূল্য মিলেনি। খুচরা বিক্রেতারা একেবারেই কম মূল্যে চামড়া বেচে দিতে বাধ্য হয়েছেন। মাঝারি কিংবা বড় গরুর চামড়া বিক্রি হয়েছে ২০০ থেকে সর্বোচ্চ ৩০০ টাকায়। একইভাবে নামমাত্র দামে বিক্রি হয়েছে ছাগল ও ভেড়ার চামড়া। আবার কিছু স্থানে গরুর চামড়ার সাথে ফ্রি দেয়া হয়েছে ছাগল-ভেড়ার চামড়া। কোথাও কোথাও ছাগলের চামড়া বিক্রি হয়েছে ১০-২০ টাকায়। সব মিলিয়ে হতাশ হয়েছেন পশুর মালিক ও চামড়ার খুচরা ব্যবসায়ীরা।
সিলেটের আড়তদার ও ব্যবসায়ীরা বলেছেন, লবণের দাম বেড়ে যাওয়া, শ্রমিকের মজুরি বেড়ে যাওয়া ও ট্যানারি মালিকদের কাছে বকেয়া থাকায় চামড়া ব্যবসা গভীর সঙ্কটে পড়েছে। এসব কারণেই নির্ধারিত দামের চেয়ে কম দামে চামড়া কিনতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। যদিও ঈদের আগে সরকারিভাবে চামড়ার মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছিল।
এবছর কুরবানী উপলক্ষে গত ৩ জুন চামড়া খাতের একাধিক বাণিজ্য সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে কোরবানি পশুর চামড়ার দর নির্ধারণ করে দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এতে ঢাকায় গরুর প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয় ৫৫-৬০ টাকা, যা গত বছর ছিল ৫০-৫৫ টাকা। ঢাকার বাইরে গরুর প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৫০-৫৫ টাকা, যা গত বছর ছিল ৪৫-৪৮ টাকা। এ ছাড়া খাসির লবণযুক্ত চামড়া ২০-২৫ টাকা এবং বকরির চামড়া ১৮-২০ টাকা নির্ধারণ করা হয়।
সাধারণত বড় আকারের গরুর চামড়া ৩১-৪০ বর্গফুট, মাঝারি আকারের গরুর চামড়া ২১-৩০ এবং ছোট আকারের গরুর চামড়া ১৬-২০ বর্গফুটের হয়। নির্ধারিত দাম অনুযায়ী, ঢাকায় মাঝারি আকারের গরুর ২৫ বর্গফুটের একটি লবণযুক্ত চামড়ার দাম হওয়ার কথা ১ হাজার ৩৭৫ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা। এই হিসাব থেকে লবণ, মজুরি ও অন্যান্য খরচ বাবদ গড়ে ৩০০ টাকা বাদ দিলে ওই চামড়ার আনুমানিক মূল্য দাঁড়ায় ১ হাজার ৭৫ টাকা থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা।
তবে সরকার নির্ধারিত দামে সিলেটে চামড়া বেচাকেনা হয়নি। সংগ্রহ করা চামড়াগুলো কাঁচা। সিলেটের কোথাও ফুট ধরে চামড়া বিক্রি হয়নি। অনুমান করে পশুর সাইজের উপর ভিত্তি করে পিস হিসেবেই চামড়া বিক্রি হয়েছে। সর্বনিম্ন ২০০ থেকে সর্বোচ্চ ৪০০ টাকায় এবার চামড়া বিক্রি হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা।
সিলেটের পাইকারী ব্যবসায়ীরা জানান, গেল কয়েক বছর ধরে রাজধানীর ট্যানারি মালিকদের কাছে সিলেটের বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ীদের অর্ধকোটি টাকার বেশী আটকে আছে। ফলে চামড়া ব্যবসায় সিলেটের অনেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। তবে গত দুই মৌসুম থেকে ট্যানারি মালিকরা অল্প করে বকেয়া পাওনা টাকা পরিশোধ করছেন। এবার কয়েকজন ব্যবসায়ী চামড়া সংগ্রহও করছেন। তবে তা গেল বছরের কম বলে জানান তারা।
ব্যবসায়ীদের মতে, এবার ঈদে সিলেট জেলায় প্রায় ৯০ হাজার গরু-মহিষের চামড়া সংগ্রহ করা হয়েছে। এর মধ্যে সিলেট নগরে চামড়া কিছুটা বেশি দামে ও গ্রামাঞ্চলের চামড়া কম দামে কিনেছেন ব্যবসায়ীরা। এসব চামড়া লবণ দিয়ে প্রক্রিয়াজাত করে গুদামে রাখার ব্যবস্থা করা হয়ছে। ১৫/২০ দিনের মধ্যে সেগুলো ট্যানারি মালিকদের কাছে বিক্রি করা হবে। তবে এবার সুনামগঞ্জ জেলা, সিলেটের বন্যা কবলিত কানাইঘাট, গোয়াইনঘাট, জকিগঞ্জ, জৈন্তাপুর, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা থেকে চামড়া সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। কুরবানী দাতারা চামড়া কি করেছেন সেই তথ্য সিলেটের চামড়া ব্যবসায়ীদের কাছে নেই।
ব্যবসায়ীরা আরো জানান, ঈদের দিন নগরীতে আকস্মিক বন্যা ও ভারী বৃষ্টির কারণে অনেকেই চামড়া বিক্রি করার পরিবর্তে পানিতে ভাসিয়ে দিয়েছেন। কেউ কেউ আবার সিটি কর্পোরেশনের আবর্জনা ডাম্পিংয়ে চামড়া ফেলে দিয়েছেন। এমন খবরও আমরা পেয়েছি। ফলে এবার চামড়া সংগ্রহে ধস নেমেছে।
নগরীর শিবগঞ্জ এলাকার মিলন খান জানান, কুরবানীর চামড়া বিক্রি করে অর্জিত টাকা আল্লাহর রাস্তায় বিলিয়ে দিতাম। কিন্তু দিন দিন চামড়ার কদর কমছে, দান থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন অসহায় মানুষ। এবছর ১ লাখ টাকা দিয়ে কেনা গরুর চামড়া বিক্রি করেছি মাত্র ৩০০ টাকা। এছাড়া এবছর শামীমাবাদের অধিকাংশ এলাকা পানিতে নিমজ্জিত থাকায় বিভিন্ন সময়ে কুরবানী হয়েছে। ফলে অনেকের চামড়া দীর্ঘক্ষণ বাসার ছাদে রেখে শেষ পর্যন্ত পানিতে ফেলে দেয়ার খবরও পেয়েছি।
তিনি বলেন, আজ থেকে ১০ বছর আগেও যে চামড়া ১২০০-১৫০০ টাকায় বিক্রি হতো এখন সেটি ২৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ছাগলের চামড়া ব্যবসায়ীরা নিতেই চান না। সেগুলো বিনামূল্যে দিয়ে দিতে হয়।
সিলেটে কুরবানী দেয়া এমন কয়েকজনের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, তারা আগে কুরবানির পশুর চামড়া মাদ্রাসায় দান করতেন না হয় বিক্রি করে দিতেন। সেই টাকা মাদ্রাসার ইয়াতিম খানায় দান করতেন। চামড়ার দাম ক্রমাগত কমতে থাকায় অনেকে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ চামড়া সংগ্রহ ছেড়ে দিয়েছেন। নামমাত্র কয়েকটি মাদ্রাসা চামড়া সংগ্রহ করলেও এভাবে দাম কমতে থাকলে, তারাও চামড়া সংগ্রহ বাদ দিতে বাধ্য হবে।
দক্ষিণ সুরমা উপজেলার চামড়া সংগ্রহকারী একাধিক মুচি জানান, চামড়ার বাজার আগের মত নাই। তাই আমরা এখন চামড়া ক্রয় করিনা। কারণ ১ কেজি লবনের দাম এখন ৫০ টাকা। একটি চামড়ায় সর্বনিম্ব ৫ থেকে সর্বোচ্চ ৮ কেজি লবণ লাগে। আর আমরা লবনজাত চামড়া ছাড়া কাচা চামড়া বিক্রি করতে পারিনা। একটি চামড়ায় ২ থেকে ৩০০ টাকার লবণ লাগে। চামড়া কিনে লবণ দিয়ে আমাদের লাভ দুরে থাক লোকসান দিতে হবে। তাই আমরা এলাকার মানুষদের বলেছি পানিতে না ফেলে কিংবা মাটিতে না পুতে আমাদেরকে বিনামূল্যে দিয়ে দিন। আমরা যদি কিছু পাই তাহলে আমাদের আয়ের একটা পথ হবে। আর এলাকার মানুষ আমাদেরকে চামড়া ফ্রি দিয়েছে।
সিলেটের শাহজালাল চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সহ-সভাপতি শাহীন আহমদ বলেন, এবছর সিলেট জেলায় ৮০ হাজারের মতো চামড়া সংগ্রহ হয়েছে। সাইজভেদে প্রতি পিস চামড়া ২০০ থেকে সর্বোচ্চ ৪০০ টাকা পর্যন্ত চামড়া বিক্রি হয়েছে। ছাগল-ভেড়ার চামড়ার বাজার দর কম থাকায় এসবে আগ্রহ কম ছিল। তাই নামমাত্র দরে কেউ কেউ এই চামড়া সংগ্রহ করেছেন।
তিনি বলেন, কাচা চামড়া সংগ্রহ করতে গড়ে ৪০০ টাকা খরচ হয়েছে। এরপর সেই চামড়ায় লবণ দেয়া ও পরিবহন খরচ হিসেব করলে চামড়া প্রতি আরো ৩০০ টাকার উপর খরচ হয়ে যায়। ঢাকায় ট্যানারি মালিকদেরকে চামড়া বুঝিয়ে দেয়া পর্যন্ত শুধু খরচ ৪০০টাকায় পৌছে যায়। সব মিলিয়ে একটি চামড়ায় গড়ে ৭ থেকে ৮০০ টাকা খরচ হয়ে যায়।
সিলেটের শাহজালাল চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক এসএম শাহজাহান বলেন, এবার গত বছরের অর্ধেক চামড়া সংগ্রহ হয়েছে। কারণ সিলেটের অধিকাংশ উপজেলা বন্যায় প্লাবিত হওয়ায় সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। নৌ পথে খরচ বেশী এবং অনেক সময় লাগে তাই অনেক মৌসুমী ব্যবসায়ী চামড়া সংগ্রহ করেনি।
তিনি বলেন, আরেকটি কারণ হচ্ছে আমাদের হাতে পর্যাপ্ত টাকা নেই। ঢাকায় ট্যানারী মালিকদের কাছে আমাদের বকেয়া টাকা পাওনা রয়েছে। সবকিছুর দাম বাড়ছে, লবণের দামও বেড়েছে। কিন্তু আমাদের মূলধন তেমন বাড়ছেনা।
আমরা লবণ দিয়ে সর্বোচ্চ ৩ মাস পর্যন্ত চামড়া রাখতে পারি। এরপর আমাদেরকে ট্যানারী মালিকদের কাছে যেতে হবে। কিন্তু ট্যানারী মালিকগণ প্রতি বছর বকেয়া রাখে। গত ৬/৭ বছর থেকে ট্যানারী মালিকগণ আমাদেরকে নগদ পরিশোধ না করায় আমাদের পুজি ক্রমশ কমছে। অনেকেই চামড়া ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছে।
খালিদ সাইফুল, দৈনিক দেশতথ্য, ২২ জুন২০২৪