এস এ শফি, সিলেট : ভারত থেকে নেমে আসা উজানের ঢল ও টানা বৃষ্টিতে সিলেটে বন্যা ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে। সীমান্তবর্তী ছয় উপজেলাসহ আটটিতে বন্যা দেখা দিয়েছে। এতে পানিবন্দি অবস্থায় আছেন ৬ লাখ ৪৩ হাজার ৪৭০ জন মানুষ।প্লাবিত হয়েছে সুরমা নদী তীরবর্তী সিলেট নগরীর নিম্নাঞ্চলও। এতে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে অন্তত ৪ হাজার পরিবার।
শুক্রবার বিকাল পর্যন্ত সিলেটে পানিবন্দি ও আশ্রয়কেন্দ্রে ওঠা লোকজনের সংখ্যা বেড়েছে বলে জেলা প্রশাসন থেকে জানানো হয়।
সিলেটের জেলা প্রশাসক শেখ রাসেল হাসান স্বাক্ষরিত বন্যা পরিস্থিতির সার্বিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জেলার ১৩টি উপজেলায় বন্যা প্রস্তুতি হিসেবে আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে ৫৪৭টি। বন্যা কবলিত আট উপজেলার আশ্রয়কেন্দ্রে ৩ হাজার ৭৩৯ জন মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন।
ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে ভারতের মেঘালয় ও আসামের পাহাড়ি এলাকায় টানা ভারি বৃষ্টিপাত হয়। ফলে সীমান্তের ওপার থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে বন্যা দেখা দেয় সিলেটের গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, জৈন্তাপুর, কানাইঘাট, জকিগঞ্জ, বিয়ানীবাজার ও গোলাপগঞ্জ উপজেলায়।
শুক্রবার নতুন করে প্লাবিত হয় সিলেট সদর উপজেলা। এদিন বিকালে সরেজমিনে সিলেট নগরীর তালতলা, যতরপুর, মাছিমপুর ও উপশহরের রাস্তাঘাটে পানি দেখা গেছে। ময়লা পানি মাড়িয়ে নগরবাসীকে চলাচল করতে দেখা গেছে। তবে বেশি প্লাবিত হয়েছে উপশহরের কয়েকটি ব্লক।
শুক্রকার সন্ধ্যায় সিলেট সিটি করপোরেশনের জনসংয়োগ কর্মকর্তা সাজলু লস্কর স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, “বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে দিনভর কর্মতৎপর ছিলেন সিলেট সিটি কর্পোরেশনের ভারপ্রাপ্ত মেয়র, কাউন্সিলর ও কর্মকর্তারা। শুক্রবার সকাল থেকে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় বন্যা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন তারা।
পানিবন্দি মানুষের জন্য ওয়ার্ডে-ওয়ার্ডে আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত করা হচ্ছে জানিয়ে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “নগরীর ১৫নং ওয়ার্ডের কিশোরী মোহন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ও পাশ্ববর্তী একটি পাঁচ তলা খালি বিল্ডিংয়ে একই ওয়ার্ডের মতিন মিয়ার কলোনির ৪০টি পরিবার আশ্রয় নিয়েছেন।”
জনসংযোগ কর্মকর্তা সাজলু লস্কর বলেন, “বিভিন্ন কাউন্সিলরদের দেয়া তথ্যমতে ইতিমধ্যে নগরীতে বন্যায় আক্রান্ত হয়েছেন ৪ হাজার পরিবার। তাদের পর্যাপ্ত পরিমাণ শুকনো খাবার পাঠানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করছে সিসিক।
এদিন বিকাল সাড়ে ৪টায় নগরীর ১৫, ২২ ও ২৪নং ওয়ার্ডের, সুবহানীঘাট, উপশহর, তেররতন এলাকা পরিদর্শন করেন ভারপ্রাপ্ত মেয়র মো. মখলিছুর রহমান কামরান, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী, স্থানীয় কাউন্সিলর শাহানা বেগম শানু, ২২ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর ফজলে রাব্বি চৌধুরী মাসুম, ২৪ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর হুমায়ুন কবির সুহিন, জনসংযোগ কর্মকর্তা সাজলু লস্কর।
এ সময় ভারপ্রাপ্ত মেয়র মখলিছুর রহমান কামরান বলেন, “উজান থেকে নেমে আসা ঢল আর টানা বৃষ্টির কারণে সিলেটের নদ নদীর পানির বেড়ে ইতিমধ্যে সিলেটের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। বন্যার পানি শহরের দিকে ধেয়ে আসছে।
“সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী তত্ত্বাবধানে সংকট মোকাবেলা করতে পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে।”
এর আগে বন্যা পরিস্থিতি মোকবেলায় বৃহস্পতিবার জরুরি সভা করে সিলেট সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ। সভায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছুটি বাতিল করে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ বলেন, “শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত সিলেটের সুরমা-কুশিয়ারা নদীর তিনটি পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর মধ্যে সুরমা সিলেট শহর পয়েন্টে বিপৎসীমার ৪ সেন্টিমিটার, কানাইঘাট পয়েন্টে ৯২ সেন্টিমিটার।
কুশিয়ারা জকিগঞ্জ পয়েন্টে বিদৎসীমার দুই সেন্টিমিটার উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। আর সিলেটের অন্য নদীগুলোর পানি বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
জেলা প্রশাসনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বন্যায় সবচেয়ে বেশি পানিবন্দি হয়েছেন গোয়াইনঘাট উপজেলায় ২ লাখ ৪৫ হাজার ৭৫০ জন। উপজেলার ১৩টি ইউনিয়নই বন্যা কবলিত হয়েছে। আর ৫৬টি আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন ১ হাজার ২৪২ জন।
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নের মধ্যে তিনটি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়ে পানিবন্দি হয়েছেন ৯৩ হাজার মানুষ। উপজেলায় ৩৫টি আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন ৭৩ জন মানুষ।
কানাইঘাট উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের মধ্যে নয়টি প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি হয়েছেন ৮০ হাজার ৬০০ মানুষ। ৩১টি আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন ১ হাজার ৪৭৬ জন।
জৈন্তাপুর উপজেলার তিনটি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়ে ৬৫ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়েছেন। এ উপজেলায় আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে ৪৮টি। সেখানে ৬৭৫ জন মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন।
জকিগঞ্জ উপজেলায় নয়টি ইউনিয়নের মধ্যে আটটি প্লাবিত হয়ে পানিবন্দি হয়েছেন ১ লাখ ৪৮ হাজার ৫০০ জন। উপজেলার ৫৫টি আশ্রয়কেন্দ্রের মধ্যে আশ্রয় নিয়েছেন ১৯৮ জন।
বিয়ানীবাজার উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের মধ্যে পাঁচটিতে বন্যা হয়েছে; এখানে পানিবন্দি হয়েছেন ৫ হাজার ৫০০ মানুষ। আশ্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা ৬৭টি; আশ্রয় নিয়েছেন ৬০ জন।
গোলাপগঞ্জ উপজেলার ১১টি ইউনিয়নের মধ্যে মাত্র একটি ইউনিয়নে বন্যা কবলিত হয়েছেন ৩ হাজার ৫০০ মানুষ। উপজেলায় ৫৭টি আশ্রয়কেন্দ্রের মধ্যে ১৫ জন আশ্রয় নিয়েছেন।
নতুন করে প্লাবিত সিলেট সদর উপজেলার সাতটি ইউনিয়নের মধ্যে ছয়টি বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি রয়েছেন ১ হাজার ৬২০ জন। এই উপজেলায় আশ্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা ২৯টি; এখনও কেউ আশ্রয় নেয়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর, কোম্পানীগঞ্জ, কানাইঘাট ও জকিগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন এলাকাতেও পানি কমতে শুরু করেছে।
দুয়েকদিন ধরে ডুবে থাকা গোয়াইনঘাট-সালুটিকর সড়ক এবং গোয়াইনঘাট-জাফলং সড়ক থেকে পানি নেমেছে। দুটি সড়কে বন্যার ক্ষত দৃশ্যমান হয়েছে। সড়ক দুটোর কয়েকটি স্থানে খানাখন্দ আর গর্ত তৈরি হয়েছে। তাছাড়া উপজেলাগুলোর কৃষক, মৎস্য চাষিরাও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন।
সড়ক ও জনপথ কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী আমির হোসেন ও এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী কে. এম. ফারুক হোসেন জানান, রাস্তা-ঘাটের কি পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা এখনও নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি। ঘোয়াইনঘাটে পানি কমেছে সেখান থেকে আমরা কাজ শুরু করব।
সিলেট জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোহাম্মদ খয়ের উদ্দিন মোল্লা বলেন, বন্যায় কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, সেটা এখন নির্ধারণ করা কঠিন। পানি নেমে গেলেই এ ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সঠিকভাবে নিরূপণ করা সম্ভব হবে। তবে প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী, জেলার গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, জৈন্তাপুর, কানাইঘাট ও জকিগঞ্জে মোট ৫ হাজার ৬০১ হেক্টর আউশ ধান, আউশ বীজতলা ও সবজিক্ষেত কমবেশি প্লাবিত হয়েছে। এর মধ্যে আউশ ধানের জমি রয়েছে ১ হাজার ৬৮২ হেক্টর, আউশ বীজতলা ৯২৭ হেক্টর ও সবজিক্ষেত ২ হাজার ৯৯২ হেক্টর রয়েছে।
জেলা মৎস্য অফিসে সিনিয়র সহকারী পরিচালক সীমা রাণী বিশ্বাস জানান, কি পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সেটি নির্ধারণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে গোয়াইনঘাট উপজেলার তথ্য পাওয়া গেছে, এ উপজেলায় মোট ১ হাজার ৬০০ জন মৎস্য চাষি রয়েছেন। এখানে পুকুর ও খামারের সংখ্যা ২০ হাজার। এসব খামারের মাছ ও মাছের পোনা ভেসে গিয়ে ৭৪৪ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে।
জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, জেলার জৈন্তাপুর,গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, কানাইঘাট ও জকিগঞ্জ উপজেলায় বেশি প্লাবিত হয়েছে। এ ছাড়া বিয়ানীবাজার ও গোলাপগঞ্জ উপজেলার কিছু গ্রামও প্লাবিত হয়েছে। জেলার ৭টি উপজেলার ৪২টি ইউনিয়নে বন্যাকবলিত হয়েছেন ৫ লাখ ৩৩ হাজার ২০২ জন বাসিন্দা। এ পরিস্থিতিতে জেলার ১৩টি উপজেলায় ৫৪৭টি আশ্রয়কেন্দ্র চালু হয়েছে। পানিবন্দীদের মধ্য ৪ হাজার ৮০২ জন আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন।
এ ব্যাপারে সিলেটের জেলা প্রশাসক শেখ রাসেল হাসান বলেন, নতুন করে বৃষ্টি না হওয়ায় বন্যাকবলিত এলাকাগুলোর পানি কমতে শুরু করেছে। আর যদি বৃষ্টিপাত না হয় তাহলে পরিস্থিতির আরো উন্নত হবে। যারা আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করছেন তাদের শুকনা ও রান্না করা খাবার এবং বিশুদ্ধ পানি বিতরণ কার্যক্রম চলমান আছে।
এ ছাড়া বন্যার্তদের স্বাস্থ্যসেবা দিতে ইউনিয়নভিত্তিক মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। এছাড়াও যারা পানিবন্দী অবস্থায় নিজ বাড়িতে অবস্থান করছেন তাদের জন্য বিশুদ্ধ পানি ও শুকনো খাবারের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যেই জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে শুকনা খাবার, চাল ও নগদ টাকা ত্রাণসামগ্রী উপজেলাসমূহে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
খালিদ সাইফুল, দৈনিক দেশতথ্য,১ জুন ২০২৪

Discussion about this post