সুইজারল্যান্ড থেকে রহমান মৃধা:
মনে পড়ে কি, জনপ্রিয় কন্ঠশিল্পি মান্নাদের সেই গান, ‘ঝরনা কেমনে হয় নদী, সাগর না ডাকে কভু যদি, তাই যেতে যেতে থামলো সে বয়ে চললো না’ – এ কথার মিল পাওয়া গেল দেখে সুইজারল্যান্ডের উচু পাহাড় থেকে ঝর্ণা যখন জমে জমে ছোট বড় লেকে পরিণত হয়ে আছে।
লিন্ডট লেক (Lindt lake) তারই একটা জলন্ত উদাহরণ। তাছাড়াও অনেক ছোট বড় লেকে ভরা সুইজারল্যান্ড। যা দেখলে সত্যি মন ভরে যায়।
এই লিন্ডট লেকের নামে নামকরণ করা হয়েছে বিশ্ব বিখ্যাত সুইজ চকলেট যা কে না খেয়েছে? লিন্ডট চকলেট ছাড়াও কিন্তু তাদের আরেকটি চকলেট রয়েছে যা মূলত ডোমেস্টিক এবং বিশেষভাবে অর্ডার দিয়ে কেনা সম্ভব। স্প্রুংলি চকলেট সুইজারল্যান্ডের প্রিমিয়াম চকলেট নামে পরিচিত।
সুইজারল্যান্ডের পাহাড় উঁচু হওয়ায় এর মাথায় মেঘ আটকে যায়। পরবর্তীতে সেই মেঘ গলে ঝর্ণা হয়ে নেমে আসে নিচে এবং কখনও সে ঝরণা গিয়ে মেশে নদীতে এবং শেষে সাগরে।
![](https://dailydeshtottoh.com/wp-content/uploads/2024/04/IMG_20240401_154611-1160x598.jpg)
মজার ঘটনা হলো ইউরোপের সবচেয়ে বড় নদী যার নাম রাইনরিভার (Rhein river)। এই নদীটি বয়ে চলেছে ইউরোপের নানাদেশের মধ্য দিয়ে। তার মধ্যে সুইজারল্যান্ড অন্যতম।
রাইনরিভার যেতে যেতে জুরিখের অদুরে এসে হঠাৎ ঢলে পড়ে প্রকৃতিকে আরো সুন্দর করে তুলেছে।
মূলত সেই সৌন্দর্যের আকর্ষনেই আমি, মারিয়া এবং হেলেনা এসেছিলাম রাইনফল দেখতে। পুরো দিনটাই কেটেছিল মনোমুগ্ধকর পরিবেশে। সারাদিন ছবি তোলা, ভিডিও করা এবং মুহূর্তটির বর্ণনা করা, সে যেন ছিল আমার জন্য দায়িত্ব। এ ছিল নতুন প্রজন্মকে অনুপ্রেরণা যোগানোর এক দায়। কেউ আমাকে এ কাজটি করতে অনুরোধ করেনি, যা কিছু করেছি হৃদয় দিয়ে ভালোবাসা থেকে। দিনটি হবে বহু বছরের জন্য এক মধুময় স্মরণীয় ঘটনা যা বয়ে চলবে আমার বাকি জীবনে।
সুইজারল্যান্ডের পাহাড়ের সৌন্দর্য যা শুধু মনোমুগ্ধকর দৃশ্য নয় যেন পৃথিবীর প্যারাডাইস। পাহাড়ের গায়ে মস্তবড় একখানি মেঘ জমা বেঁধেছে। দূর থেকে মনে হলো মেঘ তো নয় আরেক সাদা পাহাড়, আস্তে আস্তে পাহাড়ের ওপরে উঠতে পথে আমি নিজেই অদৃশ্য হয়ে গেলাম। কোনো এক সময় মারিয়া এবং হেলেনারও দেখা নেই। আমরা সবাই হারিয়ে গেছি মেঘের আড়ালে। বেশ মনে পড়তে লাগলো মেঘের আড়ালে সূর্য হাসে কথাটি। আমরা সবাই কিছুক্ষণের মধ্যেই ভিজে গেলাম। কী আর করা, নিচের দিকে নেমে শেষে একটি কান্ট্রি ক্লাবে ঢুকে গেলাম। সেখানে দেখি গ্রামের সকল মুরব্বি জমা হয়েছে।
তারা নানা ধরনের এক্টিভিটির সঙ্গে জড়িত, কেও খেলছে তাস, কেও খেলছে বিঙ্গ লট্টো, কেও নিউজপেপার হাতে নিয়ে উঁকিঝুঁকি মেরে আমাদের দেখছে। আমরা বাথরুমে গিয়ে ভেজা কাপড় পাল্টে শুকনো কাপড় পরে গাড়িতে করে নিচের দিকে নামতে শুরু করলাম।
সুইজারল্যান্ডের গ্রামের মানুষের মহানুভবতা দেখে মনে পড়ে গেল আমার ছোটবেলার স্মৃতি। আমরা যখন ভিনদেশি কাউকে দেখেছি গ্রামে, তাকে ঘিরে কতই না রহস্যে মগ্ন হয়েছি। ভদ্রতা বা শালীনতার কোনো অভাব কিন্তু তখন ছিল না। গ্রামের মানুষ বিশ্বের সবখানেই দয়াময় হয় যা সুইজাল্যান্ডেও দেখলাম।
সুইজারল্যান্ড দেশটি কিন্তু আয়তনে বাংলাদেশের অর্ধেক হবে, তার মধ্যে ৪০% ই বড় বড় পাহাড়। পাহাড়ের মাঝখানে ছোট বড় লেক, লেক ভরা পানি, পানি তো নয় যেন অমৃত। দেশটির চারপাশ দিয়ে ইউরোপের অন্যান্য দেশ এবং সে সকল দেশের ভাষা, কালচার, ট্র্যাডিশন জুড়ে পুরো দেশটি, তারপরও কী সুন্দরভাবে সাজিয়ে গুছিয়ে নিজেদের মতো করে বসবাসের উপযোগী করেছে যা দেখলে মন সত্যিই ভরে যায়।
কোনো বর্ডার গার্ড নেই, কেউ দেশের সম্পদ পাচার করে দেশটাকে দেউলিয়া করে ফেলছে না। বরং দেখে মনে হলো যেন বিশ্বমেলা বসেছে, কোন অংশ কত সুন্দর এবং কে কত উন্নত সেটাই দেখাতে তারা ব্যস্ত। তাছাড়া ফ্রান্স, জার্মানি, ইটালি এবং অস্ট্রিয়ার সকল দিক ঘুরে দেখে মনে হলো প্রত্যেকেই যার যার দিক থেকে সেরাদের মধ্যে সেরা। কী চমৎকার পরিবেশ, তারপর প্রকৃতিও মাশাআল্লাহ রূপে-গুণে ভরপুর।
এতকিছুর মধ্যে মজার জিনিস যেটা সেটা ছিল এখানেও ফ্রান্সের মোনাকোর মতো ছোট একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ রয়েছে যার নাম লিচটেনস্টাইন (Liechtenstein) এবং দেশটির রাজধানীর নাম ভেদাস (Vedus )। দেশটির অফিসিয়াল ভাষা জার্মান। দেশটির মোট লোকসংখ্যা প্রায় ৪০ হাজার, এবং এর ৬৭% লিচটেনস্টাইনি, বাকি ১০% সুইজারল্যান্ড্যার, ৫.৭% অস্ট্রিয়ান, ৩.৪% জার্মান, ৯.৯% ইতালীয় এবং অন্যান্য।
এছাড়াও প্রায় ২০ হাজার বিদেশি প্রতিদিন কাজের সুবাদে আশপাশের দেশ থেকে আসা যাওয়া করে। পুরো সুইজারল্যান্ড সত্যি একটি অপূর্ব সুন্দর দেশ তবে জিনিসপত্রের দাম খুব চড়া। এদের কাছে তেমন চড়া বলে মনে হলো না। কারণ সবারই ভালো বেতন, কিন্তু আমরা যারা ট্যুরিস্ট আমাদের পক্ষে এখানে বেশিদিন থাকা সম্ভব না। তারপর ছুটিও শেষ অতএব আগামীকাল দুপুরে সুইডেনের উদ্দেশ্যে আমাদেরকে রওনা দিতে হবে।
সুইজারল্যান্ড ভ্রমণের চতুর্থ দিনে হেলেনা সিদ্ধান্ত নিয়েছে আমাদেরকে মূসহা (Moosach, Switzerland) নিয়ে যাবে। এক ঘন্টা ত্রিশ মিনিটের গাড়ি ভ্রমণ বটে, তবে চোখ বন্ধ করার কোনো উপায় ছিল না। পর্বতের পর পর্বত তারপর পাহাড় থেকে ঝর্ণা বয়ে যে পরিষ্কার পানি গড়িয়ে নিচে জমা হয়েছে তা দেখলেই কিন্তু মন ভরে যায়। তারপর কী চমৎকার পাহাড়ের দৃশ্য যা শুধু মন ভরানো সৌন্দর্য নয়, যেন পৃথিবীর প্যারাডাইস।
এবি//দৈনিক দেশতথ্য //মার্চ ৩১, ২০২৪//
![প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন](http://dailydeshtottoh.com/wp-content/plugins/wp-print/images/printer_famfamfam.gif)
Discussion about this post