ওপেলিয়া কনি, কুষ্টিয়াঃ কুষ্টিয়া জেলার ভেড়ামারা পৌরসভার সাবেক মহিলা কাউন্সিলর মোছাঃ রেনু খাতুনের সাথে গত ১৫ অক্টোবর অদ্ভুত রকমের এক ঘটনা ঘটে। তিনি অফিসিয়াল কাজকর্ম সেরে বাজার থেকে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলে পথিমধ্যে পেছন থেকে আনুমানিক ২০-২২ বছরের একটি ছেলে আন্টি সম্বোধন করে সালাম দিয়ে কথা বলা শুরু করে এবং তাকে জানায় যে তারা ব্যবসায়িক কাজে আড়াই বছর যাবৎ ভেড়ামারাতে অবস্থান করছে এবং তাদের স্থায়ী বাড়ি যশোর জেলায়। ইতিমধ্যে আরও একজন এসে দাঁড়ায় ঠিক তার সামনেই, মাত্র ২/৩ কথা বলতেই কি যেনো হয়ে যায় রেনু খাতুনের। এরপর ওই যুবকগুলি যা বলছে যেদিকে যাচ্ছে তিনিও ঠিক তাদের সাথে তাই করছেন। কিছুদূর যাওয়ার পর আরও একজন মাঝবয়সী লোক এসে যুক্ত হন তাদের সাথে।
রেনু খাতুন বলছিলেন, ” আমার সাথে ঘটে যাওয়া ব্যাপারটা খুবই অদ্ভুত রকমের ভয়ংকর। মাত্র কয়েক মিনিট কথা বলার পরেই আমার কি যেনো হলো নিজস্ব কোনো বুদ্ধিই তখন কাজ করছিলো না আমার। ওদের কথা মতো আমি প্রথমে আমার আংটি তারপর কানের দুল নিজেই খুলে দিই। গলার চেইনটি নিজে খুলতে না পারায় ওদের মধ্যের একটি ছেলে আমার চেইনটি খুলে নেয় এবং ব্যাগের ভিতরে থাকা টাকাগুলোও নিয়ে নেয়।তারপর তারা তিনজনই হাঁটতে থাকে। আমিও তাদের পিছু পিছু কিছুদূর যায় কিন্তু হঠাৎ করেই তারা তাদের হাটার গতি বাড়িয়ে দেয় এবং তিনজনই মুহূর্তের মধ্যে উধাও হয়ে যায়। এর প্রায় মিনিট পনের পর আমার নিজস্ব হিতাহিত জ্ঞান ফিরলে আমি চিৎকার করে কান্নাকাটি করায় স্থানীয় লোকজন আমাকে আমার ভাইয়ের বাড়িতে পৌঁছায়ে দিয়ে যায়। কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার পর আমার মেয়ে ও ভাই আমাকে নিয়ে ভেড়ামারা থানায় যায় এবং একটি আবেদন জমা দিই। ভেড়ামারা থানার ওসি তৎক্ষনাৎ দুইজন ডিউটি অফিসার কে পাঠান এবং তারা আমাকে সাথে নিয়ে সিসিটিভি ফুটেজ গুলো চেক করে কিন্তু সেগুলোতে ওই ছেলেগুলো যখন আমাকে বাজারের মধ্যে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছিল সেই ফুটেজগুলো দেখা গেলেও তাদের চেহারা অস্পষ্ট দেখাচ্ছিল। তবে তাদের চেহারা দেখলে আমি চিনতে পারবো। ওরা আমার প্রায় ১,৬৫,৯০০ টাকার পরিহিত স্বর্ণালঙ্কার নিয়ে গেছে। আমি এই দুষ্কৃতকারীদের অনতিবিলম্বে গ্রেফতার করে আমার জিনিস গুলো ফেরত চায় এবং আর কেউ যেনো এই রকমের ভয়ংকর প্রতারণার শিকার না হয় তাই তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির জোর দাবি জানাচ্ছি।”
গত মার্চ ও সেপ্টেম্বর মাসেও একই ঘটনা ঘটে কুষ্টিয়া শহরে। কুষ্টিয়া শহরের প্রানকেন্দ্র লাভলী টাওয়ারে এক ব্যাংক কর্মকর্তার স্ত্রীকে স্কোপোলামিন ব্যবহার করে সাথে থাকা টাকা ও স্বর্ণালংকার ছিনিয়ে নিয়ে পালিয়ে যায় অপরাধীরা। এ ঘটনায় কুষ্টিয়া মডেল থানায় ভুক্তভোগী গৃহবধুর স্বামী একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করলেও পুলিশের পক্ষ থেকে নেয়া হয়নি তেমন কোনো উল্লেখিত উদ্যোগ ।
রেনু খাতুন যে তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনেকেই এমন ঘটনার শিকার হচ্ছেন। এর পেছনে কারণ হিসেবে উঠে আসছে স্কোপোলামিন নামক একটি ড্রাগের কথা।
এই স্কোপোলামিন তরল কিংবা পাউডার দুই ধরনেই পাওয়া যায়। অপরাধের ক্ষেত্রে এই ড্রাগ কাগজ, টাকা, কাপড়, হাত এমনকি মোবাইলের স্ক্রিনে লাগিয়েও এর ঘ্রাণ দিয়ে কিছু সময়ের জন্য যে কারো মানসিক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়া সম্ভব হয়।
স্কোপোলামিন মূলত একটি সিনথেটিক ড্রাগ। চিকিৎসা বিজ্ঞানে ওষুধ তৈরিতে এর ব্যবহার আছে। বমি বমি ভাব, মোশন সিকনেস এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে অপারেশন পরবর্তী রোগীর জন্য ওষুধে এর ব্যবহার আছে।
তবে এটা প্রাকৃতিক কোনো উপাদান নয়। বরং প্রাকৃতিক উপাদানের সঙ্গে আরো কিছু যোগ করে কৃত্রিমভাবে স্কোপোলামিন তৈরি করা হয়। এটা তরল এবং পাউডার দুই রূপেই পাওয়া যায়।
তবে এর গুরুত্বপূর্ণ বা মূল উপাদান আসে ধুতরা ফল থেকে।
বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে একটি বেসরকারি বিশ্ববদ্যিালয়ের শিক্ষক হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। সেই হত্যার ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ একজনকে গ্রেপ্তার করেছিলো। পরে আরো একজনকে ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করে।
এদের মধ্যে একজনের কাছে প্রথমবারের মতো স্কোপোলামিন পাওয়ার কথা জানায় পুলিশসূত্র।
বোতলের ভেতর সাদা পাউডার আকারে কয়েক গ্রাম স্কোপোলামিনসহ আরো কয়েক ধরনের মাদক জব্দ করা হয়েছিল সেসময়।
পরে আদালতের আদেশ নিয়ে সিআইডি’র ল্যাবে টেস্ট করার পর সেখানে স্কোপোলামিন প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে শনাক্ত হয়। বর্তমানে এর ভয়াবহ অপব্যবহার শুরু হয়েছে সমগ্র দেশেই। অভিনব কায়দায় দুষ্কৃতিকারীরা এই স্কোপোলামিন ব্যবহার করে বিভিন্ন বয়সী মানুষের সাথে ভয়ংকর প্রতারণা করছে। ছিনিয়ে নিচ্ছে তাদের সর্বস্ব। তবে মধ্যবয়সী নারীরাই তাদের টার্গেটের প্রথম সারিতে থাকে।
বাংলাদেশে শুরুতে ঢাকায় পাওয়া গেলেও বর্তমানে স্কোপোলামিন ব্যবহার করে প্রতারণার বিভিন্ন অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে জেলা ও থানা শহরগুলোতেও।
যদিও এমন ঘটনার নির্দিষ্ট তেমন কোনো পরিসংখ্যান নেই পুলিশের কাছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে কীভাবে এই ভয়ংকর স্কোপোলামিনের অপব্যবহার দিন দিন বেড়েই চলেছে সেটিও একটা বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে বর্তমান প্রেক্ষাপটে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দ্রুত এই বিষয়ে কঠোর নজরদারি এবং জরুরী পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে এর ভয়াবহতা কল্পনাতীতভাবে আরও বেড়ে যাবে যার ফলে সাধারণ মানুষ প্রতারিত হয়ে নিঃস্ব হবে এমনকি প্রাণনাশেরও শংকা বৃদ্ধি পেতে পারে।
Discussion about this post