মো.আলাউদ্দীন, হাটহাজারীঃ
হাটহাজারী পৌরসদর এলাকার বিভিন্ন সড়কে প্রায় সময় একটি ব্যতিক্রমী অটোরিকশা চোঁখে পড়ে।
রিকশাটির গায়ে বড় বড় অক্ষরে লেখা, ‘অসহায় রোগীদের জন্য ফ্রি সার্ভিস, টাকা নয় দোয়া চাই, রিকশা চালক এনাম ভাই।’ আবার নিচে দেওয়া আছে যোগাযোগের জন্য মোবাইল নম্বরও। এই রিকশার চালক এনামুল হক এনাম (৩২), যিনি নিজের জীবনের কষ্ট থেকে শিক্ষা নিয়ে মানবতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
হাটহাজারী পৌরসভার ৩ নং ওয়ার্ডস্থ পূর্ব দেওয়ান নগর এলাকার শায়েস্তা খাঁ পাড়ার অছি মিস্ত্রি বাড়ীর মৃত সিরাজুল হকের পুত্র এনামুল হক এনাম। তিন ভাই ও দুই বোনের মধ্যে এনাম সবার বড়। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করার পর অভাবের তাড়নায় আর লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া হয়নি। সাংসারিক জীবনে তিনি এক পুত্র সন্তানের জনক। নিজ বাড়ি শায়েস্তা খাঁ পাড়ায় হলেও সেখানে জায়গা না হওয়ায় বিয়ের পর থেকে প্রায় নয় বছর ধরে পরিবার নিয়ে থাকছেন পৌরসভার ফটিকা ইউনিয়নের কড়িযার দিঘীর পাড় এলাকার একটি ভাড়া বাসায়।
এনামের এই মহৎ উদ্যোগের পেছনে রয়েছে এক করুণ গল্প। প্রায় দুই বছর আগে, এনাম নিজেই গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। চিকিৎসার জন্য তাকে যেতে হয় হাটহাজারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। চিকিৎসা শেষে বাসায় ফেরার সময় তার কাছে কোনো রিকশা ভাড়া ছিল না। অনেক রিকশাওয়ালাকে অনুরোধ করেও তিনি সাহায্য পাননি। অসুস্থ শরীর নিয়ে, পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরতে হয়েছিল তাকে। সেই দিনের কষ্ট আর অপমান এনামকে গভীরভাবে নাড়া দেয়। তখনই তিনি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেন, সুস্থ হয়ে ওঠার পর তিনি অসহায়, অসুস্থ রোগীদের বিনামূল্যে হাসপাতালে পৌঁছে দেবেন।
প্রতিজ্ঞা অনুযায়ী, সুস্থ হয়ে এনাম তার অটোরিকশা নিয়ে নেমে পড়েন মানবতার সেবায়। গত এক বছরে তিনি প্রায় ৩০০ জন অসহায় রোগীকে বিনামূল্যে পৌঁছে দিয়েছেন বিভিন্ন হাসপাতালে। এদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন গর্ভবতী মা, যাদের জরুরি ভিত্তিতে হাসপাতালে নেওয়া প্রয়োজন ছিল। এছাড়াও, প্রতিদিন তিনি অন্তত ৩-৪ জন দরিদ্র মানুষকে বিনা ভাড়ায় তাদের গন্তব্যে পৌঁছে দেন।
এনামের এই সেবা শুধু দিনের বেলাতেই সীমাবদ্ধ নয়। রাত-বিরাত, যখনই কেউ ফোন করে সাহায্যের জন্য, এনাম তখনই ছুটে যান। তার অটোরিকশার সামনে ও পেছনে টাঙানো মোবাইল নম্বরে ফোন করলেই হলো।
এনাম শুধু একজন রিকশাচালকই নন, তিনি একজন সংবেদনশীল মানুষও। নিজের এই কাজকে তিনি গানের মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। তিনি নিজেই গান লিখেছেন এবং সুযোগ পেলেই তা মানুষকে গেয়ে শোনান। তার গানের কথায় উঠে আসে অসহায় মানুষের কষ্ট এবং তাদের প্রতি তার সহমর্মিতার কথা।
এনামের এই সেবা পেয়ে উপকৃত হয়েছেন অনেকেই। পৌর এলাকার বাসিন্দা মো. হোসেন তাদের মধ্যে একজন। তিনি জানান, “একদিন রাত সাড়ে ১২টার দিকে আমার পরিবারের একজন সদস্য হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও কোনো গাড়ি পাচ্ছিলাম না। তখন একজন এনাম ভাইয়ের নম্বর দেন। ফোন করার মাত্র ২০ মিনিটের মধ্যে তিনি হাজির। তার রিকশায় করে রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যাই। বিনিময়ে তিনি কোনো টাকা তো নেনইনি, বরং এক কাপ চা খাওয়ার অনুরোধও ফিরিয়ে দিয়েছেন।”
এনাম বলেন, “আমি নিজের আত্মতৃপ্তি আর অসহায় মানুষকে সহযোগিতা করার জন্য এই সেবা দেই। এর বিনিময়ে আমি টাকা-পয়সা বা অন্য কিছু চাই না। যতদিন আল্লাহ আমাকে বাঁচিয়ে রাখবেন, ততদিন আমি এই সেবা চালিয়ে যেতে চাই।” তিনি সবার কাছে নিজের ও তার পরিবারের জন্য দোয়া চেয়েছেন।
এনামুল হক এনাম একজন সাধারণ রিকশাচালক হয়েও অসাধারণ কাজ করে চলেছেন। তার এই নিঃস্বার্থ সেবা সমাজের অসহায় মানুষের জন্য আশার আলো হয়ে উঠেছে। সমাজের প্রতি তার এই দায়বদ্ধতা ও মানবিকতা আমাদের সবার জন্য এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত।

Discussion about this post