Print Date & Time : 10 May 2025 Saturday 6:55 pm

হানিফের রোষানলে নিখোঁজ, কুষ্টিয়ার স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা সবুজ

এনামুল হক: কুষ্টিয়া জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারন সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন সবুজ (৪০)ছিলেন অত্যন্ত প্রতিবাদী নেতা । অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করার জন্য তিনি কুষ্টিয়াতে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। তার জনপ্রিয়তা যখন তুঙ্গে তখন তিনি ঘোষণা দেন কুষ্টিয়া পৌরসভায় মেয়র পদে নির্বাচন করার । তাতে ব্যাপক সাড়া পড়ে। এতে ক্ষুদ্ধ হন এমপি হানিফসহ দলের অনেক নেতাই।

বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের যুগ্ম-সাধারন সম্পাদক ও কুষ্টিয়া -৩ আসনের এমপি মাহাবুবুউল আলম হানিফ ও তার চাচাতো ভাই কুষ্টিয়া সদর উপজেলা চেয়ারম্যান আতাউর রহমান আতার নানা অপকর্মের বিরোধিতা করার জন্য তিনি চরম বিরাগভাজন হন তাদের।

ষড়যন্ত্র হয় সবুজকে নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দেয়ার । কিন্তু নিজ সংগঠনের মাঝে চরম জনপ্রিয়তার কারনে তাদের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়। শুরু হয় তাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়ার চক্রান্ত । সুযোগ এসে যায় তাদের হাতে ।

২০১৫ সালের ১৫ আগস্ট সকাল সাড়ে ১০টার দিকে তিনি থানাপাড়ার নিজ বাসা থেকে বিপুল পরিমান দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে মজমপুর গেটস্থ বঙ্গবন্ধুর ম্যুরালে যান শ্রদ্ধা জানাতে । ওই সময় হানিফ-আতার অনুগত সাজ্জাদ হোসেন সবুজের চিরশত্রু কুষ্টিয়া শহর আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারন সম্পাদক মোমিনুর রহমান মোমিজের নেতৃত্বে একটি সশস্ত্র এবং উসকানিমূলক মহড়ার কারণে উপস্থিত অন্যান্য ত্যাগী নেতাকর্মীরা উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। হানিফ-আতার নির্দেশে মোমিজ ও তার অনুগতরা সবুজকে হত্যা করার জন্য তাকে লক্ষ্য করে গুলি বর্ষণ করে। সাজ্জাদ হোসেন সবুজ প্রাণে বেঁচে গেলেও কুষ্টিয়া পৌর এলাকার ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা সবুজ (৩৫ ) নামে অপর এক যুবক ঘটনাস্থলে নিহত হন।

ঘটনার দিনই দুপুর ২টার দিকে কুষ্টিয়া জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি আক্তারুজ্জামান লাবু, শহর আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক মোমিজের ছোট ভাই হাফিজুর রহমান হাফিজ, জেলা স্বেচ্ছাসেবকলীগের তৎকালীন যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক হালিমুজ্জামান হালিম, কুঠিপাড়া এলাকার আবু তাহের, পেয়ারাতলা এলাকার রমজান হোসেন এবং খোকসা উপজেলার রবিউল হোসেন সাজ্জাদ হোসেন সবুজের বাড়িতে যান এবং তারা সবুজকে বলেন তোমাকে এখনই নেতার (হানিফের) বাড়িতে যেতে হবে, নেতা ডাকছে।
সবুজ বাধ্য হয়ে তার স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস জিনিয়াকে সঙ্গে নিয়ে হানিফের কুষ্টিয়ার বাড়িতে যান। হানিফ সবুজকে তার গোপন কক্ষে ডেকে নিয়ে বলেন, তোমার বিরুদ্ধে হত্যা মামলার প্রস্তুতি চলছে । তুমি যে কোন সময় গ্রেফতার হয়ে যাবা । তুমি গ্রেফতার হলে ক্রসফায়ারে মারা যাবা আমার কিছইু করার থাকবে না। যদি বাঁচতে চাও তাহলে আমার কথামতো চলতে হবে, তুমি এখুনি লাবুকে সাথে নিয়ে গাজীপুরের ড্রিম স্কয়ার রিসোর্টে চলে যাও। আমি রিসোর্টের মালিককে বলে দিচ্ছি, সেখানে তুমি নিরাপদে থাকতে পারবে। হানিফের কথা মতো ওই রিসোর্টে ওঠেন সবুজ ও লাবু। হানিফ গংরা পেয়ে যান সবুজকে হত্যা করার মৌকা। সেখানে অবস্থানকালে গভীর রাতে লাবু’র যোগসাজশে পূর্বপরিকল্পিত ভাবে ১০/১২ জন সাদা পোশাকধারী ব্যক্তি সবুজকে রিসোর্ট থেকে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যান। কিন্তু সঙ্গি লাবুকে ছেড়ে দেয়। এর পর গত ৯ বছরে সবুজের কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। সবুজকে ছাড়িয়ে আনার কথা বলে তার পরিবারের কাছ থেকে ৩লক্ষ টাকাও নেয় আতার এক দালাল।
সবুজের স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস জিনিয়া বলেন আমার স্বামী সবুজ কুষ্টিয়া পৌর মেয়র পদে নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছিলেন । সেই লক্ষ্যে পৌরবাসীর সঙ্গে তিনি ভালো সখ্যতা গড়ে তুলেছিলেন। কিন্তু কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি হাজী রবিউল ইসলামসহ এমপি হানিফ,তার ছোট ভাই আতা কেউই বিষয়টি মেনে নিতে পারেননি। আমার বিশ্বাস হানিফ-আতার নির্দেশেই আমার স্বামীকে গুম করা হয় । সবুজের সন্ধান পাওয়ার জন্য আমার শাশুড়িসহ পরিবারের সকলেই এমপি হানিফের কাছে যায় । তিনি বলেন তোমরা চিন্তা করো না আমি দেখছি । এর পর কোন সন্ধান না পেয়ে আমরা এমপি হানিফকে জানাই জাতীয় প্রেসক্লাবে সবুজের সন্ধান চেয়ে সংবাদ সম্মেলন করার কথা । তিনি তাতে চরম ভাবে বাঁধা দিয়ে বলেন, সংবাদ সম্মেলন করলে যদি সবুজকে মেরে ফেলে তা হলে আমার কোন দায় থাকবে না। সেই থেকে আমরা হানিফের উপর ভরসা করে বসেছিলাম। গত ৫ আগষ্টের পর আমরা সবুজের সন্ধানে ডিজিএফআই ও র্যাে]বের আয়না ঘরে সন্ধান করেও তাকে পায়নি। এ কথা বলে তিনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। ছেলে শাহেদ হোসেন (২২) ও মেয়ে সুমাইয়া (১৩) কে নিয়ে তার কষ্টের কথা জানালেন জিনিয়া। তার বিশ্বাস হানিফই তার স্বামীকে গুম করিয়ে হত্যা করিয়েছে। তিনি বলেন সবুজ জীবিত আছে কিনা তা হানিফই বলতে পারবেন। তাকে গ্রেফতার করলেই সবুজের গুম রহস্য জানা যাবে । তিনি আরো বলেন হানিফ- আতা গংরা দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেলে সবুজের ভাই আমার দেবর আরিফুল হোসেন সজিব বাদী হয়ে গত ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ( সোমবার ) কুষ্টিয়ার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে সবুজের গুম ও হত্যা ঘটনায় একটি মামলাটি করেন। আদালত কুষ্টিয়া মডেল থানাকে মামলাটি গ্রহণ করে আসামিদের গ্রেপ্তারের নির্দেশনা দিয়েছেন ।
মামলার বাদী আরিফুল হোসেন সজিব মোবা: নং ০১৭১৬৪৪৩২৫৮ জানান আমার ভাই এর জনপ্রিয়তায় ঈষান্বিত হয়ে ওরা পরিকল্পিত ভাবে গুম ও হত্যা করেছে। আমার ভ্ইা এর শোকে আমার মা ( সাহিদা বেগম (৬০) ) গত ১২ ডিসেম্বর মারা গেছেন । আমার পিতা মো: কাইজার হোসেন (৭০) এখন মৃত্যু শয্যায় । মামলা করার পর আমাকে নানা ভাবে হুমকি ধামকি দেয়া হচ্ছে মামলা প্রত্যাহার করার জন্য।
মামলার অন্যান্য আসামিরা হলেন- কুষ্টিয়া জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সভাপতি আক্তারুজ্জামান লাবু, কুষ্টিয়া শহর আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারন সম্পাদক মোমিনুর রহমান মোমিজ, কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সদর উদ্দিন খান, কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি হাজী রবিউল ইসলাম, কুষ্টিয়া শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান আতা, শহর আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক মোমিনুর রহমান মোমিজের ছোট ভাই হাফিজুর রহমান হাফিজ, কুষ্টিয়া জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হালিমুজ্জামান হালিম, কুষ্টিয়া শহরের কুঠিপাড়া এলাকার আবু তাহের, কুষ্টিয়া শহরের পেয়ারাতলা এলাকার রমজান হোসেন ও কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলার চক হরিপুর গ্রামের শেখ আফাজ উদ্দিনের ছেলে রবিউল হোসেন।
আসামীরা পলাতক থাকায় কারো বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।

কুষ্টিয়া মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শিহাব উদ্দিন শিহাব বলেন, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা নিখোঁজের ৯ বছর পর গুমের অভিযোগে আদালতে মামলা হয়েছে। মামলাটি তদন্তধীন রয়েছে। আসামিরা আত্মগোপনে থাকার কারনে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। তদন্ত শেষে আসামিদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।