শেখ নাদীর শাহ্,পাইকগাছা(খুলনা): ৯ ডিসেম্বর। দক্ষিণ খুলনার ঐতিহাসিক কপিলমুনি হানাদার মুক্ত দিবস।
রাজাকারদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের টানা ৪ দিনের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর আজকের দিনে রাজাকারদের আত্মসমর্পণ ও গণদাবির প্রেক্ষিতে স্থানীয় সহচরী বিদ্যা মন্দিরের মাঠে ১৫৫ জন মতান্তরে ১৫১ জন যুদ্ধাপরাধী (রাজাকারদের) গুলি করে হত্যার মধ্য দিয়ে পতন ঘটে দক্ষিণ খুলনার অন্যতম প্রধান এ রাজাকার ঘাঁটির।
যুদ্ধকালীন সময়ে খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলায় মিলে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়। এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্যানুযায়ী, খুলনার চুকনগরে অল্প সময়ে অধিক মানুষকে হত্যা করার ঘটনা ঘটে। এরপর খুলনার কপিলমুনিতে ঘটে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ ও নির্যাতনের ঘটনা। সর্বশেষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও দন্ড কার্যকর করার ঐতিহাসিক ঘটনাটিও ঘটে কপিলমুনিতেই। ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর সম্ভবত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে যুদ্ধাপরাধীদের তাৎক্ষণিক সাজা দেওয়ার ঘটনা এটাই একক উদাহরণ।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীণ কপিলমুনির রায়সাহেব বিনোদ বিহারী সাধুর সুরম্য বাড়িটিকে দখল করে রাজাকাররা সেখানে শক্ত ঘাঁটি স্থাপন করে। খুলনাঞ্চলের মধ্যে এই রাজাকার ঘাঁটিটি ছিল অনেক বেশি শক্তিশালী। কয়েক শ’ রাজাকার এখানে অবস্থান নিয়ে আশপাশের অঞ্চলে ব্যাপক তান্ডব চালিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন দূর্ভেদ্য এই ঘাঁটিটি দখলে মুক্তিযোদ্ধারা একাধিকবার অভিযান পরিচালনা করেন, তবে এর অবস্থানগত সুবিধা, রাজাকারদের কাছে থাকা অস্ত্র সম্ভারের প্রাচুর্য এবং রাজাকারদের সংখ্যা তুলনামূলক বেশি এবং এলাকাবাসীর অসহযোগিতায় প্রথম দিকের অভিযানগুলো সফল হয়নি। প্রতিবারের যুদ্ধেই রাজাকাররা শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। এরপর মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটলে তারা আশপাশের মানুষদের ওপর নির্যাতনের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিত, যাতে করে মুক্তিযোদ্ধারা এই অঞ্চলে কোনো গেরিলা সুবিধা পেতে না পারে। তাছাড়া এ অঞ্চলে ব্যাপক সংখ্যায় হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বসবাস হওয়ায় রাজাকারদের অত্যাচার-নির্যাতনও সীমাহীন পর্যায়ে পৌছায়। প্রথমে হিন্দু ধর্মাবলম্বী, কিছুদিন পর মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সমর্থকদের ওপর তারা অবর্ণনীয় নির্যাতন করে। কপিলমুনিকে ঘাঁটি করে আশপাশের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে চলত এই নির্মম নির্যাতন। বিভিন্ন গ্রামে হানা দিয়ে লুটপাট, ধর্ষণ, অপহরণ ছিল রাজাকারদের নিত্যকর্ম।
ঘাঁটিতে নিয়মিত ২ শ’রও বেশি রাজাকাররা সশস্ত্র অবস্থান নিয়ে এমন কোন অপকর্ম নেই যে তারা করেনি। কপিলমুনি অঞ্চলে রাজাকারদের তান্ডবের খবর প্রচার হলে মুক্তিযোদ্ধারা এই রাজাকার ঘাঁটিটি দখল নিতে ডিসেম্বরের আগে অন্তত দু’বার আক্রমণ করে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, ১১ জুলাই আক্রমণে নেতৃত্ব দেন লেফটেন্যান্ট আরেফিন। কপিলমুনিতে পৌছাতে দেরি হয়ে যাওয়ায় আক্রমণ শুরুর কিছু পরেই ভোর হয়ে যায়। দিনের আলোয় অল্প মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে এত বড় ঘাঁটি দখল সম্ভব হবে না বিবেচনা করে মুক্তিযোদ্ধারা তালার জালালপুরে ফিরে যান।
বৃহত্তর খুলনা অঞ্চলের সবচেয়ে বড় এই রাজাকার ঘাঁটি ধ্বংস করার জন্য তালা মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পের প্রধান ইউনুস আলী ইনুর নেতৃত্বে যুদ্ধের পরিকল্পনা করে।
সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৪ ডিসেম্বর রাত ৩টায় রাজাকার ক্যাম্পের তিনদিক থেকে বীর মুক্তিযোদ্ধা স.ম বাবর আলী ও আবুল কালাম আজাদের নেতৃত্বাধীন ৫০ জনের মুক্তিসেনার দলটি নাসিরপুর ব্রিজ পার হয়ে কপিলমুনি বালিকা বিদ্যালয়ে অবস্থান নেন। রহমতউল্লাহ ও ওমর ফারুক তাঁদের বিস্ফোরক দল নিয়ে রাজাকার শিবিরের দু’ পাশে পৌছায়। আবু ওবায়দুরের দলটি আরসিএল নিয়ে কানাইদিয়ার পাড় থেকে ক্যাম্পে আক্রমণ করার জন্য তৈরি হয়। ইঞ্জিনিয়ার মুজিবরের নেতৃত্বে একদল অবস্থান নেন আরসনগর। সেখানকার কালভার্ট উড়িয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার দায়িত্ব ছিল তাঁদের। নৌ-কমান্ডো বজলুর রহমান ও হুমায়ুনের নেতৃত্বে একটি দল রাজাকার ক্যাম্পের পাঁচিল ও মূল ঘাঁটিতে বিস্ফোরক লাগানোর দায়িত্বে ছিল। মোড়ল আবদুস সালামের নেতৃত্বে রশীদ, মকবুল হোসেন, সামাদ মাস্টার, জিল্লুর রহমানসহ ২০ জনের একটি দল রাজাকার ঘাঁটির ২৫-৩০ গজ দূরে অবস্থান নেয়; যাতে তাঁরা রাজাকার ঘাঁটির বাংকারে গ্রেনেড নিক্ষেপ করতে পারেন। আজিজুল হকের নেতৃত্বে ১০ জনের আরো একটি দল ছিল একটু দূরের পাইকগাছার শিববাটি নদীর মোহনায়। ভাসমান মাইন নিয়ে তাঁরা অপেক্ষায় ছিলেন। যাতে নৌপথে রাজাকারদের সহায়তায় কোনো গানবোট আসার চেষ্টা করলে সেগুলো উড়িয়ে দেওয়া যায়।
পরিকল্পনামতো ৪ ডিসেম্বর রাতে সবাই তাঁদের নির্দিষ্ট পজিশনে গিয়ে শুরু করে আক্রমণ। এভাবে আক্রমণ পাল্টা আক্রমনের মধ্য দিয়ে এক পর্যায়ে বাইরে থেকে খাবার বা অন্যান্য সহযোগীতা না পেয়ে ৯ ডিসেম্বর সকালে রাজাকাররা সাদা পতাকা উড়িয়ে আত্মসমর্পন করলে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। তবে যুদ্ধের পরিণতি আঁচ করতে পেরে রাজাকারদের অনেকেই রাতের আঁধার ও যুদ্ধের ফাঁকে পালিয়ে যায়।
মুক্তিযোদ্ধা ইউনুস আলী ইনুর মতে, আটককৃত রাজাকারদের সংখ্যা ছিল ১৭৭। তবে তাঁরা শীর্ষস্থানীয় দুইজন রাজাকারকে ধরতে পারেননি বলেও জানান। এ যুদ্ধে গাজী আনসার ও আনোয়ার শহীদ হন। আহত হন বহু মুক্তি যোদ্ধা। রাজাকারদের ঘাঁটি দখলের পর দেখা যায় এক লোমহর্ষক দৃশ্য। একটি কক্ষে যীশুর মতো ঘরের দেয়ালে পেরেক ঠুকে রাখা হয় তালা উপজেলার মাছিয়ারা গ্রামের রহিম বক্স গাজীর ছেলে সৈয়দ গাজীকে। তিনি ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা। রাজাকার বাহিনীতে নাম লিখিয়ে তিনি ক্যাম্পের খবর বাইরে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পাচার করতেন। রাজাকাররা তাঁর প্রকৃত পরিচয় জেনে যাওয়ায় গোটা শরীরে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে সেই কাটা জায়গায় লবণ পুরে দেয় এবং যীশু খ্রিস্টের মতো হাতে-পায়ে পেরেক ঠুকে দেয়ালে আটকে রাখে।
ঘাঁটি থেকে উদ্ধার করা কাগজপত্রে দেখা যায়, ওই রাজাকার ক্যাম্পের মাধ্যমে এক হাজার ছয়শত এক জনকে হত্যা করা হয়েছে। পরবর্তীতে হত্যা করতে কপিলমুনি ও এর আশপাশের এলাকার আরো এক হাজার জনের নামের একটি তালিকা পাওয়া যায় ঘাঁটিতে। রাজাকারদের গ্রেপ্তার ও ঘাঁটি দখলের খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে আশপাশের গ্রামের মানুষরা এসে ভিঁড় করে কপিলমুনি সহচরী বিদ্যা মন্দিরের মাঠে।
এসময় তারা তাঁদের হাতে রাজাকারদের ছেড়ে দেওয়ার জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে দাবি জানাতে থাকেন। এসময় রাজাকারদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যুদ্ধের কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামরুজ্জামান টুকু তাদেরকে বন্দি অবস্থায় বাংলাদেশ-ভারত যৌথ কমান্ডের কাছে হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত নেন। তাঁর এই ঘোষণায় বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন এলাকাবাসী।
অবশেষে জনতার চাপের মুখে মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকারদের বিচার কপিলমুনিতেই করার সিদ্ধান্ত নেন। এসময় একজন বাদে সেখানকার বাকি রাজাকারদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ উত্থাপিত হয়। অভিযোগগুলোর মধ্যে ছিল হত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, ধর্ষণ প্রভৃতির মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ। এই অভিযোগের পক্ষে জনতা সাক্ষ্য-প্রমাণও হাজির করেন।
সকাল ৯টার দিকে শুরু হয়ে সন্ধ্যা অবধি এই বিচার কাজ শেষে। এক পর্যায়ে উপস্থিত হাজার হাজার মানুষ আটক রাজাকারদের ওপর হামলে পড়ে অনেকেরই মৃত্যু নিশ্চিত করে।’
তথ্যানুসন্ধানে আরো জানা যায়, সেদিন রাজাকারদের ১৫৭ জন আত্নসমর্পন করলেও ২ জনকে বয়স বিবেচনায় ছেড়ে দিয়ে বাকি ১৫৫ জনকে দড়ি দিয়ে বেঁধে সারিবদ্ধভাবে দাড় করিয়ে তাদের গুলি করে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়। মতান্তরে এর সংখ্যা ছিল ১৫১ জন।
এছাড়া জনগণের রায়ে ‘সাজাপ্রাপ্ত রাজাকারদের মধ্যে অত্যাচারী ১১ জনকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করে জনতার রায়ে এদেরকে গুলি করে হত্যা করার পরিবর্তে কষ্ট দিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করার দাবি ওঠে। এক পর্যায়ে নিজেরাই এদের ছিনিয়ে নিয়ে গণপিটুনিতে মৃত্যুদন্ড দেয়। যেভাবে রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধাদের মেরে গোটা শরীর চিরে তাতে লবণ পুরে কষ্ট দিয়ে হত্যা করেছিল, ঠিক তেমনি এসব রাজাকারকেও সারা শরীর ব্লেড দিয়ে কেটে তাতে লবণ পুরে মাঠে ফেলে রাখা হয়।’
চিহ্নিত রাজাকারদের মধ্যে ৮জন মাওলানা আফছার, সৈয়দ ফকির, আফতাব কারী, আবদুল মালেক, মতি মিয়া, শেখ হাবিবুর রহমান, আমিনউদ্দিন মুন্সী এবং মশিউর রহমান। বাকি ৩ জন ছিলেন, দাইদ গাজী, ওয়াদুদ কারিকর ও নূরুল ইসলাম বলে জানান, কপিলমুনি আঞ্চলিক মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ সমিতির সভাপতি সরদার ফারুখ আহমেদ। এদের সবারই বাড়ি ছিল কপিলমুনি এবং সংলগ্ন এলাকায়।

Discussion about this post