ইসলামের ইতিহাসে আত্নত্যাগের এক বিরাট নিদর্শন বদর যুদ্ধ
৬২৪ সালের ১৭ মার্চ মোতাবেক দ্বিতীয় হিজরির ১৭ রমজান মদিনা থেকে ৭০ মাইল দূরে ঐতিহাসিক বদর নামক স্থানে সংঘটিত এক সম্মুখ যুদ্ধ যা ইতিহাসে বদর যুদ্ধ নামে পরিচিত। এ যুদ্ধ ইসলামের ইতিহাসে মুসলমানদের প্রথম সশস্ত্র যুদ্ধ। এ যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর নেতৃত্ব দেন বিশ্বনবী মুহাম্মাদ (সাঃ)। আর মুশরিক বাহিনীর নেতৃত্ব দেয় আবু জেহেল। আজ সেই ১৭ রমজান ঐতিহাসিক বদর দিবস।
এ যুদ্ধে সল্পসংখ্যক মাত্র ৩১৩ জন মুসলমান যোদ্ধা মক্কার ১ হাজার সশস্ত্র প্রশিক্ষিত কাফের যোদ্ধার মোকাবেলায় বিজয় অর্জন করে । আল্লাহ তাআলা এ যুদ্ধ সম্পর্কে কুরআনে বলেন, ‘নিশ্চয়ই দু’টি দলের মোকাবিলার মধ্যে তোমাদের জন্য নিদর্শন ছিল। একটি দল আল্লাহর রাহে যুদ্ধ করে। আর অপর দল ছিল কাফেরদের। এরা স্বচক্ষে তাদেরকে দ্বিগুণ দেখছিল। আর আল্লাহ যাকে নিজের সাহায্যের মাধ্যমে শক্তি দান করেন। এরই মধ্যে শিক্ষনীয় রয়েছে দৃষ্টি সম্পন্নদের জন্য। (সুরা ইমরান : আয়াত ১৩)। আর নব গঠিত মদিনা রাষ্ট্রের জন্য বদর যুদ্ধে জয়লাভ, যুদ্ধের গুরুত্ব ও তাৎপর্য ছিলো অনেক।
দ্বিতীয় হিজরী সনে ১৭ই রমজান সকাল হতেই কুরাইশগণ এগিয়ে এল এবং পাহাড় অতিক্রম করে ইয়াল ইয়াল উপত্যকায় নামল। দূর থেকে তাদের দেখে রাসূলে খোদা আল্লাহ্র কাছে প্রার্থনা করলেন, হে আল্লাহ এখানেই কুরাইশগণ এসেছে, তারা তাদের ঔদ্ধত্য এবং গর্ব নিয়ে এসেছে। তারা তোমাকে এবং তোমার প্রেরিত পুরুষকে অস্বীকার করে এসেছে। হে মহান প্রভু, তুমি আমাদের সাহায্য কর, যে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি তুমি আমাকে দিয়েছিলে। বদর যুদ্ধ ছিল আত্নত্যাগের এক বিরাট নিদর্শন। যুদ্ধ আরম্ভ হলে দেখা গেল, পিতা-পুত্রের বিরুদ্ধে, ভ্রাতা-ভ্রাতার বিরুদ্ধে, বন্ধু-বন্ধুর বিরুদ্ধে দন্ডায়মান। হজরত আবু বকর তাঁর পুত্র আব্দুর রহমানের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন, কুরাইশ সেনাপতি ওত্বা তার পুত্র হুজায়ফার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন। ইসলামের ইতিহাসে অনেক সংঘর্ষের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে কিন্তু শেষ পর্যন্ত সংঘর্ষ হয়নি, শান্তি স্থাপিত হয়েছে। কিন্তু মহানবী এবারে স্থির নিশ্চয় ছিলেন যে, এই যুদ্ধ এড়ানোর কোনই উপায় নেই। তিনি জানতেন সত্য তাঁর সপক্ষে এবং মহান প্রভু আল্লাহ্ তাঁকে সাহায্য করবেন। বদর যুদ্ধ ছিল মুসলিম মুহাজিরদের জন্য ঈমানের অগ্নি পরীক্ষা। কারণ, সদ্য ছেড়ে আসা তাদের আপন রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়-স্বজনের বিরুদ্ধে ছিল এ যুদ্ধ। ঈমানের পরীক্ষায় তারা জয় লাভ করেছিল। এ সকল মুহাজির নিজের আত্মীয়-স্বজনদের পরিহার করে আল্লাহ এবং তাঁর রাসুলকেই বেশি ভালোবেসে ছিলেন। যার প্রমাণও তারা দিয়েছিলেন ঐতিহাসিক বদর প্রান্তরে অনুষ্ঠিত যুদ্ধের ময়দানে। এ যুদ্ধে মক্কার কুরাইশদের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ৭০ জন সৈন্য নিহত হয় এবং সমান সংখ্যক লোক বন্দি হয়। আর মুসলমানদের পক্ষে মাত্র ৬ জন আনসার এবং ৮ জন মুহাজিরসহ ১৪জন শাহাদাত বরণ করেন। ইসলামের প্রথম যুদ্ধে আল্লাহ তাআলা মুসলিম বাহিনীকে বিজয় দান করেন। বিশ্ব মানবতার মুক্তির দিশারী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) এর আবির্ভাবের পূর্বে আরবসহ গোটা বিশ্ব ছিলো জাহেলিয়াতের চরম তমসায় আচ্ছন্ন। পরবর্তীতে রাসুল (সাঃ) এর নবুয়ত লাভ, মদিনায় হিজরত, মদিনা সনদ, হুদাইবিয়ার সন্ধি, উহুদ যুদ্ধ ও খন্দক যুদ্ধের অসংখ্য ছোট বড় যুদ্ধ, সর্বপরি মক্কা বিজয় এর মাধ্যমে গোটা জাহানে ইসলাম তথা এক আল্লাহর একত্ববাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
বদর যুদ্ধ ইসলাম এবং মুসলমানদের জন্য এক ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। ইসলাম যে শিক্ষা মুসলমানদের প্রতিনিয়ত দিয়ে আসছে। আর তা হলো- সব কাজে আল্লাহর ওপর অগাধ বিশ্বাস এবং ভরসা। বিপদ-আপদসহ সর্বাবস্থায় আল্লাহর ওপর আস্থাশীল হওয়াই হলো বদরের ঐতিহাসিক সুমহান শিক্ষা।
লেখক- কামিল (আল হাদিস) মাস্টার্স (ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ) ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়।
এবি//দৈনিক দেশতথ্য//এপ্রিল ১৮,২০২২//
প্রিন্ট করুন
Discussion about this post