মুক্তিযুদ্ধের বার্তা বাহক হাসির মার দু:খ
সবাই তাকে হাসির মা বলে এখনো ডাকে। এই নারী বুক ভরা ব্যাথা নিয়ে হাসির মা নামে আজও বেঁচে আছে। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তার ছিল ভরা যৌবন। সেই যৌবনের সব হাসি কেঁড়ে নিয়েছিল পাক সেনাদের দোসর বিহারীরা।
বিহারীরা ওই নারীর স্বামীকে নির্মম ভাবে হত্যা করেছিল। এই নারী জীবন সায়াহ্নে এসে এক মুটো ভাতের জন্য করুনা মাগে। একটি ওষুধের জন্য যারতার কাছে হাত পাতে। তারপরও তার নাম হাসির মা।
হাসির মাকে আমার ছোট বেলা থেকেই চিনতাম। দূর প্রবাসে এখনো তার কথা আজও আমার মনে পড়ে। কারন তাকে প্রথম দেখার স্মৃতি আজও আমারমনে আছে। মনে পড়ে যায় হাল্কা-পাতলা শ্যামলা বর্ণের এক তরুণী বাঙালির আলোর ফেরিওয়ালা হয়ে ফরিদপুর ছেড়ে আমাদের গ্রামে এসেছিলেন।
স্বামীর হাত ধরে সাথে এনেছিলেন ফুটফুটে ছোট্ট একটি কন্যা শিশু। প্রতিবেশী সম্পর্কে তাকে আমি দাদি বলে ডাকতাম। দাদির সঙ্গে রং-তামাশা করা যায় এতটুকু বয়স তখন হয়েছে। একবার দাদিকে বলেছিলাম, ও দাদি তুমি কি বাঙালি? দাদি কড়া উত্তরে তৎক্ষণাৎ বলেছিলেন ‘হ্যা আমি বাঙালি আর তোরা হলি সব পাঞ্জাবি’।
প্রতিবেশি দাদা তেমন স্বচ্ছল ছিলেন না। দিনমজুরের কাজ করতেন। দাদি তার মেয়েকে নিয়ে আমার মাকে নানাভাবে সাহায্য করতেন। দাদির মেয়ের নাম ছিল হাসি। তাই তাকে সবাই হাসির মা বলেই ডাকতেন। বয়স কম হওয়ায় দাদি সম্বোধনটাকে তিনি পছন্দ করতেন না। কেন করতেন না তা বোঝার বয়স তখনো আমার হয়নি।
আমার বড় ভাই প্রফেসর ড. মান্নান মৃধা দাদি সম্পর্কে বলতে গিয়ে বললেন, সে তো ছিল ফ্লাইং বার্ড, ছিল ফ্রি ল্যান্সার। ছিল অলস। ছিল প্রতিবাদি। ছিল বার্তা বাহক। এগুলোই নাকি বাঙালির বৈশিষ্ট্য। বিশেষ করে ফরিদপুর, যশোর এবং কুষ্টিয়ার মানুষ নাকি এমনই।
সত্যিকারার্থে তখনকার মনীষীদের জীবনী নাকি এমনটিই ছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুচিত্রা সেন, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, শেখ মুজিবসহ হাজারও উদাহরণ রয়েছে যারা কোনো এক সময় চাপে এবং তাপে নিজ নিজ এলাকা ছেড়ে নানাভাবে বিপ্লবমুখর হয়েছিলেন। তারা সবাই কিন্তু নিজস্ব মেধার গুণেই আলোর ফেরিওয়ালা হয়ে দেশ তথা গোটা বিশ্বকে আলো দান করেছেন। যার ফলস্বরূপ আমরা পেয়েছি চিত্রজগত, পেয়েছি বাঙালির বাঙালিত্ব, পেয়েছি সোনার বাংলা, পেয়েছি বিশ্ব কবি, পেয়েছি জাতির পিতা। হাসির মা দাদি দারিদ্র্য মোচনে নয় বরং ভালেবাসার টানে ফরিদপুর ছেড়ে নবগঙ্গা নদী পাড়িদিয়ে এসেছিলেন মাগুরার নহাটা গ্রামে।
দাদি বাঙালির বাঙালিত্বকে নিয়ে এসেছিলেন আমাদের এলাকায়। বিদ্রোহের বার্তাবাহক হিসেবে হুঁশিয়ারি সংকেত দিয়েছিলেন সকলকে। তিনি বলেছিলেন “তোরা পাঞ্জাবি”। পাঞ্জাবী নামের উপর তার ক্ষোভ এই এলাকায় রাগান্বিত বার্তা এনে দিয়েছিল।
বঙ্গবন্ধুর ডাকে সবাই সাড়া দিয়েছিলাম শুধু আজীবনের মতো পাঞ্জাবি শব্দটাকে মুছে ফেলতে। বাঙালী সেই পাঞ্জাবী শাসক গোষ্ঠীকে দমন করে মুক্ত করেছিল বাঙালির বাঙালিত্বকে।
আমাদের সেই দাদি ছিল অতিসাধারণ একজন মানুষ। সম্ভবত ২০১৪ সালে, দুইদিন নহাটাতে ছিলাম। তখন কিন্তু বলতে গেলে পুরো সময়টুকু তার সঙ্গে কেটেছিল। সুখ-দুংখের অনেক কথা শেয়ার করেছিলেন তিনি। তার কথা শুনে আমার মনে হলো দেশ স্বাধীন হলো, কেউ পেলো, কেউ শুধু হারালো। ৭১ এর যুদ্ধে দাদি তার বাড়ি হারিয়েছেন। ১২-১৩ বছরের মেয়ে হাসিকে এবং পরে তার স্বামীকে হারিয়েছেন।
পাঞ্জাবিদের নির্মম অত্যাচারের কাহিনী ভিডিওটিতে আছে। সে কথা শুনুন দাদির মুখে। দাদির হারানোর গল্পের শেষ হয়নি। বাবা-মা হারানোর ব্যথা আমার মনে তখন যেভাবে হাহাকার করে ব্যস্ত রেখেছিল আমাকে, দাদি সেটা লক্ষ করেছিলেন। তাই হয়তো তাঁর দুঃখের কথা শেয়ার করে আমার দুঃখের বোঝা বাড়াতে চেষ্টা করেননি।
হঠাৎ দাদির ছোট্ট একটি ভিডিও দেখে মনে হলো তাঁর দারিদ্র্যতা আজ চরমে। দিনে কোনোক্রমে দু-এক বেলা খেয়ে না-খেয়ে থাকেন। নহাটা বাজারে গিয়ে তাঁর চিকিৎসা করানোর কোনো সাধ্য নেই। তাঁকে চিকিৎসা করাতে না পারলেও তাঁকে অবহেলা করা আমাদের ঠিক হবেনা।
আমি মনে-প্রাণে আশা করি রাষ্ট্র থেকে শুরু করে সবাই যেন আমাদের এই বেঁচে থাকা বাঙালি দাদির জন্য কিছু করি এক সঙ্গে। আমরা যদি সোনার বাংলায় আবারও একটি পয়লা বৈশাখ পাই, যেন বৈশাখের মেলায় অনেক মানুষের ভিড়ে দাদিকে দেখতে পাই। দাদির মুখে যেন শুনতে পাই মেলায় গিয়েছিলাম শুনলাম একটা ছেলে বাঁশি বাজাচ্ছে, কী দারুণ! বাঁশি যে আসলেই ডাকাতিয়া হয়, এর আগে বিশ্বাস করিনি।
এই শীতেই যেন দাদিকে একটি বিশেষ উপহার দিতে পারি। দাদির জন্য আমরা সবাই ছোট্ট একটি ভালোবাসার সুখের ঘর তৈরির কাজ শুরু করেছি। দাদির মুখে যেন এবারের বৈশাখে হাসির কখা শুনতে পাই।
পরিশেষে বলতে চাই, হে বাংলাদেশ! আজও প্রতি ক্ষণে ক্ষণে তোমায় মনে পড়ে। আজ আমার জীবনে অনেক কিছু আছে, তবু মনে হয় কী যেন নেই! আমার এই হৃদয়জুড়ে আজ অনেক কিছু আছে। তার মধ্যে আছে, তোমাকে না পাওয়ার শূন্যতা। তোমার ফেলে যাওয়া স্মৃতিগুলো আঁকড়ে ধরে নিঃস্ব হয়ে আজও বেঁচে আছি। বিধাতার কাছে আমার একটাই চাওয়া, জীবনের শেষবেলায় হলেও যেন দেখতে পাই তুমি সত্যিকার সোনার বাংলা হয়েছো, যেখানে হাসির মা দাদির মতো কেউ পরের দুয়ারে আর হাত না পাতে শুধু একটু অন্ন, বস্ত্র এবং বাসস্থানের জন্য! আমিন।
লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন।
![প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন](http://dailydeshtottoh.com/wp-content/plugins/wp-print/images/printer_famfamfam.gif)
Discussion about this post