আমার বড়বোন একরামা খাতুন গত শুক্রবার (২৭ অক্টোবর/২০২১) সকাল ১১ঃ৪০ মিনিটে মারা গেছেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬১ বছর। তাকে সমাহিত করে গত রবিবার রাত একটায় কুষ্টিয়ার মিরপুরের বাড়ি থেকে ঢাকায় ফিরেছি।
কিছু স্মৃতি কিছু কথাঃ আমরা পাঁচ ভাই তিন বোন। দুই ভাবি মা আব্বা দুইজন কৃষি কাজ ও গৃ্হস্থালীর কাজের লোক মিলে আমাদের ছিলো ১৬ সদস্যের পরিবার। সবার খাবার রান্না হতো একসাথে। পরিবার ছিলো অনাবিল আনন্দ। ছিলো গোয়াল ভরা গরু গোলা ভরা ধান। পরিবারে পড়েনি কোন বিয়োগান্ত ঘটনার ছাপ। ১৯৭৮ সালের ২ মার্চ ভোর রাতে মারা গেলেন আব্বা আবেদ আলী মোল্লা। কিশোর বয়সের উল্লাসী মন সেই যন্ত্রণা আমাকে তাৎক্ষণিকভাবে বিমর্শ করতে পারেনি। কৈশোর উত্তীর্ণ কালে মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছি বাবা হারনোর যন্ত্রণা। বাবার কথা মনে হলেই ঢাকা থেকে এখনো ছুটে যায় তার কবরের কাছে। চোখের জলে জামা ভিজিয়ে কাঁদি আর আব্বার জন্য আল্লাহর কাছে প্রর্থনা করি।
২০০২ সালে মারা গেছে ছোট বোন যমুনা। আমি তখন স্বপরিবারে কুষ্টিয়া শহরের বাসিন্দা। তাঁকে সমাহিত করা হয়েছে তাঁর শ্বশুর বাড়ির এলাকার গোরস্থানে। তার জীবন্তমুখ দেখার সুযোগ পায়নি।
২০০৮ সালের ৮ অক্টোবর রাত এগারোটায় খবর পেলাম মিয়া ভাই আজিবর রহমান মারা গেছেন। তখনই ঢাকা থেকে রওনা হয়ে সারারাত গাড়ি ড্রাইভ করে ভোর সাড়ে পাঁচটায় বাড়ি পৌঁছালাম। মিয়াভাইকে রাতেই গোসল দিয়ে কাফন পরিয়ে আমার অপেক্ষায় রাখা হয়েছিল। আমার মা চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠে বললো “তুমি এলে, এই দেখ, আমার দারোগা বাবু (সেই আমলের মানুষ হওয়ায় তিনি মনে করতেন দারোগারা সবচেয়ে বড় ক্ষমতার মানি লোক। তাই অনেকের মতোই ছেলেকে বড় করে দেখাতে দারোগা নামটি ব্যবহার করতেন) আমাদের ছেড়ে চলে গেছে”।
মেঝভাই গোলাম মোস্তফা লাশের পায়ের কাছে বসে কাঁদছে। এবার যে মারা গেছে সেই বোন একরামা ও ছোট বোন নাজিরা উঠানে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদছে। আপনজন হারানোর পর যে দৃশ্য হয় তা ভুক্তভোগী ছাড়া অন্যকে বুঝানো দায়।
মিয়া ভাইকে দাফনের পরের দিন ঢাকায় ফিরলাম। সেদিন একটি গানের কলি আমাকে খুব কাঁদিয়েছিল। সেই গানটির প্রথম কলি ছিলো ” ও নগরবাসি গণ আমার যেদিন বিয়ে হবে পাড়াপড়শি জানতে পারবে, বরযাত্রী গণ আসবেরে দৌড়াইয়া, আতর গোলাপ মাখাইবে, বিয়ের পোশাক পরাইবে—-_—বোন কান্দে ভাই ভাই বলে, ভাই কান্দে উঠানে দাঁড়াইয়া।”
গত শুক্রবার সকালে ১১টা পঞ্চাশ মিনিটে ভাতিজা আমানুর রহমান খবর দিল আমার বড়বোন একরামা ১০ মিনিট আগে মারা গেছেন।
যে পোশাকে ছিলাম সেই পোশাকেই ছুটলাম কুষ্টিয়া। বিকেল সাড় পাঁচটায় পৌঁছালাম। সেই একই দৃশ্য। ইমিডিয়েট বড়বোনের লাশ দেখলাম। বাদ মাগরিব মিরপুর গোরস্থানে তাকে সমাহিত করা হলো। তার এক ছেলে ও দুই মেয়ে আছে। মাওড়া হয়ে গেল তারা। গত শনিবার তার কালমা খতম পড়িয়ে রোববার সকালে রওয়ানা দিয়ে রাত একটায় ঢাকার বাসায় পৌঁছালাম।
মনে পড়ছে কবি জসিমউদ্দিনের ” কবর” কবিতা। ” এই কঠিন মাটির তলে কত সোনা মুখ নাওয়ায়ে দিয়েছি দু’চোখের জলে”।
আমার হয়েছে সেই রকমই অবস্থা। প্রথমে দেখেছি আব্বার মৃত্যু, এরপর বড়ছেলে আব্দুস সবুর, তারপর ছোট বোন যমুনা, তারপর বড় ভাই আর এবার দেখলাম বড়বোন একরামার মৃত্যু।
১৪ সদস্যের সেই হাসিখুশি পরিবারের প্রতিষ্ঠাতাসহ ৪ জন কবর বাসি হয়েছেন। মা হাজেরা খাতুন মেঝ ভাই গোলাম মোস্তফা বোন নাজিরা ও ছোট ভাই গণি দুই ভাবি সহ ৬ জন থাকেন গ্রামে নিজেদের বাড়িতে। আমি ঢাকায়। সবার ছোট ভাই ছলেমান দীর্ঘদিন ধরে সৌদি আরবে বাস করে।
কালের বিবর্তনে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে আমার আব্বা মরহুম আবেদ আলী মোল্লার হাতে গড়া একটি সাজানো গোছানো ফুলবাগান।
এই কথা মনে হলে কানে বাজে সেই সুর ও গান ” কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই, মঈদুল ঢাকাতে..………….।”
প্রার্থনাঃ হে আল্লাহ, আর পারি না। তুমি আমাদের শোক সইবার শক্তি দাও। আমার আব্বা মরহুম আবেদ আলী মোল্লা বড়ভাই আজিবর রহমান ছোট বোন যমুনা বড়বোন একরামার কবর আজাব মাফ করে দাও, তাদের সকল গুণাহ মাফ করে দাও। তাদের বেহেশতের বাসিন্দা করে রাখো।
যারা আমার ব্যাথাতুর কাহিনীটি পড়লেন তাদের পিতা মাতা ভাই বোন সহ পরিবারের সকল মৃত সদস্যদের গুণাহ মাফ করে দাও। তাদের বেহেশতের বাসিন্দা করে নাও। জীবিতদের সহি সালামতে রাখো।
প্রিন্ট করুন
Discussion about this post