ডাক টিকিটকে সভ্যতার বাহন বললে নিশ্চয়ই বেশী বলা হবে না। দূর দূরান্তের মানুষের সাথে যোগসূত্র স্থাপন করিয়ে দিতে ডাক বিভাগের ভূমিকা ছিল অপরিসিম। ‘ডাক’ অর্থ আহবান/ডাকা। এই শব্দ থেকে ডাকঘর বা ডাক প্রথার উৎপত্তি বলে অনুমিত।
বিশ্ব-ডাক টিকিট ও বাংলাদেশের ডাক টিকিটের জন্ম-কাহিনীর আগে জানা দরকার কখন থেকে চালু হয়েছিল ডাক প্রথা। এর সঠিক ইতিহাস নিয়ে নানা জন বিভিন্ন অভিমত প্রকাশ করেছেন। অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন, ভারতবর্ষে ঘোড়ার ডাক প্রথার প্রচলন ঘটিয়েছিলেন বাবরের সেনাপতি শের শাহ।
ডাক প্রথা চালু হওয়ার পর প্রেরকের চিঠি ডাক বিভাগ গ্রহন করে প্রাপকের নিকট পৌঁছে দিয়ে মাশুল দাবি করতো। অনেকেই নগদ অর্থে চিঠি নিতে চাইতো না। এ নিয়ে প্রাথমিক অবস্থায় প্রাপকের সঙ্গে ডাক মাশুল নিয়ে প্রায়শঃ গোল বাঁধত। এমন অবস্থার প্রেক্ষাপটে রোল্যান্ড হিল নামের একজন সরকারের কাছে সংস্কার প্রস্তাব করেন। তাঁর প্রস্তাবের আলোকে জন্ম নেয় ডাক টিকিট। ১৮৪০ সালে সিদ্ধান্ত হয় প্রেরক ডাক মাশুল দেবেন। মাশুলকে নগদ অর্থে রূপ দিতে একটি বিকল্প তৈরীর তাগিদ অনুভূত হয়। সেই তাগিদ পূরণে ১৮৪০ সালে ইংল্যান্ডের স্যার রোল্যান্ড হিল ‘পেনি পোস্ট’ (এক পেনি) প্রবর্তন করেন। এই সময়ে প্রথম তৈরী করা হয় ডাক টিকিট। এই ডাক টিকিটের রঙ ছিলো কালো। এই জন্য এর নাম রাখা হয় ‘ব্লাক’ আর মূল্য এক পেনি হওয়ায় ডাক টিকিটকে বলা হতো “পেনি ব্লাক”! এই জন্য বৃটেনের রোল্যান্ড হিলকে ডাকটিকিটের জনক বলে অভিহিত করা হয়।
১৮৫৮ সালের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ভারতবর্ষকে বৃটেনের রাণীর হাতে ন্যাস্ত করে। এরপর ব্রিটিশ রাজ ১৮৬১ সাল থেকে ভারতে ডাক বিভাগের কার্যযক্রম শুরু করে। সে সময়ে নির্মাণ করা হয় ৮৮৯টা ডাকঘর। ১৯১১ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি চালু হয় এয়ার মেইল। হেনরী পেকুয়েট নামের এক ফরাসি পাইলট এলাহাবাদ থেকে ১৫ কেজি ওজনের প্রায় ৬০০০ চিঠি নিয়ে গংগার অবস্থিত নেইনি নামের একটি স্থানে পৌঁছান।
ভারতে চিঠির পাতার সংখ্যার ভিত্তিতে ডাক মাশুল পরিশোধ করতে হতো। এই মাশুল নেওয়া হতো ডাক টিকিটের মাধ্যমে। সেই সময় থেকেই ভারতীয়রা ডাক টিকেটের সাথে পরিচিত হয়। যারা ডাক টিকেট কিনতে পারতেন না তারা টিকেট ছাড়াই চিঠি পোস্ট করতে পারতেন। এটাকে বলা হতো বিয়ারিং চিঠি। বিয়ারিং চিঠি নিতে অনিহা প্রকাশ করলে চিঠির উপর ডাক হরকরা লিখে দিতেন ‘এড্রেসী নট ফাউন্ড’। এভাবে ‘বিয়ারিং’ চিঠি আদান-প্রদানে এক সময় ভাটা পড়ে। যার ফলে বিয়ারিং ব্যবস্থা বন্ধই হয়ে যায়। এই চিঠির প্রথা ৮০ ’র দশকেও চালু ছিলো। ওজনের উপর ভিত্তি করে ডাক মাশুল নির্ধধারণ করা হতো। এই কারণে প্রতিটি ডাকঘরে চিঠি ওজন করার জন্য নিক্তি আছে।
ডাক হরকরাদের নিয়ে রয়েছে অনেক সাহিত্য কর্মম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১১ সালে তিনটি দৃশ্যে ৩৯৯ টি সংলাপে সমৃদ্ধ বিখ্যাত নাটক, ‘ডাকঘর’ রচনা করেন। প্রখ্যাত সাহিত্যিক তারা শঙ্কর বন্দোপা
ধ্যায় লেখেছেন “ডাক হরকরা”। এভাবে বাংলা সাহিত্যে ডাকঘর বিশিষ্ট স্থান দখল করে নেয়। ইংরেজিতে অনুদিত ‘ডাকঘর’ নাটকের ভূমিকায় কবি ইয়েটস লিখেন, ‘It conveys to the right audience an emotion of gentleness and peace’.
আমাদের দেশে ডাক পিয়ন গগন হরকরা প্রকৃত নাম গগণচন্দ্র দাস শিক্ষিত সমাজের কাছে পরিচিত হলেও নতুন প্রজন্ম তাঁর নাম খুব একটা জানে না! কুষ্টিয়ার শিলাইদহ ডাকঘরের ডাক পিয়ন ছিলেন লোক-সঙ্গীতশিল্পী, বিশিষ্ট বাউল গীতিকার গগন হরকরা (১৮৪
৫-১৯১০)। তাঁর “আমি কোথায় পাবো তারে” গানের কথা ও সুর অবলম্বনে কবি রবীন্দ্রনাথ রচনা করেন, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ যা আমাদের জাতীয় সঙ্গীত।
সুকান্ত ভট্টাচার্য লেখেছেন “ রানার “ কবিতা। সুকান্তের ‘রানার’ কবিতাটি ডাক পিয়নকে দিয়েছে অমরত্ব। বিখ্যাত গায়ক হেমন্তকুমার মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া রানার গানটি ডাক পিয়নকে আমাদের সংস্কতির সাথে যেন একীভূত করে দিয়েছে! তাদের নিয়ে লেখা বি
ভিন্ন গল্প ও কবিতা এ্রখনো মানুষের হৃদয়ে বাজে।
কবি কাজী নজরুলকে লিখা রবীন্দ্রনাথের এক বিখ্যাত টেলিগ্রামের কথা। তিনি ১৯২৩ সালে হুগলী জেলে আটক ‘সাধারণ কয়েদী হিসাবে অনশনরত কবি নজরুলকে’ লিখেন, Give up hunger strike. Our Literature claims you. জেল কর্তৃপক্ষ ‘Address is not found’ লিখে টেলিগ্রামটি ফেরত পাঠান। এ সময় সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নজরুলের অনশনে খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। তিনি শিবপুর থেকে ১৯২৩ খৃস্টাব্দের ১৭ মে হুগলী জেলে নজরুলকে দেখতে ছুটে যান। কিন্তু কর্তৃপক্ষ তাঁকে অনুমতি দেয় নি। নজরুলের মা’ যায়েদা খাতুনও দেখা করতে ব্যর্থ হন। শেষ পর্যন্ত অনশনের ৩৯ দিন পর কুমিল্লার মাতৃসম বিরজা সুন্দরী দেবীর অনুরোধে তাঁরই হাতে লেবুর রস পান করে বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম অনশন ভঙ্গ করেন।
বাংলাদেশের ১ম ডাক টিকিট স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে ২৯ জুলাই, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার প্রথম ডাক টিকিট প্রকাশ করে। উল্লেখ্য ব্রিটীশ এম পি জন স্টোন হাউস প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে ডাক টিকিট প্রবর্তনের অনুরোধ জানালে সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়। এ সময় ৮টি ডাকটিকিট প্রকাশিত হয় লন্ডনের ফরম্যাট ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রেস হতে। ডাক টিকিট গুলির মূল্যমান ছিল ১০পয়সা, ২০পয়সা, ৫০পয়সা, ১.০০ টাকা, ২.০০ টাকা, ৩.০০ টাকা, ৫.০০ টাকা, ১০.০০ টাকা। এই ডাক টিকিটের নকশা তৈরী করেন পশ্চিমবঙ্গের গ্রাফিক শিল্পী অধ্যাপক বিমান মল্লিক।
দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় বিশ্ব ডাক ব্যবস্থা অনেক পথ অতিক্রম করে ডিজিটাল ব্যবস্থায় এসেছে। একসময়ের ‘মনোপলি’ তথা ডাক পরিবহনে সরকারের একচেটিয়া অধিকার থেকে হালের ই-মেইল ও প্রাইভেট কুরিয়ার সার্ভিসে তা অনেকখানি গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেছে। তারপরও রয়েল মেইলের বেশ কয়েকটি প্রতিদ্বন্দ্বীকে পাশ কাটিয়ে আজও চিঠি ডোর টু ডোর ডেলিভারী দিয়ে অতীত গৌরব ধরে রেখেছে।
লেখক: বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত ডিআইজি। লেখাটি সম্পাদনা করেছে দৈনিক দেশ তথ্যের ঢাকা ডেস্ক।
এবি/০১ সেপ্টম্বর/২০২১
প্রিন্ট করুন
Discussion about this post