লাল বাহাদুর শাস্ত্রী ১৯৬৪ সালের ৯ জুন থেকে ১৯৬৬ সনের ১১ জানুয়ারি পর্যন্ত ভারতের ২য় প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। বিখ্যাত এই রাজনীতিকের বাড়ি ছিল ভারতের উত্তর প্রদেশের মোগলসরাইয়ের চান্দাউলিতে। বাবা ছিলেন একজন স্কুল মাস্টার। তাঁর বয়স যখন এক বছর সে সময় বাবা মারা যান।
বাবার পরিবারে জীবন ধারণের মতো সংগতি ছিলনা। তাই বাধ্য হয়ে মায়ের সাথে হয়েছিলেন মামার বাড়ির বাড়তি সদস্য। সেখানেই তার বেড়ে উঠা ও লেখাপড়া। মাত্র ১৬ বছর বয়সে তিনি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। সেই ছিল তাঁর রাজনীতির হাতেখড়ির শুরু।
মেধা ও মনোযোগ দিয়ে অল্পদিনের মধ্যেই তিনি মহাত্মা গান্ধী ও পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরুকে তার নাম মুখস্ত করিয়ে দিতে পেরেছিলেন। এরপর বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে রাখতে তাদের বিশ্বস্ত হয়ে উঠেন। তাকে নিয়ে রয়েছে অনেক গল্প। ভারতের শিশুরা তাকে আদর্শের প্রতিক মনে করে। তার অনেক গল্পের মধ্যে তুলে ধরবো মাত্র তিনটি গল্প।
প্রথম গল্পঃ লাল বাহাদুর শাস্ত্রী তখন রেলমন্ত্রি। তিনি কোন প্রেটোকল নিতেন না। সাধারণ নাগরিকের মতোই প্যাসেন্জার ট্রেনে বাড়ি এসে মাকে দেখেই আবার চলে যেতেন। একদিন তার মা জিজ্ঞাসা করে বসলো দিল্লিতে তুই কি করিস? উত্তরে মাকে বললেন, ভারতীয় রেলে ছোট্ট একটা কাজ করি। মা পাল্টা প্রশ্ন করে বললেন, তুই রোজ রোজ বাড়ি আসিস না কেন? সোজা উত্তর- ছুটি পায়না তাই আসতে পারিনা। মা বললেন, ঠিক আছে ছুটি না পেলে আসার দরকার নেই। আমি গিয়েই তোকে দেখে আসবো। কেমন করে যাবো শুধু তাই বল। শাস্ত্রী জি বললেন, তুমি এখান থেকে ট্রেনে উঠে দিল্লি স্টেশনে নামবে। তারপর স্টেশন মাস্টারের কাছে গিয়ে বললেই তিনি আমাকে ডেকে দিবেন।
পরের সপ্তাহে ছেলের জন্য ভালোমন্দ খাওয়ার বানিয়ে দিল্লি যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বের হলেন তার মা। মা জানতেন না দিল্লির গাড়ি কখন আসে এবং কখন ছেড়ে যায়। তাই সে নিজের সুবিধা মতো সময়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে স্টেশনে পৌঁছেই দেখলেন একটি গাড়ি ছেড়ে গেল। ২য় গাড়ির অপেক্ষায় তিনি একটি গাছ তলায় বসে পড়লেন। তাকে একা বসে থাকতে দেখে একজন কুলি জিজ্ঞাসা করলো, বুড়ি মা তুমি কোথায় যাবে? বুড়ি বিড়বিড়িয়ে বললো দিল্লি।
–দিল্লির গাড়ি তো এই মাত্র ছেড়ে গেল।
–তাতে কি হয়েছে। আবার যে গাড়ি আসবে সেই গাড়িতেই উঠে পড়বো।
–সেই গাড়িতো আসবে বিকেলে।
বুড়ি বললো তাহলে বিকেলেই যাবো।
বুড়ির মুখে এমন কথা শুনে স্টেশনের লোকেরা ভাবলো তার বোধ হয় মাথা খারাপ। এভাবে তাকে পাগলি ভেবে যে যেমন পারলো তেমন করেই বুড়িকে প্রশ্ন করে মজা নিতে শুরু করলো।
যে যাই জিজ্ঞাসা করুক না কেন, বুড়ি কিন্তু সমানে সব প্রশ্নের উত্তর দিতে থাকলেন।
একজন জিজ্ঞাসা করলো, বুড়ি মা তুমি দিল্লিতে কার কাছে যাবে। বুড়ি বললো, ছেলেকে দেখতে যাব।
তোমার ছেলের নাম কি? –আমার ছেলের নাম লাল। আরেক জন জিজ্ঞাসা করলো তোমার ছেলে দিল্লিতে কি করে? বুড়ি বললো , আমার ছেলে দিল্লি রেল স্টেশনে কাজ করে।
লোকজন হাসাহাসি করে বলে উঠলো, হায় হায় তুমি তো তাহলে রেলমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর মা?
এবারো বুড়ির সোজা উত্তর। না-না। আমার ছেলের নাম তো কেবলই লাল। আর সে তো মন্ত্রী না।
এভাবে রেল মন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর মাকে নিয়ে উৎসুক জনতা মজা করতে শুরু করলো। হৈ হুল্লোড় দেখে এলেন স্টেশন মাস্টার। তিনি তাকে উঠিয়ে নিয়ে অফিস রুমে বসালেন। এরপর কয়েকটি প্রশ্ন করে নিশ্চিত হলেন যে, এই বুড়িই রেলমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর মা। তিনি বিষয়টি তার বার্তায় দিল্লিতে জানিয়ে দিলেন।
বিকেলের ট্রেনে রেলমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী এসে তার মাকে জড়িয়ে ধরে শিশুর মতো কান্নাকাটি শুরু করে দিলেন। বলরেন মা, তুমি সত্যি সত্যিই আমাকে দেখার জন্য দিল্লি যাওয়ার জন্য বাড়ি ছাড়বে এটা আমার জানা ছিলনা। আমি এসে গেছি তুমি বাড়ি চলো।
লাল বাহাদুর শাস্ত্রীকে মা শুধু দু’টি প্রশ্ন করেছিলেন, “তু লাল ছে লাল বাহাদুর শাস্ত্রী কব বন গয়া? রেল কো ছোটা কর্মচারী ছে মন্ত্রী কব বন গয়া? ইয়ে পাতা তু মুঝে কিউ নেহি দিয়া? “
উত্তরে শাস্ত্রী বলেছিলেন মা, আমি এখনো তোমার সেই ছোট্ট লাল। আমি মন্ত্রী হলেও জণগণের সেবক।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এমন ঘটনা বিরল নয় কি? উত্তর হবে নিশ্চয়ই।
২য় গল্পঃ মহাত্মা গান্ধীর মৃত্যুর পর তিনি ছিলেন পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরুর প্রধান সঙ্গি। ১৯৬২ সালে পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু তাঁকে অখিল ভারত কংগ্রেস পার্টির জেনারেল সেক্রেটারি বানিয়েছিলেন। অনুগত্যতা ও বিশ্বস্ততার জন্য পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু তাকেই বেশি নির্ভর করতেন।
সে সময়ে কাশ্মীরে একটা রাজনৈতিক সংকট হয়। সেই সংকট নিরশনের জন্য প্রধানমন্ত্রী জওহর লাল নেহেরু একদিন তাঁকে কাশ্মিরে যেতে অনুরোধ করেন। সেই অনুরোধ তিনি অতি নিরবে এড়িয়ে যান। বিষয়টি অতিব জরুরী হওয়ায় পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু আবারও তাঁকে কাশ্মীরে যাওয়ার কথা মনে করিয়ে দেন। লাল বাহাদুর শাস্ত্রী এবারো একই কৌশল অনুসরণ করলেন।
এভাবে বার কয়েক অনুরোধ উপেক্ষিত হওয়া পর পণ্ডিত নেহরু তাঁকে কাশ্মীর না যাওয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। সে উত্তর দিতেও তিনি দিতে অনাগ্রহ দেখালেন। এরপর নেহেরুর পিড়াপীড়িতে লাল বাহাদুর শাস্ত্রী বললেন, কাশ্মীরে খুব ঠাণ্ডা পড়ছে। সেই ঠাণ্ডা মোকাবেলা করার মতো গরম পোষাক তার নেই। নেহেরু হতবাক হয়ে তাঁর কোর্ট খুলে লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর গায়ে পরিয়ে চোখের পানি মুছে ছিলেন। পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরুর মৃত্যুর পর লাল বাহাদুর শাস্ত্রী ওই কোর্টটা পরেই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন।
সেই প্রেক্ষাপট বর্তমানের সাথে তুলনা করলে অবাক হতে হয় বৈকি। এখন এমন একটি ক্ষমতাশীন দলের জেনারেল সেক্রেটারি তো দুরের কথা, থানা বা ইউনিয়ন পর্যায়ের একটা পাতি নেতাও গৌরব করে বলে তার জামাটার দাম লাখ টাকা। প্যান্টের দাম তার চেয়েও বেশি। মোবাইল সেও তো লাখের কম নয়। চশমাও তাই। গাড়ির দাম কোটি। বাড়ির দাম শত কোটি। এর চেয়েও যদি বেশি কিছু বলার থাকে তা বলতেও তারা লজ্জা বোধ করে না। আর এই সব নেতাদের মোশাহেব বা চামচাদের কথা নাইবা বললাম। এসবই হলো বর্তমান জামানার হাইব্রিড নেতাদের কথা।
তৃতীয় গল্পঃ লাল বাহাদুর শাস্ত্রী একটি গাড়ি কেনার জন্য পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে ১৯৬৫ সালে মাত্র ৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। জীবদ্দশায় তিনি সেই ঋণের এক কিস্তিও জমা করতে পারেন নাই। ১৯৬৬ সালে তার মৃত্যুর পর ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বাড়িতে নোটিশ পাঠান। স্ত্রী ললিতা শাস্ত্রী নিজের পেনশনের টাকা থেকে ঐ ঋণের সকল কিস্তি শোধ করেছিলেন। লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর সহধর্মিণী ললিতা শাস্ত্রীও ঠিক তার মতোই সৎ স্বভাবী ছিলেন। একজন প্রকৃত জীবনসঙ্গীর মতোই সারা জীবন তিনি পাশে ছিলেন।
লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর ওই গাড়িটি আজও রয়েছে। দিল্লির জনপথের আবাসের বর্তমান সংগ্রহশালায় গেলেই গাড়িটি দেখা যায়।
বর্তমান সময়ের এমন একজন নেতার ক্ষেত্রে এই ঘটনা ঘটলে ব্যাংক ঋণের ওই টাকার যে কি হতো তা বলাই বাহুল্য।
লেখাটি দৈনিক দেশতথ্য পত্রিকার পাঠকদের জন্য লেখেছেন প্রখ্যাত সাংবাদিক আলী আসগর স্বপন। লেখাটি সম্পদনা করেছে দৈনিক দেশতথ্যের ঢাকা ডেস্ক।
এবি/১৩ আগস্ট/২০২১
প্রিন্ট করুন
Discussion about this post